এস আলমের দুই ছেলেসহ ৫৪ জনের নামে মামলা
বেতনভুক্ত কর্মচারী ও নিজ আত্মীয়স্বজনের নামে কাগুজে প্রতিষ্ঠানে ঋণের নামে ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় এক হাজার ১১৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলমের ছেলে আহসানুল আলম ও আশরাফুল আলমসহ ৫৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বুধবার দুদকের চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ মামলাটি করা হয়। দুদক মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। এজাহারে বলা হয়েছে, ঋণের নামে ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের জুবিলী রোড শাখা থেকে তিন বছরে প্রায় এক হাজার ১১৩ কোটি ৯৩ লাখ ৬৪ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়। ব্যাংকটির জুবিলী রোড শাখার গ্রাহক মেসার্স ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্সের নামে ২০২২ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ইস্যুকৃত অসমন্বিত ৩২টি ডিলের মাধ্যমে মোট ১ হাজার ৭৪ কোটি ৮৯ লাখ ২৬ হাজার টাকা ছাড় করা হয়। ব্যাংকের জন্য ‘মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ’ ঋণ ছিল বলে ব্যাংকের অডিট প্রতিবেদনেও উঠে আসে। পরবর্তীতে ২০২৪ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে জাল নথি তৈরি করে কৃত্রিম উপায়ে ১৩ কোটি ৫০ লাখ ৮৭ হাজার টাকা ঋণ পরিশোধ দেখানো হয়। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ২ অক্টোবর পর্যন্ত ঋণ হিসাবে ৯৯৩ কোটি ৭০ লাখ ২৪ হাজার টাকা ও মুনাফা হিসাবে ১২০ কোটি ২৩ লাখ ৪০ হাজার টাকাসহ মোট ১ হাজার ১১৩ কোটি ৯৩ লাখ ৬৪ হাজার টাকা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎ হয়েছে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়। আসামি যারা : ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলমের ছেলে আহসানুল আলম এবং অপর ছেলে ও কাগুজের প্রতিষ্ঠান ইনফিনিটি সিআর স্ট্রিপস লিমিটেডের মালিক আশরাফুল আলমকে আসামি করা হয়েছে। তাদের নেতৃত্বে ঋণের নামে এসব অর্থ আত্মসাৎ করে স্থানান্তর ও হস্তান্তরের মাধ্যমে টাকা পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে। এছাড়া মামলার অন্যান্য আসামি হলেন মেসার্স ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্সের মালিক মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী, বাণিজ্য বিতান করপোরেশনের মালিক মো. তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী, অ্যাপার্চার ট্রেডিং হাউজের মালিক এস. এম নেছার উল্লাহ, ড্রিমস্কেপ বিজনেস সেন্টারের মালিক মোহাম্মদ মহসিন মিয়াজী, এক্সিসটেন্স ট্রেড এজেন্সির মালিক মো. সালাহ উদ্দিন (সাকিব)। ফেন্সিফেয়ার করপোরেশনের মালিক মোহা. আব্দুল মজিদ খোকন, এপিক অ্যাবল ট্রেডার্সের মালিক মো. ইকবাল হোসেন, ফেমাস ট্রেডিং করপোরেশনের মালিক আরশাদুর রহমান চৌধুরী, প্রোপ্রাইটর জিনিয়াস ট্রেডিংয়ের মালিক মোহাম্মদ আবুল কালাম, গ্লোবাল ট্রেডিং করপোরেশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাশেদুল আলম, পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুস সবুর, ইনফিনিটি সিআর স্ট্রিপস লিমিটেডের চেয়ারম্যান ফারজানা বেগম এবং এমডি আব্দুল ওয়াহিদকে আসামি করা হয়। এছাড়া আরও আসামির তালিকায় ইনিফিনিটি সিআর স্ট্রিপস লিমিটেডের হিসাব পরিচালনাকারী মনতোষ চন্দ্র রায়, চেমন ইস্পাত লিমিটেডের পরিচালক মুহা. নজরুল ইসলাম, ওই প্রতিষ্ঠানের এমডি মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, আনছার এন্টারপ্রাইজের মালিক আনছারুল আলম চৌধুরী, রেইনবো করপোরেশনের মালিক রায়হান মাহমুদ চৌধুরী, গ্রিন এক্সপোজ ট্রেডার্সের মালিক এমএ মোনায়েম, সাফরান ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক মাহাফুজুল ইসলাম, মেসার্স শাহ আমানত ট্রেডার্সের মালিক মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী চৌধুরী, সোনালী ট্রেডার্সের মালিক সহিদুল আলম ও মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজের মালিক মোহাম্মদ গোলাম সরওয়ার চৌধুরীকেও আসামি করা হয়েছে। অপরদিকে ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে আসামিরা হলেন-ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুল মাওলা, সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ কায়সার আলী, কেকিউএম হাবিবুল্লাহ এবং সাবেক পরিচালক ও ইসি কমিটির চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন। এছাড়া ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি ও চিফ হিউম্যান রিসার্চ অফিসার মো. মোস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী, মোহাম্মদ আলী, মোহাম্মদ সাব্বির, মিফতাহ উদ্দিন, সাবেক ডিএমডি আবুল ফাইয়াজ মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন, সাবেক এসইভিপি ও এএমডি মো. আলতাফ হোসেন, এসইভিপি জি এম মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন কাদের, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের জুবিলী রোড শাখা প্রধান ও এসভিপি সোহেল আমান, ওই শাখার সাবেক প্রধান একজো শাহাদাৎ হোসেনকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় মেসার্স ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্সের মালিক মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া চৌধুরীকে সাপ্লাইয়ার হিসাবে দেখানো হয়। মূলত ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মালিক ও ব্যাংকের সর্বোচ্চ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে ঋণের নামে অর্থ আত্মসাৎ করেন। ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্সের অনুকূলে ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বরে ৮৯০ কোটি টাকা ঋণ সুবিধা গ্রহণ করলেও তার বিপরীতে কোনো মালামাল ক্রয় এবং বিক্রয় না করে বিভিন্ন জাল কাগজপত্র তৈরি করে। এরপর ওই টাকা উত্তোলন ও বিতরণ করে রূপান্তর, স্থানান্তর ও হস্তান্তরের মাধ্যমে অপরাধ গোপন করার চেষ্টা করা হয়েছে বলে মামলায় বলা হয়। অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিনিয়োগ সীমা ৮৯০ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি করে এক হাজার কোটি করা হয়। আর ২৮টি ডিল সাজিয়ে চক্রটি ২০২৩ সালের ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সর্বমোট ৯৯৫ উত্তোলন করে। এর আগে গত ১৯ ডিসেম্বর জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নিয়ে ১ হাজার ৯২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আহসানুল আলমসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। গত ২১ আগস্ট এস আলম গ্রুপের মালিক এস আলমের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগের তদন্ত শুরু করে দুদক। ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের জুবিলী ও খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। এই দুটি ঋণের বিষয়টিও অনুসন্ধান করছে দুদক।