বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র ও বর্তমান প্রেক্ষাপট:আব্দুল হামিদ

স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর বাংলাদেশ যখন উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের মর্যাদা অর্জনের খুব কাছাকাছি ঠিক তখনি ৫ আগস্ট ঘটে যায় ইতিহাসের নিকৃষ্টতম ঘটনা। একটি নির্বাচিত সরকারকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে উৎখাত করে অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতা দখল করার কারনে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পুলিশকে হত্যা, তাদের গাড়িসহ থানায় আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়ার কারনে ৫ আগস্টের পর ২ মাস থানায় কোনো পুলিশ ছিলো না। পরবর্তীতে কিছু পুলিশ থানায় আসলেও তারা আর পূর্বের মত কাজ করার কোনো অবস্থায় ফিরে যেতে পারেনি। বাংলাদেশের সর্বত্র এখন বিশৃঙ্খলা। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, মিছিল মিটিং সভা করার স্বাধীনতা নেই। এমনকি আওয়ামিলীগ ছাড়াও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের কর্মীরা তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রমের জন্য অফিসে যেতে পারেনা। এখন বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিক্ষা, নিরাপত্তা ও অর্থনীতি নিয়ে বিশ্লেষণ করা যাক.. শিক্ষা ব্যবস্থা : পূর্ববর্তী সরকার বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার যে আধুনিকরণ করেছিলেো, আধুনিক বিশ্বের সাথে সামঞ্জস্য রেখে পাঠ্যক্রম সাজিয়েছিলো, বর্তমানে তা পরিবর্তন করা হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা অনীহা সৃষ্টি হয়েছে। কারন হঠাৎ একটি কারিকুলাম থেকে আরেকটি কারিকুলামে প্রবেশ করা ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য সহজসাধ্য নয়। গত বছর গুলোতে আমরা দেখেছি জানুয়ারির ১ তারিখের মধ্যেই প্রতিটা ছেলেমেয়েদের হাতে বই পৌছে যেতো, সবাই বই উৎসব করত, নতুন বইয়ের ঘ্রাণে ছেলেমেয়েরা মুগ্ধ হয়ে যেতো, তাদের পড়ার প্রতি একটা আগ্রহ তৈরি হত। কিন্তু বর্তমান সরকার নির্ধারিত সময়ে সবার কাছে বই পৌছে দিতে ও বই উৎসব করতে পারেনি। এমনকি তারা বলেছে, মার্চের আগে সবার কাছে বই পৌছে দেয়াও সম্ভব নয়। এদিকে বই না পাওয়ার কারনে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এছাড়াও পাঠ্যপুস্তকের অনেক অধ্যায়, অনেক লেখকের লেখা বাদ দেয়া হয়েছে যা শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য একটি অশনি সংকেত। বিশিষ্টজনেরা মনে করে এভাবে শিক্ষা ব্যবস্থার কোনো অগ্রগতি হবে না এবং যে শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড হিসাবে পরিগণিত হত তা ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা : বাংলাদেশে এখন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নাই বললেই চলে.. সর্বত্র মানুষ মব জাস্টিসের স্বীকার হচ্ছে। কিছুদিন আগেই সিদ্ধিরগঞ্জে একজন পুলিশকে চোর সন্দেহে গণপিটুনি দিয়েছে। গত ৭ তারিখ ওসি নেজামকে চট্টগ্রামে গণপিটুনি দিয়ে আহত করা হয়েছে। একটি দেশে যেখানে নিরাপত্তা বাহিনী নিরাপদ নয় সেখানে সাধারণ মানুষ কিভাবে নিরাপদে থাকবে সেটা চিন্তার বিষয়। ডিসেম্বর মাসে ঢাকার উত্তরাতে একই এলাকায় ৭ জন নারীকে গলা কেটে হত্যা করেছে দূর্বৃত্তরা। জানুয়ারীর ৬ তারিখেও ঐ স্থানে একজন নারীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। নারীরা এখন দিনের বেলাতেও নিরাপদে কোথাও যেতে পারছেনা। সারাদেশে ইজিবাইক চালকদের মধ্যে একটা ছিনতাই আতঙ্ক কাজ করছে বলেও উল্লেখ করেন শামীম নামের একজন ইজিবাইক চালক। কারণ চলতি নভেম্বর মাসের দুই সপ্তাহে রূপগঞ্জ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, ঝিনাইদহ জেলায় চালককে হত্যা করে ইজিবাইক ছিনতাই করা হয়েছে। নিজের গাড়ি চালিয়ে রোজকার করে সংসার না চালাতে পেরে তারা এখন দুর্বিষহ দিন অতিবাহিত করছে। বাংলাদেশে নিরাপত্তা ব্যবস্থার সবথেকে করুন দৃশ্য দেখা যায় রাজধানীর মোহাম্মদপুরে।