সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সত্যতা ১৩৫টিতে
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতনের দিন ৫ আগস্ট রাজধানীর রাজারবাগের পানির পাম্প এলাকায় ঝন্টু চন্দ্র দাসের তিনটি দোকানে হামলা হয় বলে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে। ঝন্টু দাস জানান, স্থানীয় বিএনপি নেতা পবন চন্দ্র দাস এবং তাঁর সহযোগী গুরু চন্দ্র দাস হামলা করিয়ে দোকান দখল করে নিয়েছেন। দুই দফায় ২৪ হাজার টাকা নিয়েছেন। পূজার চাঁদার কথা বলে অক্টোবরে আরও ৫ হাজার টাকা নিয়েছেন। সবুজবাগ থানা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি পবন চন্দ্র এ অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, ঝন্টু ৭৩ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের আহ্বায়ক ছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে সে আমাকে পুলিশের হাতে দেয়। ৯০ দিন জেলে ছিলাম। প্রতি মাসে তাঁর দুই দোকানের ভাড়া বাবদ ১৩ হাজার টাকা বুঝিয়ে দিচ্ছি। সাম্প্রদায়িক রং দিয়ে ফায়দা নিতে চাচ্ছে। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ ৪ থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার যে পরিসংখ্যান তৈরি করেছে, এমন অনেক বিরোধকে হামলা আখ্যা দেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনার পতনের পর আওয়ামী লীগের হিন্দু নেতাকর্মীর বাড়িঘরে হামলাকেও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বলা হয়েছে। যদিও ক্ষমতাচ্যুত দলের আক্রান্ত মুসলমান নেতাকর্মীর নাম নেই তালিকায়। ঐক্য পরিষদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ওই সময়ে ২ হাজার ১০টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। বাড়িঘর ভাঙচুর, লুট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে ৯১৫টি। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, লুট, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে ৯৫৩টি। ২১ জেলার ৯৮১ অভিযোগের ২৯৬টির তথ্যানুসন্ধান কর ১৩৫টিতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সত্যতা পেয়েছে। মন্দির দখল, হামলাসহ ৩৮ অভিযোগের সত্যতা মেলেনি। বাকি ১২৩ ঘটনা রাজনৈতিক বিরোধে হয়েছে। আক্রান্তরা আওয়ামী লীগের পদধারী নেতা। ঐক্য পরিষদের পরিসংখ্যানকে ভারতীয় গণমাধ্যম ছাড়াও অন্যান্য দেশেও প্রচার করা হচ্ছে। ১৪২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনের শুরুতেই রাজধানীতে পাঁচটি ‘সহিংসতার’ বর্ণনা রয়েছে। দুটির অনুসন্ধান করে একটির সত্যতা পেয়েছে। ১২২ পৃষ্ঠায় ময়মনসিংহের ত্রিশালের ধলাবাজারে সাত হিন্দুর দোকান পোড়ানো, লুটপাট ও ভাঙচুরের অভিযোগ করা হয়েছে। একই আগুনে সাতজন মুসলমান মালিকের দোকান পুড়লেও তাদের নাম নেই তালিকায়। স্থানীয় এবং দোকান মালিকরা জানিয়েছেন, শর্টসার্কিট থেকে আগুন লেগেছিল। ত্রিশাল পুলিশ এবং ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যুতের তার থেকে আগুন লাগে। ক্ষতিপূরণ চেয়ে ত্রিশালের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আবেদনও করা হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ব্যাখ্যা কী, তা ঐক্য পরিষদের তথ্য সংগ্রহ ও মনিটরিং সেলের সদস্য সচিব মনীন্দ্র