নিয়োগ বাণিজ্যের সিন্ডিকেটে সাবেক মেয়রসহ অনেকে

২০ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ৭:৩৯ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

মাস্টার রোলে সিলেট সিটি করপোরেশনে (সিসিক) চাকরি নিয়ে বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না নগর ভবনের। ২০০২ সালে পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়ার পর গত ২২ বছরে মাস্টার রোলে চাকরি দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৪৫০ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে, যা নগর ভবনে চাকরিরতদের ৮০ শতাংশ। ২২ বছরে মাস্টার রোল বা অস্থায়ী ভিত্তিতে চাকরি পাওয়াদের কেউ হয়েছেন স্থায়ী, আবার কেউ হারিয়েছেন চাকরি। প্রত্যেক মেয়রের মেয়াদে এসব মাস্টার রোলে চাকরির বিপরীতে নেওয়া হয়েছে লাখ লাখ টাকা। ব্যক্তিবিশেষ ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়েছে নিয়োগ বাণিজ্য। সম্প্রতি মাস্টার রোলে নিয়োগ পাওয়া ১৭৫ জনের মধ্যে ৪৪ জন চাকরি হারিয়েছেন। তাদের নিয়োগে মেয়রের অনুমোদন না থাকায় তা বাতিল করা হয় বলে জানা গেছে। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে– মাস্টার রোলে চাকরিদাতাদের পেছনে কারা? এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে জানতে পেরেছে, প্রত্যেক মেয়রের আমলে মেয়র, তাদের ব্যক্তিগত সহকারী, পছন্দের লোক ও নগর ভবনের একটি সিন্ডিকেট মাস্টার রোলে চাকরি নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। পদ নেই, কাজ নেই; তবু প্রতিবছর অস্থায়ী ভিত্তিতে লোক নিয়োগ দেয় নগর ভবন। সরকার পতনের পর ব্যয়ে স্বচ্ছতা দেখাতে মাস্টার রোলে চাকরিরত ১ হাজার ৪৫০ জনের তালিকা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সর্বশেষ নিয়োগে সিসিকে কর্মচারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮০৬-এ। কোনো মেয়রই স্থায়ী নিয়োগের উদ্যোগ না নেওয়ায় মামলা করে ৩১৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী স্থায়ী হয়েছেন। সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়ার সময় প্রথম মনোনীত মেয়র ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক পৌর চেয়ারম্যান বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। পরে তিনি টানা দুইবার মেয়র নির্বাচিত হন। তাঁর সময়ে মাস্টার রোলে নিয়োগ দেওয়া হয় ৪৫০ জনকে। ২০১৩ ও ২০১৮ সালে পর পর দুই মেয়াদে মেয়র নির্বাচিত হন বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী। তাঁর সময়ে মাস্টার রোলে নিয়োগ দেওয়া হয় ৬০০ থেকে ৭০০ জনকে। সর্বশেষ গত বছরের ২১ জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী মেয়র হয়ে ৯ মাসে নিয়োগ দেন ১৭৫ জনকে। এর মধ্যে গত ২১ আগস্ট ৪৪ জনকে ছাঁটাই করা হয়েছে। যাদের নিয়োগের অনুমোদন ছিল না মেয়রের। এত সংখ্যক লোক আর কোনো মেয়রের আমলে অল্প সময়ে নিয়োগ হয়নি। অভিযোগ উঠেছে, মেয়রের ব্যক্তিগত সহকারী সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শহিদ চৌধুরীসহ কয়েকজন মাস্টার রোলে নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মচারী জানান, তারা দৈনিক ৫০০ টাকা মজুরি ভিত্তিতে চাকরি পান। কয়েক মাস বেতনও পেয়েছেন। একজন ২ লাখ, আরেকজন দেড় লাখ টাকা দেন বলে দাবি করেন। এ বিষয়ে যুক্তরাজ্য থেকে মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী জানান, চাহিদার কারণে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের হস্তক্ষেপকে অবৈধ বলে দাবি করেন তিনি। নগর ভবনের সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রত্যেক মেয়রের সময়ে তাদের আস্থাভাজন ছাড়াও পিএস, এপিএস ও নগর ভবনের একটি সিন্ডিকেট নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা সুযোগ বুঝে লোক নিয়োগ দেন। এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, অনেক পরিবারের ২ থেকে ৪ জন চাকরি করছেন। আবার অনেকের ৫-৭ জন আত্মীয় চাকরি করছেন। সাবেক মেয়র আরিফ দুই মেয়াদে ৬০০ থেকে ৭০০ লোক নিয়োগ দিলেও তিনি দাবি করেন, তাঁর সময়ে শ-দেড়েক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩৫ জন চাকরি ছেড়ে দেন দাবি করে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না থাকায় প্রয়োজনে বারবার মাস্টার রোলে নিয়োগ দিতে হয়। অতিরিক্ত নিয়োগের কারণে সিসিকের অনেক বিভাগে বসার স্থান পান না কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এমনকি কাজও নেই অনেকের। এর মধ্যে রয়েছে প্রকৌশল শাখা। একজন উপবিভাগীয় প্রকৌশলী তিনটি ওয়ার্ডের দায়িত্ব পালন করার ক্ষমতা থাকলেও প্রকৌশলী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে প্রতিটি ওয়ার্ডে। একইভাবে পানি শাখা, ট্যাক্স, বর্জ্য, বিদ্যুৎ ও পরিবহন শাখায় রয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় ১৫ ভাগ বেশি জনবল। বর্তমানে নগর ভবনে ১ হাজার ৮০৬ জনের মধ্যে স্থায়ী ৩৫৬ জন এবং মাস্টার রোলে ১ হাজার ৪৫০ জন কর্মরত। মাস্টার রোলে নিয়োগপ্রাপ্তদের তালিকা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হবে বলে জানিয়েছেন সিসিকের সচিব আশিক নুর। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় তালিকা চায়নি; সিসিকের পক্ষ থেকে প্রেরণ করা হচ্ছে। প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান বলেন, গত ২২ বছরে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কোনো নিয়োগ হয়নি, সব মাস্টার রোলে। অনেক ক্ষেত্রে বেশিও নিয়োগ দেওয়া হয়। স্থায়ী চাকরি না থাকায় কেউ কেউ ছেড়েও দেন। অনেক শাখায় অতিরিক্ত লোক রয়েছে স্বীকার করে তিনি জানান, প্রস্তাবিত নিয়োগ কাঠামোতে আড়াই হাজার জনবলের হিসাবে দেওয়া হয়েছে। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাই রাফিন সরকার বলেন, মাস্টার রোলে চাকরি নিয়ে নানা সময় সমস্যার সৃষ্টি হয়। তাদের স্থায়ীকরণ নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি পরিষদের সভায় আলোচনা হয়েছে। চাকরিরতদের সংখ্যা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে হয়। সে কারণে তালিকা পাঠানো হচ্ছে।