কাচের ঘর: বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বিমুখিতা
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার ছয় মাস পূর্ণ হলো। টানা আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের পর ক্ষমতায় আসে নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন এই সরকার। ক্ষমতায় এসে তারা দুর্নীতি দূর করার, লুটপাট বন্ধের এবং স্বচ্ছ প্রশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু মাত্র ছয় মাসের মাথায়ই সরকার নানা অভিযোগের মুখে পড়েছে, যা তাদের নীতির সঙ্গে স্পষ্ট বৈপরীত্য তৈরি করছে। সম্প্রতি দুবাইয়ে সম্পদ থাকা বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু এই তদন্তে প্রধানত আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের নামই উঠে আসছে। এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৪৬১ বাংলাদেশির দুবাইয়ে সম্পদ রয়েছে, তবে তালিকায় বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য নাম বাদ পড়েছে। যেমন, অন্তর্বর্তী সরকারের সদ্য নিয়োগ পাওয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান আহসান মনসুরের মেয়ে মেহরিন সারা মনসুর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক ঝলক তাকালেই দেখা যায় তার বিলাসবহুল জীবনযাত্রা—সূর্যস্নাত ছুটির দিন, ফার্স্ট ক্লাস বিমানের কেবিনে সাজানো ডিজাইনার ব্যাগ, দামী গাড়ি ও স্বর্ণালংকারের ছড়াছড়ি। অথচ আহসান মনসুর নিজেকে অর্থনৈতিক শুদ্ধতার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতি এই মুহূর্তে কঠিন সময় পার করছে। মূল্যস্ফীতি চরমে, সুদের হার ১২% ছাড়িয়েছে, আর সাধারণ মানুষ প্রতিদিন জীবনধারণের জন্য সংগ্রাম করছে। এর মধ্যে আহসান মনসুরের মেয়ে কেমন করে এত আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন করেন? কাচ ও স্টিলের তৈরি তার বাবার তিনতলা ‘ফার্মহাউস’ আর জনগণের অর্থনৈতিক দুর্দশা কি একসঙ্গে মানানসই? মেহরিন দীর্ঘদিন ধরেই বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন। ওয়াশিংটন ডিসির উপকণ্ঠে বেড়ে ওঠা, ক্যাথলিক বালিকা বিদ্যালয়ে পড়াশোনা, বিশ্বভ্রমণ—সব মিলিয়ে তিনি যেন ‘সোনার চামচ মুখে নিয়েই জন্মেছেন।’ তার নামে নানা ব্যবসা থাকলেও এগুলো নিয়ে তেমন কোনো স্বচ্ছ তথ্য পাওয়া যায় না। মেহরিন ফ্যাশন ব্লগ, গয়নার ব্যবসা ও রেস্তোরাঁ চালানোর চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তার প্রকৃত আয়-উৎস অজানা। ঢাকায় এসে তিনি উচ্চবিত্তদের জন্য পশ্চিমা খাবার পরিবেশনকারী রেস্তোরাঁ চালু করেছিলেন। বর্তমানে তিনি দুবাইতে থাকেন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিলাসবহুল জীবনের নানা মুহূর্ত প্রকাশ করেন—ফ্যাশন শোতে অংশগ্রহণ, বিলাসবহুল গাড়ি চালানো, এবং লাখ টাকার হাতঘড়ির সংগ্রহ প্রদর্শন। তার প্রতিষ্ঠিত দাতব্য সংস্থা ‘ওয়াচার্স ফাউন্ডেশন’, যা দরিদ্র শিশুদের জন্য খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার কথা বলেছিল, কার্যত নিষ্ক্রিয়। ২০২৩ সালের পর থেকে সংস্থার ফেসবুক পেজে কোনো আপডেট নেই, এবং ওয়েবসাইটেও লেখা আছে, “শীঘ্রই চালু হবে।” অথচ এই সময়ের মধ্যে মেহরিনের ব্যক্তিগত জীবনের ঝলক নিয়মিত পাওয়া গেছে—খরচসাপেক্ষ শপিং ট্রিপ, ক্রিপ্টোকারেন্সি ইভেন্টে অংশগ্রহণ, এবং ঢাকার ‘বিকল্প’ বাড়ির বিলাসবহুল সাজসজ্জার ছবি। প্রশ্ন উঠছে, গণমাধ্যম কেন মেহরিনের এই জীবনযাপন নিয়ে নিশ্চুপ? গণমাধ্যম কি অন্তর্বর্তী সরকারের চাপে এই তথ্য উপেক্ষা করছে? একদিকে যখন সুদের হার ও মূল্যস্ফীতির বোঝায় সাধারণ মানুষ দিশেহারা, তখন সরকারের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধানের কন্যার বিলাসী জীবন কি সরকারের স্বচ্ছতার দাবির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? এই ঘটনাগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বিমুখিতা স্পষ্ট করছে। তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শুদ্ধি অভিযান’ চালানোর কথা বললেও, নিজেদের স্বজনদের প্রতি নীরব অবস্থান নিচ্ছে। অর্থনৈতিক সংকটের দোষ অন্যদের ঘাড়ে চাপানোর আগে, সরকার কি নিজের অন্দরমহল পরিস্কার করতে প্রস্তুত? জনগণের সামনে সেই প্রশ্নই এখন সবচেয়ে বড় হয়ে উঠছে।