কুমার নাথের কাছে জানতে চেয়েছিল। একজন ধর্মীয় সংখ্যালঘু কোনো কারণে আক্রান্ত হলেই তা সহিংসতা হিসেবে গণ্য হবে কিনা– প্রশ্নে তিনি বলেন, হিন্দু এবং হিন্দুর মারামারি তো সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নয়। ৫ আগস্টের পর সংখ্যালঘু নিপীড়ন হয়েছে, এতে তো ভুল নেই। ২০ আগস্টের পরও শতাধিক ঘটনা ঘটেছে। ২৯৬ ঘটনার বিশ্লেষণে ১৩৫টির সত্যতা পেয়েছে– এ তথ্যের বিষয়ে মনীন্দ্র কুমার বলেন, ‘বাকিগুলোকে রাজনৈতিক সংঘর্ষ বলা ঠিক হচ্ছে না। একজন সংখ্যালঘু আওয়ামী লীগ করলেই তাঁর ওপর হামলা হবে কেন?’ আওয়ামী লীগের আক্রান্ত মুসলমান নেতাকর্মীর নাম তালিকায় নেই কেন? হিন্দু নেতাকর্মী আক্রান্ত হওয়াই কী সংখ্যালঘু নির্যাতন– এসব প্রশ্নে মনীন্দ্র কুমার বলেন, ‘সরকার তদন্ত করুক। একটি সাম্প্রদায়িক সহিংসতাও তো গ্রহণযোগ্য নয়।’ ঐক্য পরিষদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পঞ্চগড়ে ৮৭টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ১০টি ঘটনার অনুসন্ধান করেছে। পঞ্চগড় প্রতিনিধি জানিয়েছেন, আক্রান্তরা সবাই আওয়ামী লীগ পদধারী নেতা। বোদা উপজেলার ময়দানদীঘি এলাকার সুশীল চন্দ্র সাধুর বাড়িতে হামলা দাবি করা হলেও তা ঘটেনি। স্থানীয়দের প্রতিরোধে হামলাকারী পিছু হটে। আবার কিছু প্রকৃত হামলার ঘটনা তালিকায় আসেনি। যেমন, ময়দানদীঘি এলাকার ধনেশ চন্দ্র শর্মার বাড়িতে ৫ আগস্ট আগুন দেওয়া হয়। সুশীল চন্দ্র সাধু বলেন, তালিকায় কীভাবে আমার নাম এসেছে জানি না। পঞ্চগড় শহরের জালাসীপাড়া এলাকার আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিপেন চন্দ্র রায়ের বাড়িতে হামলা হলেও লুটপাট হয়নি। তাঁর নাম রয়েছে ঐক্য পরিষদের তালিকায়। জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল কুমার রায় বলেন, তালিকার বিষয়ে কিছুই বলতে পারব না। ঐক্য পরিষদের তালিকা অনুযায়ী লালমনিরহাটে ৪৪টি হামলা হয়েছে। ১০টি ঘটনা অনুসন্ধান করেছে। সবক’টিই আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি। তাদের নাম আক্রান্ত সংখ্যালঘু হিসেবে রয়েছে তালিকায়। বগুড়ায় ৪২টি ঘটনা রয়েছে তালিকায়। সব অনুসন্ধান করে ২৯ ঘটনার সত্যতা পেয়েছে। বগুড়া ব্যুরো জানায়, শেরপুর উপজেলায় যে ছয়টি হামলা ও লুটপাটের ঘটনা দাবি করা হয়েছে, এর মধ্যে শাহবন্দেগী ইউনিয়নে চকদেউলী গ্রামের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ৩ লাখ টাকা লুট ও মন্দির ভাঙচুর, জমি দখলের অভিযোগ সঠিক নয়। স্থানীয় বাসিন্দা বাসুদেব ও কার্তিকের মধ্যে ১৫ শতক জমি নিয়ে বিরোধে দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয় ৬ আগস্ট। এ নিয়ে সালিশে উপস্থিত সাবেক কাউন্সিলর নিমাই ঘোষ বলেন, হিন্দুদের নিজেদের মধ্যে মন্দিরের জমি নিয়ে বিরোধ ছিল। কেউ হামলা করেনি। চট্টগ্রামের ১৩ ঘটনার সবক’টির অনুসন্ধান করে দুটির সত্যতা পেয়েছে । চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, এর একটি জমির বিরোধ। পূর্ব নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটি রোডের ভজহরিপাড়ায় রঞ্জিত দেবনাথ, দিলীপ কুমার দেবনাথ ও সাধন চন্দ্র দেবনাথ নামে তিন ভাইয়ের ৩০ শতক জমি রয়েছে। এ জমি সাধন চন্দ্র দেবনাথের মেয়েদের দখলে রয়েছে। তাদের একজন সুমিতা দেবনাথ জানান, ২০১৫ সালে তাঁর দুই কাকা জমি বিক্রির জন্য জাকির হোসেন নামে এক ব্যক্তির কাছে তিন মাস মেয়াদি বায়না দলিল করে। