হাসিনার পতনের পর জোটের শীর্ষ নেতারা এখন কোথায়?
শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালানোর পর অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে ১৪ দলীয় জোটের শরিকরা। আওয়ামী লীগের ওপর ভর করে দীর্ঘদিন রাজনীতির ময়দানে টিকে থাকা নামসর্বস্ব এই দলগুলোর ভবিষ্যৎ কার্যত এখন অনিশ্চিত। আগামীতে আদৌ কি তারা রাজনীতি এবং ভোটের মাঠে ফিরতে পারবে, নাকি এখানেই থেমে যাবে গন্তব্য-সে নিয়েও চলছে অন্দরমহলে নানান আলোচনা-পর্যালোচনা। শেখ হাসিনার একটানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামল এবং তার এর আগের আরও পাঁচ বছরের শাসনামলে ক্ষমতার বড় অংশীজন ছিল ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলো। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগের পতনের মধ্য দিয়ে ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের সুবিধাবাদী রাজনীতির ইতি ঘটেছে। তাই এই দলগুলোকে নিয়ে আর এখন ভাবার সময় নেই কারও। গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পরপরই আওয়ামী লীগের নেতাদের মতো ১৪ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতারাও আত্মগোপনে চলে যান। এ অবস্থার মধ্যেই এই জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননকে গত ২২ আগস্ট গ্রেফতার করে পুলিশ। ২৬ আগস্ট পুলিশ উত্তরার একটি বাসা থেকে গ্রেফতার করে জোটের আরেক শীর্ষনেতা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুকে। ২ সেপ্টেম্বর ১৪ দলীয় জোটের আরেক প্রভাবশালী শীর্ষনেতা জাতীয় পার্টি-জেপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে তার ধানমন্ডির বাসা থেকে আটক করে পুলিশ। পরে অবশ্য তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। জোটের এই তিন শীর্ষ নেতাই শেখ হাসিনার শাসনামলে বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তারা একাধিকবার বিনাভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। রাশেদ খান মেনন এবং হাসানুল হক ইনু জুলাই-আগস্টে সংঘটিত একাধিক হত্যা মামলার আসামি হয়ে কারাবন্দি। দুর্নীতি-লুটপাটের নানা অভিযোগ ওঠায় তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তুতিও চলছে। পাশাপাশি শেখ হাসিনার সরকারের শিল্পমন্ত্রী সাম্যবাদী দলের (এমএল) সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, বিনাভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্য তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা, জাতীয় পার্টি-জেপি মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতারসহ জোটের একাধিক শীর্ষ নেতা হত্যা-অগ্নিসংযোগসহ একাধিক মামলার আসামি হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। একই অবস্থা তাদের সারা দেশের বেশির ভাগ নেতাকর্মীদেরও, তারাও যে যার মতো আত্মগোপনে। জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের দপ্তর সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বুধবার বলেন, বিভিন্ন বৈরী ও প্রতিকূল পরিবেশে রাজনীতি করার অভিজ্ঞতা জাসদের আছে, সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারায় আগের মতোই জাসদ অবদান রাখবে। তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ঐক্য হিসাবে ২০০৫ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট গঠিত হয়। ২৩ দফা অভিন্ন কর্মসূচির ভিত্তিতে একসঙ্গে আন্দোলন, নির্বাচন এবং সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে জোটটির আনুষ্ঠানিক পথচলা শুরু হয় ওই বছরের ১৫ জুলাই থেকে। গত ১৯ বছরে নানা টানাপোড়েন এবং ভাঙাগড়া সত্ত্বেও ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের আগমুহূর্ত পর্যন্ত জোটের শরিক দলের সংখ্যা ছিল আওয়ামী লীগসহ ১২টি। বাকি দলগুলোর মধ্যে রয়েছে-বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ, জাতীয় পার্টি-জেপি, তরিকত ফেডারেশন, সাম্যবাদী দল (এমএল), গণতন্ত্রী পার্টি, গণআজাদী লীগ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ-রেজাউর), গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি এবং কমিউনিস্ট কেন্দ্র। বিশ্লেষকদের মতে, প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে শেখ হাসিনা ভারতে পালানোর পর আওয়ামী লীগ নিজেই ধুঁকছে। আচমকা ক্ষমতা হারিয়ে তাদের নিজেদেরই এখন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পাশাপাশি তাদের জোটের শরিক দলেও নেমে এসেছে ভয়াবহ বিপর্যয়। নীতি ও আদর্শের রাজনীতির কথা বললেও পুরোপুরি এসব বিসর্জন দিয়ে যেনতেন উপায়ে ক্ষমতার ভাগীদার হওয়া, মন্ত্রী কিংবা সংসদ সদস্য হওয়া, আওয়ামী লীগ তথা দলটির সভাপতি শেখ হাসিনার যাবতীয় ইচ্ছাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে সমর্থন দিয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলো অনেকদিন থেকেই জনবিচ্ছিন্ন। জনমনেও তারা আওয়ামী লীগের দোসর হিসাবেই চিহ্নিত। এ কারণে রাজনীতির মাঠে ফিরে আসা তাদের জন্য কেবল দুরূহই নয়, অসাধ্যও। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী তিন মাসে এসব দল রাজনৈতিকভাবে কার্যত বিচ্ছিন্ন, নিষ্ক্রিয় এবং নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রাণপণ লড়াইয়ে ব্যস্ত। শুধু তাই নয়, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এরই মধ্যে কোনো কোনো শরিক দলে দেখা দিয়েছে ভাঙন। যদিও এ অবস্থার মধ্যেই কয়েকটি শরিক দল চলমান বিভিন্ন ইস্যুতে বিবৃতি কিংবা ঘরোয়া বৈঠক করে দলীয় কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে গণরোষের ভয়ে কোনো দলই নামছে না মাঠের কর্মসূচিতে।