ভ্যাট চাপিয়েও প্রতিবাদের মুখে ৮ পণ্যে প্রত্যাহার চায় এনবিআর, আইএমএফের ‘না’

২১ জানুয়ারি, ২০২৫ | ৯:৩০ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সরকার ওষুধ, মোবাইল ফোনের টকটাইমসহ আটটি পণ্য ও সেবার ওপর নতুনভাবে আরোপিত ভ্যাট-কর প্রত্যাহারের বিষয়টি ভাবছে, তবে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর চাপ রয়েছে। তিনি বলেন, আইএমএফ পরামর্শ দিয়েছে যে, ভ্যাট ও শুল্ক বৃদ্ধি বিষয়ে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসলে রাজস্ব আহরণে সংকট দেখা দিতে পারে, যা বাংলাদেশের জন্য ঋণ কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করতে পারে এবং আইএমএফ-এর শর্ত লঙ্ঘিত হবে। এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান জানিয়েছেন, সরকার ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর বিষয়টি নিয়ে ইতিবাচক, তবে এটি এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি। ওই আটটি পণ্য ও সেবার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রভাইডার (আইএসপি) সেবা, ব্র্যান্ড ও নন-ব্র্যান্ড পোশাক, নন-এসি হোটেল, মোটর গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপ এবং মিষ্টি। ২০২৩ সালের ৩০শে জানুয়ারি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট মোকাবিলায় আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করে, যার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের কাছে অর্থনৈতিক সংস্কারের শর্ত আরোপ করা হয়। এই শর্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকারের রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে, যা অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ৪২ হাজার কোটি টাকার বেশি। এই ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার জানুয়ারিতে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট এবং শুল্ক বাড়ায়। এর মধ্যে রেস্তোরাঁ সেবায় ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। মূল্যস্ফীতি যখন দুই অঙ্কের দিকে চলে গেছে, তখন এসব পদক্ষেপের বিরুদ্ধে অর্থনীতিবিদরা এবং ব্যবসায়ী মহল থেকে বিরোধিতা আসতে থাকে। বিশেষ করে, বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি ভ্যাট বৃদ্ধি নিয়ে কঠোর প্রতিবাদ জানায় এবং ধর্মঘটের হুমকি দেয়। ওই আদেশে ওষুধ, এলপি গ্যাস, গুঁড়ো দুধ, বিস্কুট, আচার, সস, সিগারেট, জুস, টিস্যু পেপার, ফলমূল, সাবান, ডিটারজেন্ট পাউডার, মিষ্টি, চপ্পল (স্যান্ডেল), বিমান টিকেটসহ শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট এবং শুল্ক বাড়ানো হয়েছিল। হোটেল-রেস্তোরাঁ মালিকদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে গত ১৬ই জানুয়ারি সরকার রেস্তোরাঁ সেবার ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয় এবং একই দিনে ওষুধসহ আটটি পণ্য ও সেবার ভ্যাট ও শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্তও জানায় এনবিআর। এনবিআর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রেস্তোরাঁ সেবায় ভ্যাট কমানোর সিদ্ধান্ত কার্যকর থাকবে। তারা আরও বলেন, গত ১৬ই জানুয়ারি এনবিআর-এর পক্ষ থেকে আটটি পণ্য ও সেবার ভ্যাট কমানোর প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছিল, যা ভেটিংয়ের জন্য পাঠানোর কথা ছিল। তবে আইএমএফ-এর চাপের কারণে এই প্রস্তাব বাতিল হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কর্মকর্তারা জানান, গত বৃহস্পতিবার মোবাইল টকটাইমে ২৩ শতাংশ ভ্যাট কমিয়ে ২০ শতাংশ, আইএসপির ওপর ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার, ব্র্যান্ড ও নন-ব্র্যান্ড পণ্যের ওপর ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ এবং ওষুধের ওপর ভ্যাট ৩ শতাংশ থেকে ২.