রুশ হেলিকপ্টার মিলছে না, ঝুঁকিতে অর্থ ফেরত
গত সরকারের মেয়াদে পুলিশের জন্য রাশিয়া থেকে কেনা দুটি হেলিকপ্টারের একটিও পাওয়া যাচ্ছে না। এর মূল্য বাবদ পরিশোধিত প্রায় তিনশ কোটি টাকার কিছুই ফেরত আসবে না। বাংলাদেশ সরকার রাশিয়ার যে প্রতিষ্ঠান থেকে হেলিকপ্টার কিনেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। চুক্তির দুই মাসের মাথায় নিষেধাজ্ঞার পরও পর্যায়ক্রমে তিন অর্থবছরে মূল্য পরিশোধ করে সরকার। গত বছর ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮ কর্মকর্তা প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন (পিএসআই) করতে রাশিয়া সফর করেছেন। চুক্তির মধ্যস্থতাকারীকে চার শতাংশ হারে কমিশনও দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার হেলিকপ্টার আপাতত গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জেএসসি রাশিয়ান হেলিকপ্টার্স থেকে এমআই ১৭১এ২ মডেলের দুটি হেলিকপ্টার কেনার জন্য চুক্তি করে বাংলাদেশ সরকার। দরপত্র ছাড়াই জিটুজি পদ্ধতিতে হেলিকপ্টার কেনার চুক্তি হয়। এতে ব্যয় ধরা হয় ৪২৮ কোটি টাকা। ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিন অর্থবছরে মোট মূল্যের ৭০ শতাংশ হারে প্রায় তিনশ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়। জেএসসি রাশিয়ান হেলিকপ্টার্স’র ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ২০২২ সালের প্রথম দিকে। বিষয়টি জানার পরও ২০২৪ সাল পর্যন্ত অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান ‘জেএসসি রাশিয়ান হেলিকপ্টার্স’র ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি গত বৃহস্পতিবার পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়। এরপরই নড়াচড়া শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের দপ্তরে গিয়ে জানা গেছে তিনি অফিসের বাইরে আছেন। অতিরিক্ত সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব পুলিশ ও এমটিএমসি) খন্দকার মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, এই চুক্তি ২০২১ সালে সম্পাদন হয়েছে। তখন আমরা বর্তমান দায়িত্বে ছিলাম না। রাশিয়ার সরকারি যে প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে হেলিকপ্টার কেনা হয়েছে ওই প্রতিষ্ঠানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বিষয়টি সরকারের নজরে এসেছে। দেখা হচ্ছে কীভাবে এত বড় ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি-ইকুপমেন্ট অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট) মো. রুহুল আমীন বলেন, বর্তমান পদে কিছুদিন আগে যোগদান করেছি। হেলিকপ্টার কেনার চুক্তি ২০২১ সালের। এখন ফাইল ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে এসব তথ্য বেরিয়ে আসছে। বিষয়টি দেখার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া হেলিকপ্টার সরবরাহ করলেও আপাতত তা গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, জিটুজি পদ্ধতিতে হেলিকপ্টার কেনা হলেও এর মধ্যস্থতাকারীকে ক্রয়মূল্যের ওপর ৪ শতাংশ হারে ১৭ কোটি ১২ লাখ টাকা কমিশন দেওয়া হয়েছে। এ মধ্যস্থতাকারী হচ্ছেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আইজিপির ক্যাশিয়ার। নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি জানা সত্ত্বেও গত বছর ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮ জন কর্মকর্তা প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন (পিএসআই) করতে রাশিয়া সফর করেছেন। আট সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পুলিশ ও এমটিএমসি) সচিব মো. নাসির উদৌলা। সম্প্রতি তিনি কৃষি মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়ে গেছেন। এ সফর কী করে সম্ভব হলো এমন প্রশ্নে অতিরিক্ত সচিব খন্দকার মাহবুবুর রহমান বলেন, যারা সফরে গেছেন তাদের জিজ্ঞেস করুন। আমরা বিষয়টি দেখছি, তবে মনে হচ্ছে কিছু তথ্যের ঘাটতি ছিল। রাশিয়া সফরে গেছেন এমন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নিষেধাজ্ঞা ছিল এমন তথ্য আমাদের জানা ছিল না। নিষেধাজ্ঞা আছে তা জানার পরও আটজন কর্মকর্তা পিএসআই করতে রাশিয়া যাওয়ার বিষয়ে ডিআইজি রুহুল আমীন বলেন, চুক্তির শর্ত অনুসারে যেতে হয়েছে। কারণ এটা আন্তঃরাষ্ট্রীয় চুক্তি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং জিটুজি চুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ও ইউক্রেন সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এরপর রাশিয়ার যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদনকারী সব প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নিষেধাজ্ঞা জারির মাত্র ২ মাস আগে ২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে দুটি হেলিকপ্টার কেনার চুক্তি করে বাংলাদেশ। দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ সরকার ২০২৪ সাল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে তিন অর্থবছরে ৪২৮ কোটি টাকা পরিশোধ করার কথা। সেক্ষেত্রে পরিশোধ করা হয়েছে ২৯৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা। শর্তমোতাবেক উল্লিখিত সময়ের মধ্যেই হেলিকপ্টার দুটি সরবরাহ করার কথা রাশিয়ার। সে অনুযায়ী তারা একটি হেলিকপ্টার এ বছরের ১৭ জানুয়ারি সরবরাহের জন্য তৈরি করে। অপরটি আগামী এপ্রিল মাসে দেওয়ার কথা। সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, চুক্তির মাত্র ২ মাসের মাথায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ান জেএসসি হেলিকপ্টার্সের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। তখনই সরকারের চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি ছিল। কারণ চুক্তির দু’মাস পর তেমন অর্থও পরিশোধ করা হয়নি। চুক্তি থেকে বেরিয়ে না এসে, উলটো বছরভিত্তিক ধারাবাহিকভাবে রাশিয়াকে অর্থ পরিশোধ করার মধ্যে বড় ধরনের দুর্নীতি আছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তারা আরও জানান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার বিবাদ কবে থামবে, কবে চুক্তি অনুসারে হেলিকপ্টার সরবরাহ নেওয়া যাবে এসব বিষয়ে নিশ্চয়তা ছাড়াই রাষ্ট্রীয় অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। এত বড় ঝুঁকি দুর্নীতিবাজরা এমনিতে নেয়নি। বরং এই কেনাকাটায় তাদের স্বার্থ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, রাশিয়া হেলিকপ্টার সরবরাহ করলেও এই মুহূর্তে সরকার তা গ্রহণ করতে পারবে না। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গিয়ে হেলিকপ্টার নেওয়ার ঝুঁকি সরকার নেবে না। ফলে হেলিকপ্টার কিংবা টাকা কবে পাওয়া যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তারা বলেন, এই কেনাকাটায় শুধু ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের জন্য জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে। কমিশনভোগী রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত ও দুর্নীতিবাজ আমলারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত। গত বছর ৫ আগষ্ট স্বৈরাচারের অপমানজনক বিদায়ের পর পুলিশ সদর দপ্তর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং স্বরাষ্ট্র সচিবকে বিষয়টি সবিস্তারে জানানো উচিত ছিল। অদৃশ্য কারণে তারা সত্য গোপন করেছে।