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে প্রায় ১০ বছর পর এসে ৭ আগস্ট জাকির জমি দখলের চেষ্টা করেন। আমাদের বাবা-কাকারা জমি বণ্টন করেননি। এ নিয়ে আদালতে মামলা রয়েছে। মামলা চলাকালে জমি বেচাকেনার সুযোগ নেই। নগরীর আকবর শাহ থানার বাপ্পী দাসের বাড়িতে হামলার সত্যতা মেলেনি। বাপ্পী দাস চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহবায়ক জহুরুল আল জসিমের অনুসারী। বাপ্পীর বিরুদ্ধে পাঞ্জাবি লেনে মাদক কারবার, জমি দখল, বিরোধী মতের লোকজনকে মামলা দিয়ে হয়রানিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়াদের পুলিশে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। আকবর শাহ থানা বিএনপির সভাপতি আবদুস সাত্তার সেলিম বলেন, বাপ্পী ছেলেটা চিহ্নিত অপরাধী। শুধু বিএনপি নয়, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকেও অত্যাচার করেছে। ৫ আগস্টের পর ভাড়া বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে, মামলা হয়নি। নাটোরের ৪৩ ঘটনার পর মধ্যে সিংড়ার মন্দির দখলের অভিযোগ অনুসন্ধান করে সত্যতা পায়নি । নাটোর প্রতিনিধি জানান, বিএনপি নেতা জিয়াউর বলেছেন, মন্দিরের জায়গা দখল হয়নি। সামনের জায়গায় আওয়ামী লীগ কর্মী আড্ডা দিত। তা মুক্ত করা হয়েছে। নীলফামারী প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ২৩ অভিযোগে দুটি অনুসন্ধানে সত্যতা মেলেনি। হিন্দু বৌদ্ধ খিষ্টান কল্যাণ ফ্রন্টের জেলা কমিটির আহ্বায়ক সুমিত কুমার আগারওয়ালা নিক্কি বলেন, আক্রান্ত সবাই আওয়ামী লীগের। চান্দিয়ার ডাঙ্গা মন্দিরে হামলার অভিযোগ মিথ্যা। মামলা চলছে, স্থানীয়ভাবে সমাধানের পর এবার দুর্গাপূজাও হয়েছে। ঐক্য পরিষদের তালিকায় ৪৩ নম্বরে রয়েছে সৈয়দপুরের রঞ্জন সরকারের নাম। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। ৫ আগস্ট তাঁর সৈয়দপুর মার্কেটে রঞ্জন চালভান্ডার ও হোটেল হামলা ও লুটপাট হয়। বরিশাল বিভাগে ৭৩ অভিযোগের ১২টি অনুসন্ধান করে ৫টিতে সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের সত্যতা মিলেছে। বাকি আক্রান্তরা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। যশোরের মনিরামপুরের ২১ ঘটনার ১৮টি অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আক্রান্তরা সবাই আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী। বাঘারপাড়ায় ৬৪ ঘটনার ১৮টি অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শুধু হিন্দু হওয়ায় তারা আক্রান্ত হয়েছেন। অভয়নগরের ২৬ ঘটনার সবক’টি অনুসন্ধানে ১৯টির সত্যতা মিলেছে। সবচেয়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার অভিযোগ সাতক্ষীরায়, ২৮৩টি। ২১টি অনুসন্ধান করে, ১৮টির সত্যতা পেয়েছে। বাকিগুলোর সত্যতা মেলেনি কিংবা আক্রান্ত হয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী। নড়াইলে ৩২ অভিযোগের ৮টি অনুসন্ধানে সাতটির সত্যতা মিলেছে। মাগুরায় ৬৫ ঘটনার ২০টি অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আক্রান্ত ১০ জনই আওয়ামী লীগ নেতা। সাবেক এমপি সাইফুজ্জামান শিখরের অনুসারী বা ব্যবসায়িক অংশীদার।