৪ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছিল। এছাড়া, নন-এসি হোটেল, মোটর গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপ এবং মিষ্টি বিক্রির ওপর অতিরিক্ত ভ্যাট আদায়ের আদেশ প্রত্যাহারের প্রস্তাবও ছিল। কিন্তু আইএমএফ নতুন ভ্যাট ও শুল্ক বৃদ্ধি কার্যকর হওয়ার পর রাজস্ব আদায়ে কিছুটা উন্নতি দেখেছে, তাই তারা এখন এসব কমানোর প্রস্তাবের বিরোধিতা করছে। আইএমএফ ইতোমধ্যে বাংলাদেশকে তিনটি কিস্তিতে মোট ২.৩১ বিলিয়ন ডলার ঋণ ছাড় করেছে এবং শর্ত পূরণের মাধ্যমে ২০২৬ সাল পর্যন্ত মোট সাত কিস্তিতে ঋণের পুরো পরিমাণ পাওয়ার কথা রয়েছে। এই ঋণের কিস্তি চলমান অবস্থায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আসে। ৮ই আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। সংকটময় অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উত্তরণে আইএমএফ-এর কাছে আরও ঋণ চেয়েছে সরকার এবং আইএমএফ-এর চতুর্থ কিস্তি ফেব্রুয়ারি মাসে পাওয়ার কথা রয়েছে, যা হবে ৬৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার। আইএমএফ-এর ঋণ চুক্তিতে নির্ধারিত শর্তে বলা হয়েছে, এনবিআরকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিডিপির অনুপাতে কর আহরণ ০.৫ শতাংশ বাড়াতে হবে, ২০২৪-২৫ সালে আরও ০.৫ শতাংশ এবং ২০২৫-২৬ সালে ০.৭ শতাংশ। বাংলাদেশের বর্তমান কর-জিডিপির অনুপাত মাত্র ৭ শতাংশ এবং এনবিআর-এর একজন কর্মকর্তা জানান, “আইএমএফ-এর ঋণের জন্য একটি প্রধান শর্ত ছিল প্রতি বছর জিডিপির অনুপাতে ০.৫ শতাংশ হারে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হবে, কিন্তু এই শর্ত পূরণ করা সম্ভব হচ্ছিল না। এ কারণেই গত ৯ই জানুয়ারি প্রায় একশটি পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।” এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান জানান, “প্রস্তাবটি এখনও প্রক্রিয়াধীন, চূড়ান্ত হয়নি। উপদেষ্টা মহোদয় অসুস্থ থাকায় অফিসে উপস্থিত থাকতে পারেননি, তবে সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে। দেখা যাক, কতটুকু সম্ভব হয়।” গত ১৬ই জানুয়ারি, সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক শেষে অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “ওষুধ এবং পোশাকসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর বাড়তি ভ্যাট আরোপের বিষয়টি পুনরায় পর্যালোচনা করা হচ্ছে।” বাড়তি ভ্যাটের কারণে বাজারে পণ্যের দামে যে কিছুটা প্রভাব পড়েছে, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “দামের পরিবর্তন শুধু ভ্যাটের কারণে হয়নি। কিছু ক্ষেত্রে সরবরাহ শৃঙ্খলার প্রভাবও আছে। ভ্যাটের মাধ্যমে ফোন, বিদেশি ফলের জুসের দাম কিছুটা বাড়ানো হয়েছে, তবে সেগুলো খুবই সীমিত। আমরা বর্তমানে বিষয়গুলো পর্যালোচনা করছি, কিছু কিছু জিনিসের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।” তিনি আরও বলেন, “অত্যাবশ্যকীয় পণ্য, যেমন ওষুধ এবং পোশাক, যেগুলো সাধারণ মানুষের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে, সেগুলো পুনরায় পর্যালোচনা করা হচ্ছে।” অর্থ উপদেষ্টার এই বক্তব্যের তিন দিন পর এনবিআর-এর পক্ষ থেকে একেবারেই বিপরীত বক্তব্য পাওয়া যায়। এনবিআর-এর এই কর্মকর্তা এ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করেননি।