‘রেশমি রাস্তা’য় কাঁটা বিছোনোর ছক!

৫ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ৮:০৮ অপরাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

কথায় আছে, ‘সমস্ত রাস্তাই রোমে গিয়েছে’। এ বার তেমনই একটা বাণিজ্যপথ তৈরিতে মন দিয়েছে ভারত। ভূমধ্যসাগরের কোলের ‘সিসারের দেশ’-এ গিয়ে মেশা ওই রাস্তায় পোশাকি নাম ‘কটন রুট’। চালবাজ চিনের ‘সিল্ক রুট’-এর গলা চেপে ধরতেই যে নয়াদিল্লির এই পরিকল্পনা, ইতিমধ্যেই তা স্পষ্ট করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা। সালটা ২০১৫। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মাত্র এক বছরের মাথায় বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ে একটি বিশেষ সিদ্ধান্ত নেন নরেন্দ্র মোদী। প্রাচীন ভারতীয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপথগুলি পুনরায় চালু করা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেন তিনি। এর পরই কটন রুট পুনরুজ্জীবন নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেন দিল্লির পদস্থ কর্তারা। অন্য দিকে, ২০১৩ সালে সিল্ক রুট প্রকল্পের ঘোষণা করেন ড্রাগন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। উদ্দেশ্য, পরিকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকার সঙ্গে সরাসরি বেজিংয়ের যোগাযোগ স্থাপন। বিশেষজ্ঞদের দাবি, খাতায়কলমে এ সব লেখা থাকলেও মূলত এর মাধ্যমে চিনকেন্দ্রিক বাণিজ্য বিস্তারের স্বপ্নই দেখে চলেছেন শি। সিল্ক রুট বাস্তবায়িত করতে ২০১৩ সাল থেকে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই) প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ড্রাগনল্যান্ড। এরই আওতাভুক্ত ‘চিন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর’ (সিপিইসি)। বলা বাহুল্য, সিল্ক রুটের মাধ্যমে বাণিজ্যের পাশাপাশি আমেরিকাকে সরিয়ে দুনিয়া জুড়ে প্রভুত্ব কায়েমের সুপ্ত বাসনাও রয়েছে বেজিংয়ের। ড্রাগনের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষার আঁচ পেতে নয়াদিল্লির বেশি দিন সময় লাগেনি। ফলে সিল্ক রুটের পাল্টা কটন রুটের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। ২০১৬ সালে এই প্রকল্পের নীল নকশা তৈরি করে ফেলে কেন্দ্র। ২০২৩ সালের জি-২০ সম্মেলনের পর এর কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে কোমর বেঁধেছে মোদী সরকার। ইতিহাসবিদদের দাবি, খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দী থেকে উন্নত মানের তুলো মধ্য এশিয়া, লোহিত সাগরের তীরের বন্দর এবং ইউরোপে রফতানি করে আসছে ভারত। প্রাচীন যুগে যে রাস্তায় এই বাণিজ্য হত, তারই নাম কটন রুট। কালের গর্ভে চাপা পড়ে যাওয়া প্রাচীন সেই পথ পুনরুজ্জীবনের ক্ষেত্রে ইটালিকে পাশে পেয়েছে নয়াদিল্লি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রকের এক পদস্থ কর্তার কথায়, ‘‘চিনের সিল্ক রুটের সঙ্গে আমাদের কটন রুটের বেশ কিছু মূলগত পার্থক্য রয়েছে। প্রথমত, এর মাধ্যমে আমরা পশ্চিম এশিয়া এবং ইউরোপের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে চাইছি। দ্বিতীয়ত, দুই দেশের বাণিজ্যিক স্বার্থ পূরণ করাই আমাদের উদ্দেশ্য, প্রভুত্ব কায়েম নয়।’’ নয়াদিল্লির এই পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়েছে সিজ়ারের দেশ। ভারতকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) তৃতীয় বাণিজ্যিক অংশীদার হিসাবে দেখতে চাইছে ইটালি। আর তাতে কটন রুট ‘গেম চেঞ্জার’-এর ভূমিকা নেবে বলে মনে করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে সরাসরি ভুমধ্যসাগর হয়ে ‘ইউরোপের প্রবেশদ্বার’ রোমে পৌঁছবে ভারতীয় পণ্যে ঠাসা জাহাজ। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতো উপসাগরীয় দেশ এবং পশ্চিম এশিয়া হয়ে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত ভারতের এই কটন রুটে রয়েছে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। এর মধ্যে অন্যতম হল ইরানের চাবাহার। পারস্য উপসাগরের এই সমুদ্র বন্দরটির নির্মাণে নয়াদিল্লির বিশেষ হাত রয়েছে। এ ছাড়া কটন রুটে মিলবে রেল পরিষেবাও। কটন রুটের পথে থাকা দেশগুলির সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করতে সমুদ্রের গভীরে তার বিছোনো ও ডেটা পাইপলাইন তৈরির পরিকল্পনাও রয়েছে নয়াদিল্লির। এই প্রকল্পে ইজ়রায়েলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে। চিনের সিল্ক রুটে আবার পাকিস্তানের গ্বদর, শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা ও আফ্রিকার জিবুতি সমুদ্র বন্দর রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রকের পদস্থ কর্তা জানিয়েছেন, ‘‘কটন রুট বিস্তারের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। তবে প্রাথমিক ভাবে আমরা ইটালিকে পাখির চোখ করে এগোচ্ছি। পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি, সবুজ হাইড্রোজেন পাইপলাইন এবং বন্দর পরিকাঠামোর উন্নতির দিকে আপাতত নজর দেওয়া হচ্ছে।’’ ভারত-ইটালি প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের বাণিজ্যের দিকেও নজর রয়েছে সকলের। এ প্রসঙ্গে মুখ খুলেছেন ইটালির শিল্পমন্ত্রী অ্যাডলফো উরসো। সংবাদ সংস্থা ‘ব্লুমবার্গ’কে তিনি বলেছেন, ‘‘সমুদ্র বন্দরের পরিকাঠামো উন্নতির পাশাপাশি নয়াদিল্লির সঙ্গে জাহাজ এবং ইয়ট নির্মাণ নিয়েও কথা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে বিপুল লগ্নির ব্যাপারে উৎসাহ দেখিয়েছে তারা।’’ কটন রুটে দুই দেশই আর্থিক দিক থেকে লাভবান হবেন বলে স্পষ্ট করেছেন তিনি। বর্তমানে মহাকাশ গবেষণা, সাইবার নিরাপত্তা ও ডুবোজাহাজের প্রযুক্তি ভারতের থেকে পেতে চাইছে রোম। শিল্পক্ষেত্রে উন্নতির জন্য ‘মেড ইন ইটালি ২০৩০’ প্রকল্পের সূচনা করেছেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি। ভারতের কটন রুট সেই স্বপ্নপূরণের ক্ষেত্রে সহায়ক হবে বলে মনে করেন তিনি। ২০২৩ সালে কটন রুটের নীল নকশা জি-২০ ভুক্ত দেশগুলির সামনে রাখে ভারত। তখনই ‘ভারত-পশ্চিম এশিয়া-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডোর’ নির্মাণের সম্মতি মেলে। এর মাধ্যমে ইটালি ছাড়াও ফ্রান্স এবং জার্মানিতে সহজে পণ্য পাঠাতে পারবে নয়াদিল্লি। যদিও ওই বছরের অক্টোবরেই পশ্চিম এশিয়ায় ইজ়রায়েল-হামাস যুদ্ধ বাধায় থমকেছে এর কাজ। অন্য দিকে, ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে পূর্ব ইউরোপে চলছে রাশিয়া এবং ইউক্রেন যুদ্ধ। এ প্রসঙ্গে ইটালীয় শিল্পমন্ত্রী উরসো বলেছেন, ‘‘যুদ্ধ সব সময়ে আমাদের ঘিরে রেখেছে। ফলে মহাদেশীয় রাস্তাগুলিতে বাণিজ্য চালানো বেশ কঠিন হচ্ছে। আমরা সুয়েজ খালের বিকল্প পথ হিসাবে এই পথ ব্যবহার করতে চাই।’’ ভারত-পশ্চিম এশিয়া-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডোর নির্মাণের ক্ষেত্রে বিপুল অর্থ ব্যয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আমেরিকা। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এতে কতটা উৎসাহ দেখাবেন? ইটালির শিল্পমন্ত্রীর মতে, ‘‘কটন রুটে ইউরোপের পাশাপাশি আমেরিকার স্বার্থও লুকিয়ে রয়েছে। ফলে ট্রাম্প মুখ ঘুরিয়ে থাকবেন বলে মনে করছি না।’’ কেন্দ্রীয় জাহাজ, বন্দর এবং জলপথমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনওয়াল জানিয়েছেন, সমুদ্র বাণিজ্য বৃদ্ধির ব্যাপারে ইটালির সঙ্গে কথা হয়েছে। তবে সেটা আনুষ্ঠানিক আলোচনা নয়। আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করছি। সমুদ্র এবং মহাকাশ দু’টি জায়গাতেই অংশীদারি বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে আমাদের। উল্লেখ্য, গুজরাতের লোথালে ‘ন্যাশনাল মেরিটাইম হেরিটেজ কমপ্লেক্স’ তৈরি করেছে ভারত। সেখানে সহযোগিতার জন্য ইটালির জাদুঘরগুলিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে নয়াদিল্লি। সূত্রের খবর, ওই হেরিটেজ কমপ্লেক্স নির্মাণে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা খরচ করবে মোদী সরকার। ইতিমধ্যেই এর অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ভূমধ্যসাগর ও ইন্দো প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় একই রকমের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় নয়াদিল্লি ও রোম। এই দুই সাগরকে জুড়বে কটন রুট। ‘ইস্ট এশিয়া ফোরাম’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই রাস্তায় ৪৭ লক্ষ কোটি ডলারের জিডিপির সমতুল্য বাণিজ্যের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। চিনের সিল্ক রুটের কাজ অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। তবে যে দেশগুলিতে বিআরআই প্রকল্প চলছে, সেগুলির অধিকাংশই ঋণে ডুবে রয়েছে। সেখানে কটন রুট আর্থিক দিক থেকে উন্নত দেশগুলির সহযোগিতায় আত্মপ্রকাশ করবে। এতে পুরোপুরি বাণিজ্য শুরু হলে, বেজিংয়ের কপালে যে চিন্তার ভাঁজ ফেলবে, তা নিয়ে নিশ্চিত বিশেষজ্ঞদের একাংশ। সূত্র: আনন্দবাজার