সেখানে বিহারী ক্যাম্পে খুনোখুনি, প্রকাশ্যে ছিনতাই, ডাকাতি, সশস্ত্র মহড়ার ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি উন্নতির জন্য মোহাম্মদপুরে বিশেষ অভিযান হয়েছে। জেনেভা ক্যাম্পসহ বিভিন্ন স্থান থেকে শতাধিক সন্দেহভাজনক আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে। কিন্তু এখনো মানুষের আতঙ্ক কাটেনি বলেই জানান এলাকার একজন বাসিন্দা জেসমিন। তার ভাষায়, এখন পরিস্থিতি ভয়াবহ। কেমন যেন একটা আতঙ্কে আছি আমরা। আগে রাতে বারোটা একটায় মানুষ যাইতে পারছে বাইরে। এখন তো মানুষ ভয়ের চোটে বাইরে যায় না। স্কুলে সন্তানকে নিয়মিত আনা নেয়া করা একজন অভিভাবক বলেন, আমি ২০১০ সালের পর থেকে ঢাকাতে আছি। কখনো আমাদের এলাকার মধ্যে এমন নিউজ পাইনি। গণ্ডগোলের পর থেকে যখন এরকম দেখতেছি তখন আতঙ্কতো থাকবেই। চলন্ত রিকশা থেকে বয়স্ক একজনের কানের দুলটা ছিড়ে নিয়ে গেছে। রক্ত ঝরছে। এটা দেখার পর থেকে আমার বাচ্চাকে আমি বাসা থেকে হিজাব পরায় নিয়ে আসি, স্কুলের কাছে এসে হিজাবটা খুলি। আইনশৃঙ্খলার অবনতির বিষয়ে অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে তবে পরিচয় প্রকাশ করে মিডিয়ায় বক্তব্য দিতে অনিচ্ছুক তারা। বিরোধীপক্ষের কারও জান- মালের নিরাপত্তা নেই বরং তারা প্রতিনিয়ত মব জাস্টিসের স্বীকার। অনেকেই বলেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিরাপত্তার প্রশ্নে কেনো উত্তর দেয়না এড়িয়ে যান। তিনি দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ এটা এখন সবার কাছে পরিষ্কার। অর্থনীতি ব্যবস্থা : বাংলাদেশের পুরো অর্থনীতি এখন ধ্বসে গেছে বলা যায়। রপ্তানি এখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারনে বাইরের দেশের কোনো বিনিয়োগ বর্তমানে আর চোখে পড়ে না। বিশেষজ্ঞরা জানান দেশে স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার না করলে বাইরের দেশের বিনিয়োগ আসা করা বোকামি। এছাড়া প্রতিনিয়ত উস্কানিমুলক আচরন করে বাংলাদেশের সাধারন মানুষকে ভারত বিদ্বেষী করার কারনে, ভারতের সাথে আমদানি রফতানি স্থবির হয়ে আছে.. ভিসা প্রসেসিং স্থগিত করে রেখেছে। দূরবর্তী দেশ থেকে আমদানি রপ্তানি করার কারনে পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে । এতে প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতির সব সেক্টরে। আমদানি খরচ বাড়ায় দেশের মানুষকে বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে। যেখানে সাধারণ মানুষের সহজে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম মোবাইল ফোন, সেখানে একজন গ্রাহক ১০০ টাকা রিচার্জ করলে ৫৬ টাকা কর দিতে হচ্ছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভ্যাট বাড়াচ্ছে সরকার.. ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধনী) অধ্যাদেশ ২০২৫-এর খসড়া সংসদ বিষয়ক বিভাগের ভেটিং সাপেক্ষে বুধবার (১ জানুয়ারি) উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে নীতিগতভাবে যা অনুমোদন দেয়া হয়েছে তা কার্যকর হলে ৬৫ ধরনের পন্যের ওপর ১৫ থেকে ১০০ শতাংশ ভ্যাট ও শুল্ক বাড়বে। এলপি গ্যাস, বিস্কুট, আচার, টমেটো কেচাপ,সস, ফলমূল, সাবান, মিষ্টি, ডিটারজেন্ট, চপ্পল (স্যান্ডেল), টিস্যু পেপার, ইন্টারনেট, বিমান টিকিট সিগারেট, বিস্কুট, হোটেল, রেস্তোরাঁ- এসব পণ্য ও সেবা রয়েছে এই তালিকায়। নেপথ্যে কী? জানা গেছে, ঋণ দিতে আইএমএফ বাংলাদেশকে কর-জিডিপি অনুপাত ০.২ শতাংশ বাড়ানোর শর্ত দিয়েছে, টাকার অঙ্কে যা ১২ হাজার কোটির বেশি। এই অর্থ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার সঙ্গে যোগ হবে। জানা গেছে, জুলাই-আগস্টের আন্দোলন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নানাবিধ সংকটে রাজস্ব আদায়ের পরিস্থিতি ভালো নয়। চলতি অর্থ বছরের চার মাসে রাজস্ব ঘাটতি প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। এমন অবস্থায় বাড়তি রাজস্ব আদায়ে ভ্যাট বাড়ানোর জন্যই এই পদক্ষেপ। কামাল নামের একজন গ্রাহককে পণ্যের দামের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, গত একমাস আগে লাইফবয়ের যে সাবানটি ৪৫ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম আজকে সেই একই সাবান ৫৫ টাকা দিয়ে কিনলাম। একটি সাবান যদি ১০ টাকা বেশি দিয়ে নিতে হয় তবে বাকি পণ্য কেনাতো সম্ভব নয়। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার কারনে আমাদের মত মধ্যবিত্তপরিবারের মানুষ সংসার চালাতে হিমসিম খাচ্ছে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের অদক্ষতা ও আমদানি রপ্তানির খাটতির কারনে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে তাতে দেশের মানুষ প্রতিনিয়ত অসন্তোষ প্রকাশ করছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, সাধারণ মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার পর কেউ তাদের কথা মনে রাখেনা। সাধারন মানুষের দুঃখ, কষ্ট দূর করার থেকে ক্ষমতাকে তারা বেশি গুরুত্ব দেয়। সবকিছুতে যে অনিয়ন্ত্রণ, লুটপাট, বিশৃঙ্খলা দেখা যাচ্ছে এতে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নিয়ে সবাই সংকিত।