চাপ প্রয়োগে বেনামি ঋণ ৩৮ হাজার কোটি টাকা

৭ জানুয়ারি, ২০২৫ | ৬:৫০ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক এখন পর্যন্ত ঋণ দিয়েছে ৬০ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা। এর মধ্য থেকে প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে এস আলম গ্রুপ, যা ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৬৩ শতাংশ। এর জন্য তিনি জামানত রেখেছেন মাত্র ৪ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকার সম্পদ, যা তার ঋণের মাত্র ১২ শতাংশ। ২৫৩টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের এই টাকা বের করা হয়। যার অধিকাংশই বেনামি, কাগুজে ও অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একজন পরিচালক নিজের প্রতিষ্ঠান থেকে খুব বেশি ঋণ নিতে পারেন না। শেয়ারের মাত্র ২৫ শতাংশ ঋণ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ কারণে কাগুজে, বেনামি ও নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ বের করে এস আলম গ্রুপ। সম্প্রতি ব্যাংকের ২৪টি শাখায় বিশেষ পরিদর্শন পরিচালনা করা হয়। খোদ ব্যাংক থেকেই গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যদের পরিদর্শন প্রতিবেদনে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য উঠে আসে। পরিদর্শনে বের হওয়া এস আলম গ্রুপের নামে-বেনামে ঋণের তালিকা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) পাঠানো হয়েছে। এ তালিকা হাতে এসে পৌঁছেছে। প্রাপ্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, মেসার্স এমডি তমিজউদ্দিনের নামে চলতি মূলধন খাতে ৫৬ কোটি টাকা। কোনো ধরনের জামানত ছাড়াই সাধারণ ‘কর্জ’ নামে আরও নেন ১৬৬ কোটি টাকা। দ্বিতীয় ঋণটি এখন খেলাপি। এমডি আহসান আজাদের নামে চলতি মূলধন খাতে ৩১ কোটি এবং কোনো ধরনের জামানত ছাড়াই সাধারণ কর্জ নামে আরও নেন ১৩১ কোটি টাকা। এখানেও দ্বিতীয় ঋণটি এখন খেলাপি। সোলাইমান এন্টারপ্রাইজের নামে ৮৮ কোটি টাকা জামানতের বিপরীতে ১৬০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। ইউনিভার্সাল মেডিকেয়ার লিমিটেডের নামে চলতি মূলধন বাবদ দেওয়া হয় ১ কোটি টাকা। আরমাডা স্পিনিং মিলসের নামে মাত্র ৯০ কোটি টাকা জামানত রেখে ৪৬৮ কোটি টাকা বের করা হয়েছে। এর মধ্যে খেলাপি ১৭৩ কোটি টাকা। গ্যালকো স্টিল লিমিটেডের নামে কোনো প্রকার জামানত ছাড়াই দেওয়া হয়েছে ২৫ কোটি টাকা। পুরোটাই খেলাপি। এছাড়াও সগো ইন্টারন্যাশনালসহ পাঁচ ব্যক্তিকে কোনো জামানত ছাড়াই দেওয়া হয় ৩ কোটি ২৩ লাখ টাকা। সিদ্দিক এন্টারপ্রাইজের নামে মাত্র ৪২ কোটি টাকা জামানতের বিপরীতে দেওয়া হয় ৩৭৮ কোটি টাকা। সানসাইন ট্রেডিং হাউজের নামে মাত্র ৪৪ কোটি জামানতের বিপরীতে দেওয়া হয়েছে ৩৮৬ কোটি টাকা। লাইফ লং ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নামে দেওয়া হয়েছে ৩৯০ কোটি, যেখানে জামানত মাত্র ৪৯ কোটি টাকা। ইন্ডিগো ট্রেডিং করপোরেশনের নামে দেওয়া হয়েছে ৩৮৭ কোটি টাকা। জামানত মাত্র ৫৩ কোটি টাকা। মেসার্স গ্রিন এক্সপোজ ট্রেডার্সের নামে ১০৬ কোটি জামানতের বিপরীতে দেওয়া হয়েছে ৪২৫ কোটি টাকা। ফেন্সিফেয়ার করপোরেশনকে ১০৫ কোটি টাকা জামানতের বিপরীতে ঋণ দেওয়া হয় ১১৩ কোটি টাকা। জেসমিন ট্রেডিং করপোরেশনের মাত্র ৫৩ কোটি টাকা জামানতের বিপরীতে ঋণ দেওয়া হয় ৩৭০ কোটি টাকা। চট্টগ্রামের বন্দর টিলা শাখার জিনিয়াস ট্রেডিং মাত্র ১ কোটি ৯৮ লাখ টাকা জামানত রেখে বের করে নিয়েছে ৪৫৯ কোটি টাকা। এ শাখা থেকে নামমাত্র জামানতে বের করে নেওয়া হয়েছে আরও প্রায় ১৮০০ কোটি টাকা। খাতুনগঞ্জ শাখার আনসার এন্টারপ্রাইজ, দুলারি এন্টারপ্রাইজ, মুসা এন্টারপ্রাইজ ও গিয়াস করপোরেশন-এ চার প্রতিষ্ঠানকে কোনো জামানত ছাড়াই দেওয়া হয় ১১২৭ কোটি টাকা। মহাখালী শাখায় ফার্স্ট কমিউনিকেশন লিমিটেড ৭৮ কোটি, ইসলাম ট্রেডার্স ২২৯ কোটি, জাসমির সুপার অয়েল ২৬২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এক টাকাও জামানত দেয়নি। আগ্রাবাদ শাখার হক এন্টারপ্রাইজ, কাজী ট্রেডার্স ও ইউনিটেক্স স্পিনিং জামানত ছাড়া নিয়েছে ৩২৪ কোটি টাকা। বনানী শাখায় কাজী এডিবল অয়েল দুবারে বের করেছে ১৩০ কোটি টাকা, নেই কোনো জামানত। চট্টগ্রামের প্রবর্তক মোড় শাখার শানঘু ভ্যালি কোল্ডস্টোরেজ ইন্ডাস্ট্রিজ, নেক্স-সোর্স লিমিটেড ও ওয়াক বিচ অ্যাপারেলস বায়িং-এই তিন প্রতিষ্ঠান নিয়েছে ৭ কোটি টাকা কোনো জামানত ছাড়াই। মতিঝিল শাখার টাইম সিকিউরিটিজ লিমিটেড ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের অনুকূলে দেওয়া হয় ১৯৩ কোটি টাকা, কোনো জামানত নেওয়া হয়নি। চট্টগ্রামের জুবিলী রোড শাখার ওপর পরিদর্শন শেষে পরিদর্শক দল উল্লেখ করে, শাখার ভাষ্যমতে সব বিনিয়োগ অর্থাৎ ঋণপ্রস্তাব ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের আসাদগঞ্জ অফিস থেকে উপস্থাপিত এবং তার ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) আকিজ উদ্দিনের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে অনুমোদন ও বিতরণ করা হয়। সব মিলে এসব ঋণের সুবিধাভোগী এস আলম নিজেই। একইভাবে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখার পরিদর্শক দল উল্লেখ করে, সংশ্লিষ্ট শাখা নির্বাহী ও কর্মকর্তাদের কাছ থেকে মৌখিকভাবে জানা যায়, এসব ঋণ এস আলম ভবন বল প্রয়োগ বা ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিয়েছে। ব্যাংক কর্মকর্তারা আরও জানান, এসব ঋণ নিয়েছে এস আলমের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কাগুজে কোম্পানি এবং এর সুবিধাভোগী তিনি নিজেই। একই ধরনের বক্তব্য পরিদর্শন হওয়া ২৪টি শাখার প্রায় সব শাখা থেকে এসেছে। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান বলেন, এটা ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রাথমিক তদন্ত। তবে প্রকৃত তদন্ত হবে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে ফরেনসিক তদন্ত, যা মাত্র শুরু হয়েছে। প্রসঙ্গত, সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সংকটে পড়া ছয় ব্যাংকের সম্পদের মান পর্যালোচনায় দুটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিষ্ঠান দুটি হলো আর্নেস্ট অ্যান্ড ইয়াং ও কেপিএমজি। এজন্য ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। এ নিরীক্ষায় অর্থায়ন করছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। যে ছয় ব্যাংকে নিরীক্ষা শুরু হবে সেগুলো হচ্ছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। সূত্রমতে, আর্নেস্ট অ্যান্ড ইয়াং নিরীক্ষা করবে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের সম্পদের মান। কেপিএমজি নিরীক্ষা করবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংকের সম্পদের মান। এর মধ্যে চারটি ব্যাংকের মালিকানা ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ এস আলম গ্রুপের হাতে। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।