বিএনপি নেতাও আসামি, কেন্দ্র দখল করে লাঙ্গলে সিল নৌকার প্রার্থীর!
কেন্দ্র দখলের পর প্রতিদ্বন্দ্বী সব প্রার্থী এক হয়ে সিল মেরেছেন লাঙ্গল প্রতীকে। এমনকি তখনকার এমপি, নৌকার প্রার্থীও আছেন এই তালিকায়। এমনই এক অভিযোগে মামলা হয়েছে বরিশালের বাবুগঞ্জ থানায়। কেবল আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি আর ওয়ার্কার্স পার্টিই নয়, পদধারী নেতাসহ বিএনপি কর্মীদেরও আসামি করা হয়েছে মামলায়। বিষয়টি নিয়ে বাবুগঞ্জে এখন তোলপাড় চলছে। মামলাটি যিনি করেছেন তার বাড়ি ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে অন্য ইউনিয়নে। ৫ সাক্ষীর ৪ জনের বাড়িও অন্য এলাকায়। প্রাথমিক তদন্ত ছাড়াই কি করে এরকম অদ্ভুত একটি মামলা রেকর্ড হলো সেই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি বাবুগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ আমিনুল ইসলাম। মামলার বাদী দেহেরগতি ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন হেমায়েতও দিতে পারেননি কোনো প্রশ্নের উত্তর। আর মামলার বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানিয়েছেন উপজেলা বিএনপির নেতারা। ২১ নভেম্বর মামলাটি হয় বাবুগঞ্জ থানায়। বর্তমানে জেলহাজতে থাকা জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি, দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপুকে করা হয়েছে ১নং আসামি। অন্যদের মধ্যে আছেন বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদী) আসনের সাবেক এমপি ওয়ার্কার্স পার্টি নেতা শেখ মো. টিপু সুলতান এবং ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে ভোটযুদ্ধে নামা যুবমৈত্রীর তৎকালীন কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি আতিকুর রহমান। এ ছাড়া অন্য ৮ আসামির মধ্যে ১ জন বিএনপির পদধারী এবং অন্যরা আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নেতাকর্মী। ১১ আসামির নাম উল্লেখের পাশাপাশি আরও দেড়শ জন ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল দাবি করা হয়েছে মামলায়। বাদী আনোয়ার হোসেন হেমায়েত তার অভিযোগে ২০১৮’র নির্বাচনে আসামিরা জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের ঠাকুরমল্লিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র দখল করে লাঙ্গলে ভোট মেরেছেন উল্লেখ করেন। এ সময় সেখানে বোমাবাজি, হামলা, মারধর ও কুপিয়ে পিটিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের জখমের অভিযোগও করেন তিনি। অন্য আসামিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সরদার খালিদ হোসেন স্বপন, সাবেক সভাপতি কাজী ইমদাদুল হক দুলাল এবং মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী ফারজানা বিনতে ওয়াহাব। এরা ৩ জনই বাবুগঞ্জের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান। রোববার রাতে মামলার খবর জানাজানি হওয়ার পরপরই সমালোচনার ঝড় ওঠে মুলাদী-বাবুগঞ্জে। কেননা আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোটের জটিলতা আর তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোটযুদ্ধের কারণে তখন বহুবার গণমাধ্যমের শিরোনাম হয় ওই এলাকা। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খালিদ হোসেন স্বপন বলেন, ‘বর্তমানে কারাগারে থাকা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের বাড়ি বাবুগঞ্জ উপজেলায়। একসময় এই আসনের সংসদ-সদস্য ছিলেন তিনি। ২০১৪’র নির্বাচনে মহাজোটের শরিক দল হিসাবে এখানে নৌকার প্রার্থী হয়ে ভোটে জেতেন ওয়ার্কার্স পার্টির শেখ টিপু সুলতান। সেবার ভোটে হেরে যান জাতীয় পার্টির গোলাম কিবরিয়া টিপু। ২০১৮ সালে সংসদ-সদস্য পদে থেকেই নির্বাচন করেন শেখ টিপু। তখন আসনটি লাঙ্গলকে ছেড়ে দেওয়ার দাবি ছিল জাতীয় পার্টির। তবে তা না মেনে তৎকালীন এমপি ওয়ার্কার্স পার্টির শেখ টিপুকেই দেওয়া হয় নৌকা। বিষয়টি নিয়ে জটিলতা হলে নেতাকর্মীরা যাকে খুশি সমর্থন দিতে পারবে বলে অঘোষিতভাবে জানিয়ে দেয় আওয়ামী লীগ। এছাড়া বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে ট্রাক প্রতীকে নির্বাচন করেন ওয়ার্কার্স পার্টির অঙ্গসংগঠন যুব মৈত্রীর কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি আতিকুর রহমান। কিবরিয়া টিপু নির্বাচন করেন লাঙ্গল প্রতীকে। এছাড়া ধানের শীষে নির্বাচন করেন অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদিন।’ সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি কাজী এমদাদুল হক দুলাল বলেন, ‘সেবার প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হয় এখানে। নৌকা পেয়েও হেরে যান শেখ টিপু। ৫৪ হাজারের মতো ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন লাঙ্গলের গোলাম কিবরিয়া টিপু। শেখ টিপু পান ১৯ হাজারের কিছু বেশি ভোট। ৪৭ হাজারের বেশি ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হন বিএনপির জয়নাল। এছাড়া ট্রাক প্রতীকে ১৩ হাজারের মতো ভোট পান আতিকুর রহমান।’ সাবেক এমপি শেখ টিপু সুলতান বলেন, ‘নির্বাচনের দিন আমি ছিলাম মুলাদী উপজেলায়। তাছাড়া রানিং এমপি আর নৌকার প্রার্থী হয়ে আমি কেন্দ্র দখল করে লাঙ্গলে সিল মারব এমন অভিযোগ হাস্যকর। দেশব্যাপী নিরীহ নিরপরাধ লোকজনকে আসামি করে গণমামলা করার যে সংস্কৃতি চলছে এটা তারই অংশ।’ আতিকুর রহমানের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়কদের একজন ফারজানা বলেন, ‘নির্বাচনে জয়ী-পরাজিত প্রার্থীদের ভোটের যে হিসাব, সেটা দেখলেই বোঝা যায় যে কেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। তাছাড়া বিদ্রোহী প্রার্থী আর নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী মিলে লাঙ্গলের প্রার্থীকে সঙ্গে নিয়ে একটি কেন্দ্রে গিয়ে দলবেঁধে লাঙ্গলে সিল মারবে, এমন হাস্যকর মামলা থানা কি করে নিল সেটার তদন্ত হওয়া দরকার।’ উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি মুকিতুর রহমান কিসলু বলেন, ‘মামলার বাদীর বাড়ি দেহেরগতি ইউনিয়নে। সেখান থেকে জাহাঙ্গীরনগরের দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার, মাঝে বড় একটি নদী পাড়ি দিতে হয়। বিএনপি নেতা হয়ে নিজের ইউনিয়ন রেখে ভোটের দিন সে কেন ১০ কিলোমিটার দূরে অন্য ইউনিয়নে গেল সেটা মামলা নেওয়ার আগে ওসির দেখা উচিত ছিল। সাক্ষী হওয়া ৫ জনের মধ্যে ৪ জনের বাড়িও অন্য ইউনিয়নে।’ আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও ওয়ার্কার্স পার্টির পাশাপাশি বিএনপির নেতাকর্মীদের আসামি করা বিষয়ে বাবুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির ১নং সদস্য ইসরত হোসাইন কঁচি বলেন, ‘এই মামলার ব্যাপারে কিছুই জানা নেই। আসামি তালিকার ১১নং আসামি সোহেল সরদার মাধবপাশা ইউনিয়ন যুবদলের সহ-সভাপতি ও ইউনিয়ন তাঁতী দলের সাধারণ সম্পাদক। এটি আসলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমাদের দলেরই কেউ হয়তো অনৈতিক সুবিধা পেতে মামলাটি করিয়েছে।’ ভোটের দিন এলাকা ছেড়ে ১০ কিলোমিটার দূরে জাহাঙ্গীরনগরে কেন এবং কিভাবে গেলেন জানতে চাইলে মামলার বাদী আনোয়ার হোসেন হেমায়েত বলেন, ‘মোটরসাইকেলে গিয়েছি।’ ভোটের দিন মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ ছিল উল্লেখ করলে কথা ঘুরিয়ে নদীপথে ট্রলারে যাওয়ার দাবি করেন তিনি। নৌকা আর ট্রাকের প্রার্থী এক হয়ে লাঙ্গলের পক্ষে ভোট ডাকাতি করার বিষয়টি কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য জানতে চাইলেও কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। বাবুগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বাদীর অভিযোগ পেয়ে আমরা মামলা রেকর্ড করেছি। এখন তদন্ত করে দেখা হবে যে অভিযোগ সত্য নাকি মিথ্যা। এ মুহূর্তে এর বেশিকিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’