বিজয়ের মাসে অবমূল্যায়ন ও হেনস্তা শিকার মুক্তিযোদ্ধারা
১২ নভেম্বর শহিদ নূর হোসেন দিবস এবং ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ও তাঁদের প্রতি অবহেলার একটি নতুন দৃষ্টান্ত দেখা যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতার মূলমন্ত্রকে ভুলিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা এবং বিজয়ের মাসে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অবিচারের ঘটনা সমাজে এক ধরণের অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। গণপিটুনির শিকার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমান: গত ১২ নভেম্বর, বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়ার পর গণপিটুনির শিকার হন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমান। তাকে পরে সিরাজগঞ্জের একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। এই ঘটনাটি দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবোধের অবমূল্যায়নের চিত্র ফুটিয়ে তোলে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যদি অমনোযোগিতার শিকার হয়, তাহলে দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসও খণ্ডিত হতে পারে। এটি নিঃসন্দেহে একটি দুঃখজনক ঘটনা, যেখানে একটি নিরীহ মুক্তিযোদ্ধাকে শিকার হতে হয়। বিএনপি নেতা শাওন মোল্লার আক্রমণ: এছাড়া, গত ৮ সেপ্টেম্বর বরগুনা জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মাহবুবুল আলমের ছেলে শাওন মোল্লা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য আবদুর রশিদ মিয়াকে গালিগালাজ ও হেনস্তা করেন। এই ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে অনেকেই এটি ‘নিন্দনীয়' বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু এই ঘটনায় এখনও পর্যন্ত কোনও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এটি গণতান্ত্রিক পরিবেশে যে রাজনৈতিক সহিষ্ণুতার অভাব রয়েছে, তার একটি ইঙ্গিত। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান এবং বর্তমান পরিস্থিতি: বীর মুক্তিযোদ্ধারা আজও তাঁদের সম্মান ও অধিকার পাচ্ছেন না। একাত্তর মুক্তিযুদ্ধের জন্য যারা জীবন দিয়েছেন, তাদের যথাযথ সম্মান পাওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সরকারের সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে উঠেছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইদ আহমেদ রাজা জানান, শাহরিয়ার কবীরের মতো জাতীয় পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিরও সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা হচ্ছে না, এমনকি তার জন্য আদালতের নির্দেশনা থেকেও কোনও সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারের পদক্ষেপ: গণতান্ত্রিক পদক্ষেপ হিসেবে বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নানা ধরনের পরিকল্পনা নিয়েছে। তবে এটি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় একাধিক সমস্যা দেখা যাচ্ছে। বিজয়ের মাসে সরকার বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় বিজয় মেলা আয়োজন করছে, যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এই মেলাগুলোর মাধ্যমে জনগণকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনার সাথে পরিচিত করা সম্ভব হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা এবং সরকারের পরিকল্পনা: এবার বিজয় দিবসে সারা দেশে বিজয় মেলার আয়োজন করা হয়েছে, যা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানানো এবং জাতীয় ইতিহাসের সঙ্গে জনগণকে আরও নিবিড়ভাবে সংযুক্ত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। তবে, সরকারের উচিত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি বিশেষ কমিশন গঠন করা, যাতে তাদের সঠিক তালিকা এবং অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া যায়। এর মাধ্যমে বীর মুক্তিযোদ্ধারা যেন সম্মানিত হন এবং তাঁদের ত্যাগের যথাযথ মূল্যায়ন হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবমূল্যায়ন ও তাঁদের প্রতি সরকারী অবহেলা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও জাতীয় ঐতিহ্যের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিজয়ের মাসে তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা বজায় রাখার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান এবং তাঁদের অবদান সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে না পারলে, জাতি কখনও তার সত্যিকার স্বাধীনতার মর্ম বুঝতে পারবে না।