বইমেলা হয়ে উঠবে জীবন মেলা

৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ | ১২:০৭ অপরাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

আমার বইমেলা দেখার অভিজ্ঞতা ঢাকাতেই। বিদেশের কোনো বইমেলা দেখার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার নেই। আমার বইমেলার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের বইমেলা দিয়ে। সেটা শুরু হয়েছে সেই সত্তরের দশকে যখন বাংলাদেশের একজন মুক্তিযোদ্ধা দেশপ্রেমিক প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহা তার ‘মুক্তধারা’ প্রকাশনীর কিছু বই বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে একটা আলোচনা অনুষ্ঠানের পাশে ঘাসের ওপর চাদর বিছিয়ে বিক্রি শুরু করেন তখন থেকে। সত্যিকার অর্থে সেটাই বাংলাদেশে বইমেলার সূচনালগ্ন। তাই বলা যায়, বাংলাদেশের বইমেলার সূচনালগ্ন থেকে আমি তাতে শরিক, অংশীজন। আমার মনে আছে ‘পুঁথিঘর’ নামে একটি ‘নোটবই’ অর্থাৎ ছাত্রদের সহায়ক গ্রন্থের প্রকাশনা সংস্থার সৃজনশীল শাখা হিসাবে ‘মুক্তধারা’র জন্ম। ‘মুক্তধারা’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রগতিশীল চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশপ্রেম- উজ্জীবনমূলক গ্রন্থ প্রকাশনা শুরু করে। সেটা ছিল খুবই একটা সাহসী এবং দূরদর্শী চেতনার কাজ। সেই ‘মুক্তধারা’ যখন বই বিপণনের জন্য বই নিয়ে একক উদ্যোগে সূচনা করল-তখন এটা মেলা ছিল না-ছিল ‘মুক্তধারা’র একক সৃজনশীল উদ্যোগ- সেখানে আমার বই ‘তিমি’ ছিল, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বই ছিল, আহমদ ছফা, আবদুল গাফফার চৌধুরী, শাহেদ আলী, সৈয়দ আলী আহসানসহ অনেক লেখকের সৃজনশীল বই বিক্রি হয়েছিল। অনেক লেখকের বই ছিল অর্থে সেটাকে মেলা বইয়ের আয়োজন বলে ‘বইমেলা’ হয়তো বলা যায়। কিন্তু সেই সূচনালগ্নই পরে অনেক প্রকাশকের অংশগ্রহণে ধীরে ধীরে আজকের এই মেলায় পরিণতি পেল। সত্যিকার অর্থে প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহা একটি বৈপ্লবিক কাণ্ডের সূচনা করেছিলেন। তখন তো সৃজনশীল বইয়ের কোনো আলাদা অস্তিত্ব ছিল না প্রায়। বই অর্থই ছিল স্কুল-কলেজের পাঠ্যবই এবং তার সহায়ক নোটবই। ‘মুক্তধারা’ যেন বইকে মুক্তি দিল। স্বীকৃতি দিল নবীন তরুণ লেখকদের। স্বীকৃতি পেল লেখকের লেখক সত্তা। অনেক বড় বড় কাজের মতো, অনেক বড় বড় আন্দোলনের মতো, অনেক বড় বড় কর্মসূচির মতো সামান্য আকারে বইমেলাটাও আমাদের এই গুণী প্রকাশক চিত্ত বাবুর হাতে সূচনা হয়েছিল। ‘মুক্তধারা’ই ছিল এদেশের সৃজনশীল বইয়ের একমাত্র প্রকাশক। তখন অন্য প্রকাশকরা সৃজনশীল বই ছাপতে ইতস্তত করতেন। যা ছাপাতেন সেগুলো প্রবীণ লেখকদের বই যেমন-আবুল কালাম শামসুদ্দীন, সরদার জয়েন উদ্দীন, গোলাম মোস্তফা, মওলানা আকরাম খান, আবুল মনসুর আহমদ এসব ‘ওল্ড-টাইমা’র যাদের আমরা বলি। সঙ্গে কিছু হয়তো রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত-শরৎচন্দ্রের বই। দেশ ভাগের আগে যারা লিখতেন, তাদের বইই ছাপাতেন। কিন্তু নতুন তরুণ, নবীনদের বই ছাপা শুরু হয় স্বাধীনতার পরে বিশেষত, সত্তরের শেষ এবং আশির দশক থেকে। আর সেগুলোর পথিকৃৎ এই চিত্তরঞ্জন সাহা এবং তার প্রতিষ্ঠান ‘মুক্তধারা’। তারপর দেখা গেল-বাংলা একাডেমি এটাকে গ্রহণ করল তাদের বার্ষিক কর্মসূচি হিসাবে। ভাষা আন্দোলনের একটা কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত রূপে। তারা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলার জন্য প্রকাশকদের আহ্বান জানালেন। প্রকাশকরা ছোট ছোট দোকান সাজিয়ে তাদের বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসল এবং এই আয়োজন ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করলো, সাধারণ মানুষ একে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করলেন। প্রকাশকরাও এ থেকে সৃজনশীল বই ছাপতে অনুপ্রাণিত হলেন; এটা বইমেলার একটা বিরাট অবদান যে প্রকাশকদের উৎসাহিত, উদ্বুদ্ধ করতে পারল সৃজনশীল বই ছাপতে। আর পাঠকরাও উদ্বুদ্ধ হলো পছন্দের বই ঘুরেফিরে খুঁজে পেতে কিনতে। বই কেন্দ্রিক একটা সামাজিক সম্প্রীতির সূচনা ঘটল দেশে। প্রকাশক-লেখক-পাঠক এবং সংস্কৃতিবান মানুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণে বইমেলা এতো ব্যাপক হয়ে উঠল যে, দেখা গেল বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের স্বল্প পরিসরে আর কুলোচ্ছে না। তখন পার্শ্ববর্তী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একে সম্প্রসারিত করা হলো। বাংলা একাডেমির অপরিসর প্রাঙ্গণে গায়ে গায়ে লাগানো দোকানে বই বিক্রি হতো, কিন্তু কোনো নান্দনিকতা ছিল না, স্টলগুলোর কোনো স্বাতন্ত্র্য ছিল না, ব্যক্তিত্ব ছিল না। এখন বড় পরিসরে মেলা হওয়ায় স্টলগুলোর নান্দনিকতা এসেছে, ব্যক্তিত্ব এসেছে, বৈচিত্র্য এসেছে। যেমন অন্য প্রকাশ, বাংলা একাডেমি, ইউপিএল তাদের স্টলে স্বাতন্ত্র্য তুলে ধরে। বইমেলার শ্রী বৃদ্ধি হচ্ছে সন্দেহ নেই-বাইরের দিকে; অনেক জনসমাগমও হচ্ছে। কিন্তু পাঠক-দর্শকদের ভিড় থাকলেও বিক্রি হচ্ছে কম। চিত্তরঞ্জন সাহা যেমন বইকে জীবনের অংশ করে তোলার চেষ্টা করেছিলেন বর্তমান প্রকাশকদের তেমনই বই বিক্রির জন্য ‘সেলস প্রমোশনে’ উদ্ভাবনী চিন্তার পরিচয় দিতে হবে। বই কিন্তু উচ্চবিত্তরা কেনে না, বই কেনে মধ্যবিত্ত, নিম্ন বিত্তরা। কিন্তু বর্তমানে ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থায় বই কেনা কষ্টকর এই চিন্তাসচেতন দুটি শ্রেণির জন্য। ‘সেলস প্রমোশনে’র উদ্ভাবনী আইডিয়ায় বইকে ঘরে ঘরে পৌঁছানোর জন্য সাহসী উদ্যোগ নিতে হবে। প্রকাশকরা পাঠকের কাছে বইকে সহজে পৌঁছে দিতে পাঠককে তাদের মেম্বার করে নিয়ে নগদ মূল্যে ছাড় এবং সহনীয় কিস্তিতে বই বিপণন করতে পারে। এ কাজে ডিজিটাল প্লাটফরমগুলোর সঙ্গে কাজ করতে পারেন। দেশের সমস্ত পত্রিকা, টেলিভিশন ও রেডিও যে প্রচার প্রচারণার সুযোগ করে দিয়েছে সেই সুযোগকে প্রকাশকরা কাজে লাগাতে পারেন। মেলার মাঠে শিশু, নারী এবং প্রবীণরা যাতে স্বাচ্ছন্দে যেতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। মেলার মাঠে বিভিন্ন গণমাধ্যম, বাংলা একাডেমির লেখক মঞ্চ ইতিবাচক-এসব পরিসরকে পারস্পরিক চিন্তা-ভাবনা বিনিময় উপযোগী করে তুলতে হবে। এখানে শুধু ‘মোড়ক উন্মোচন’ এবং ‘ফটোসেশন’ নয়, এসব মঞ্চে বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে আলাপ-আলোচনা, ভালোলাগা-মন্দলাগা তুলে ধরতে হবে, লেখক-পাঠক-প্রকাশককে। ‘প্রচারেই প্রসার’-বই এমন পণ্য নয়, বইকে হৃদয়ে পৌঁছতে হবে। সে জন্য দরকার ‘পাঠ উন্মোচন’-মোড়ক উন্মোচন নয়। বই একটি ‘সত্তা’, সেই ‘সত্তা’কে স্পন্দিত করতে হবে, সঞ্চারিত করতে হবে পাঠকের হৃদয়ে, মননে-তা হলেই বইমেলা হয়ে উঠবে জীবন মেলা। অনুলিখন : শুচি সৈয়দ