গ্রামেই বেশি কোমল পানীয়ের প্লাস্টিক বোতল ব্যবহার
পানি, জুস কিংবা কোমল পানীয়তে তৃষ্ণা নিবারণ করা হয়। এতে বোতলের পানিই ভরসা। তবে প্রায় প্রতিটি বোতলই তৈরি প্লাস্টিক দিয়ে। ঘরে-বাইরে এখন সমানতালে ব্যবহৃত হচ্ছে প্লাস্টিকের বোতল। অথচ এই প্লাস্টিকের বোতল স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ডেকে আনছে দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি। এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গ্রামে পানির নানা উৎস থাকলেও প্লাস্টিকের বোতলের ব্যবহার বাড়ছে। শহরে পানির বোতল এবং গ্রামে কোমল পানীয়ের বোতল বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। গতকাল এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) ‘একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতলের পরিবেশগত প্রভাব: দূষণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি’ শীর্ষক প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বাংলাদেশের শহর-গ্রামে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতল ব্যবহারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে বছরে প্রায় ৩ দশমিক ১৫ থেকে ৩ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতল ব্যবহৃত হয়, যার মধ্যে মাত্র ২১ দশমিক ৪ শতাংশ রিসাইকেল হয়। বাকি ৭৮ দশমিক ৬ শতাংশ প্লাস্টিক বোতল নদী, সমুদ্র এবং ডাম্পিং স্টেশনে জমা হয়। ভোক্তাদের মধ্যে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতলের স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন শহরের মাত্র ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ এবং গ্রামের ৫ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ। শহরাঞ্চলের খুচরা বিক্রেতারা একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পানির বোতল বিক্রি করেন ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ এবং গ্রামের খুচরা বিক্রেতারা কোমল পানীয়ের বোতল বিক্রি করেন ৮৩ দশমিক ৩ শতাংশ। গবেষণার এই ফল এমন এক সময় প্রকাশ হয়েছে, যখন অন্তর্বর্তী সরকার পলিথিন ও সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার বন্ধে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। সার্বিকভাবে প্লাস্টিকের ব্যবহার একেবারে কমিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। গতকাল রাজধানীর লালমাটিয়ায় এসডো কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে গবেষণার তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী বর্জ্য সংগ্রহকারীদের মধ্যে মাত্র ৩ দশমিক ৪ শতাংশ একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতলের পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কে সচেতন। শহরাঞ্চলে ৯৩ শতাংশ বর্জ্য সংগ্রাহক অশিক্ষিত। ৮১ দশমিক ৭ শতাংশ বর্জ্য সংগ্রাহক একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতল ফের বিক্রি করার জন্য সংগ্রহ করেন এবং ৭ দশমিক ২ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করেন। শহর ও গ্রামে প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহারের চিত্র তুলে ধরে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের প্রায় ৮৩ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ প্রতিনিয়ত একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতল ব্যবহার করেন। প্রায় ৫১ শতাংশ শহরের ভোক্তা এবং ৪২ শতাংশ গ্রামীণ ভোক্তা প্লাস্টিক বোতল মাত্র একবার ব্যবহারের পর ফেলে দেন। অধিকাংশ ভোক্তা বোতল একাধিকবার ব্যবহার করেন। শহরে ৪৭ শতাংশ সপ্তাহে, ১৮ শতাংশ দৈনিক এবং গ্রামে ৩৯ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ সপ্তাহে প্লাস্টিক বোতল কেনেন। এর মধ্যে ২৫০ মিলির বোতল বেশি ব্যবহার হয়, যা শহরে ৩৪ শতাংশ এবং গ্রামে ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশ। শহরাঞ্চলে ২৫ শতাংশ বিক্রেতা প্রতিদিন ২১ থেকে ৩০টি একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতল বিক্রি করেন। আর গ্রামে একেকজন খুচরা বিক্রেতা বিক্রি করেন ১০ থেকে ২০টি বোতল। প্লাস্টিক বোতলের স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ক্ষতি তুলে ধরে গবেষণায় বলা হয়, একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতল ৪৫০ বছর পর্যন্ত পরিবেশে টিকে থাকে, যা পরবর্তীকালে পরিবেশ ও খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে মাইক্রোপ্লাস্টিক এবং বিষাক্ত রাসায়নিক ছড়ায়। প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে সাবেক সচিব এবং এসডোর চেয়ারপারসন সৈয়দ মার্গুব মোর্শেদ বলেন, প্লাস্টিক বর্জ্য কমানো, পুনর্ব্যবহারযোগ্য ব্যবস্থা উন্নত করা এবং প্রতিবেশ রক্ষায় সম্মিলিত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান এবং এসডোর সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার অধ্যাপক ড. মো. আবুল হাশেম বলেন, একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতলের পরিবেশগত এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি উপেক্ষা করা যায় না। মাইক্রোপ্লাস্টিকের মতো রাসায়নিক আমাদের খাদ্যচক্রে প্রবেশ করছে, যা মানব স্বাস্থ্য এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। এসডোর মহাসচিব ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। এ সংকট মোকাবিলায় নীতিনির্ধারক, ব্যবসায়ী এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে সহযোগিতা প্রয়োজন, যাতে টেকসই বিকল্প এবং দায়িত্বশীল ভোক্তা আচরণকে উৎসাহিত করা যায়। এসডোর নির্বাহী পরিচালক সিদ্দিকা সুলতানা বলেন, একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতলের সংকট মোকাবিলায় সচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রতিবেদনটির মাধ্যমে আমরা প্রতিটি স্তরে পদক্ষেপ গ্রহণে উৎসাহিত করতে চাই, যাতে পরিবেশবান্ধব সমাধান গ্রহণ, বর্জ্য সংগ্রহকারীদের সহায়তা এবং পরিবেশ ও স্বাস্থ্য রক্ষায় কঠোর নীতি প্রয়োগ করা যায়।