অস্থির প্রশাসনে গতি ফেরেনি এখনো
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম ১০০ দিনে প্রশাসনে বেশকিছু কাজ হয়েছে, যার কিছু গতানুগতিক এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণও বটে। বর্তমান সরকারের কাজের অনেকটা জুড়েই আছে গত সরকারের ছাপ। এ সময়ও না পাওয়ার বেদনাহত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি অংশ, যা আগেও ছিল। অনেক বিষয় দ্রুত নিষ্পত্তি হবে-এমন আশা করে অনেকেই হতাশ হয়েছেন। দাবি ছিল অনেক; কিন্তু সব বাস্তবায়ন হয়নি। মনোবেদনা ভর করেছে সেসব ক্ষেত্রে। এখনো কাটেনি অস্থিরতা। সরকার যত দ্রুত কাজ করতে চাচ্ছে, তা সব ক্ষেত্রে সম্ভব হচ্ছে না। কেন্দ্র থেকে মাঠ প্রশাসনের দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় কিছু কিছু বিষয় আটকে যাচ্ছে। ফলে কাজে গতিসঞ্চার হচ্ছে না। জানা যায়, গত ১০০ দিনে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বঞ্চিত কর্মকর্তাকে পদোন্নতি ও পদায়ন করা হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে গত সরকারের সময় দেওয়া চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। একই সঙ্গে নতুন করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও দেওয়া হয়েছে। বঞ্চিত হয়ে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে গঠন করা হয়েছে কমিটি। সরকারি চাকরিতে প্রবেশে বয়সসীমা বৃদ্ধি এবং প্রতিবছর সম্পদবিবরণী বাধ্যতামূলকভাবে দাখিলে উদ্যোগ গ্রহণ এবং প্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। এ সময়ে অতীতের ধারাবাহিকতায় বেশকিছু কর্মকর্তাকে অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি (ওএসডি) করা হয়েছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনায় একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে। কিন্তু এত কাজের মধ্যেও ঝুলে আছে অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধি, উপসচিব ও যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি-পূর্ব এসএসবি এবং প্রশাসন ছাড়া অন্য ক্যাডারের (আদার্স ক্যাডার) কর্মকর্তাদের পদোন্নতি। অপরদিকে নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদনাম পরিবর্তনসহ অধিকাংশ দাবি এখনো পূরণ না হওয়ায় তাদের মধ্যে একধরনের মনোবেদনা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক কাজ হলেও প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরেনি। কাজে সঞ্চার হয়নি গতিও। প্রশাসন আয়ত্তে আনতে না পারলে জনস্বার্থ বিঘ্নিত হবে-এমন শঙ্কাও প্রকাশ করেন বিশেষজ্ঞদের অনেকে। জানতে চাইলে প্রশাসনে ১০০ দিনের সাফল্য ও ব্যর্থতা মূল্যায়নে অপারগতা প্রকাশ করেছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান। জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, বিগত ১০০ দিনে যথেষ্ট কাজ হয়েছে। এজন্য সরকারকে সাধুবাদ জানাই। তিনি আরও বলেন, এগুলো জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের রুটিন কাজ। তার মতে, দুর্নীতি সহায়ক আইন ও বিধিগুলো সংশোধন হয়নি। প্রশাসনে বিরাজমান অস্থিরতা আয়ত্তে আনতে পারেনি। প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরেনি, আসেনি গতিও। এতে জনস্বার্থ বিঘ্নিত হয়েছে, হচ্ছে। জনস্বার্থ প্রাধান্য দিতে হবে। অবসরের বয়সসীমা কমপক্ষে এক বছর বৃদ্ধি, অন্যান্য ক্যাডারের পদোন্নতি নিষ্পত্তি করা উচিত বলে মনে করেন তিনি। ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠন করা হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। নতুন সরকারের প্রশাসনে দেখা দেয় চরম বিশৃঙ্খলা। সচিবালয়ের ভেতরে-বাইরে ক্যাডার ও নন-ক্যাডার কর্মচারীদের বিভিন্ন গ্রুপ নানা দাবিদাওয়া নিয়ে মিছিল, মিটিং, সভা, সমাবেশ করতে থাকে। কেউ কাউকে মানছিলেন না। সরকার পতনের পর জনপ্রশাসন সচিবসহ অনেক সচিব অফিসে অনিয়মিত হয়ে পড়েন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগের (এপিডি) অতিরিক্ত সচিবসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অতিরিক্ত সচিবরা গা-ঢাকা দেন। প্রশাসনসহ বিভিন্ন ক্যাডারের সাবেক কর্মকর্তাদের সচিবালয়ে সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে। শুরুর দিকের অস্থিরতার মধ্যে সচিব হিসাবে ১৯৮২ নিয়মিত ব্যাচের কর্মকর্তা ড. মো. মোখলেস উর রহমানকে দুই বছরের জন্য সিনিয়র সচিব হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি বিগত সরকারের সময় বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মধ্যে একজন। দায়িত্বভার গ্রহণের পর প্রশাসনে তিন স্তরে পদোন্নতির উদ্যোগ নেন তিনি। এ সময় গত সরকারের মেয়াদে অদৃশ্য কারণে বঞ্চিত ১২৫ জন সিনিয়র সহকারী সচিবকে উপসচিব, ২২৬ জন উপসচিবকে যুগ্মসচিব এবং ১৩৫ যুগ্মসচিবকে অতিরিক্ত সচিব হিসাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এসব কর্মকর্তা ১৫ দিনের মধ্যে সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন। এ সময় ১২ জন কর্মকর্তাকে সিনিয়র সচিব/সচিব হিসাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। গ্রেড-১ পদে ৩ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ৮ জনকে মহাপরিচালক (ডিজি), ৬ জনকে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া নন-ক্যাডার সিনিয়র সহকারী সচিব পদে ৯ জন এবং সহকারী সচিব পদে ৩৭ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। বিগত ১০০ দিনে ৭ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে। গত সরকারের সময় দেওয়া শতাধিক কর্মকর্তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। ওই তালিকায় সচিব থেকে রাষ্ট্রদূত-সবই আছে। এর পাশাপাশি ৮০ কর্মকর্তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্যসচিব, জনপ্রশাসন সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সচিব, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব, ভূমি সচিব, নৌপরিবহণ সচিবসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিয়ে কর্মরত কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ রয়েছে। তারা বলছেন, একটি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ধাক্কা সহকারী সচিব পর্যন্ত এসে আছড়ে পড়ে। এটা বন্ধ হওয়া দরকার। বিগত সরকারের সময়ে নানাভাবে হয়রানি, পদ-পদবি এবং পদোন্নতিবঞ্চিত হয়ে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে সাবেক অর্থসচিব জাকির আহমেদ খানকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি বঞ্চিত কর্মকর্তাদের কাছ থেকে দরখাস্ত আহ্বান করে। ৩ অক্টোর পর্যন্ত আবেদন গ্রহণ করে তা যাচাই-বাছাই করছে কমিটি। জানা যায়, কমিটিতে ৫ হাজার ২০০টি আবেদন জমা পড়েছিল এবং সেগুলো থেকে ১ হাজার ৫০০ আবেদন বাছাই করে প্রাথমিক তালিকা করা হয়েছে। তালিকায় থাকা কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে অধিকাংশই ক্ষতিপূরণ পাবেন বলে জানা গেছে। সরকারি কর্মচারীদের সম্পদবিবরণী দাখিলে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সাড়ে ১৬ লাখ সরকারি কর্মচারীর কাছে প্রতিবছর বাধ্যতামূলকভাবে সম্পদবিবরণী দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সম্পদবিবরণী দাখিলের বিষয়ে বিগত সরকার গড়িমসি করলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রশাসন এ বিষয়ে বেশ এগিয়ে। চলতি বছর ৩১ ডিসেম্বর এবং আগামী বছর থেকে সরকারি কর্মচারীরা বাধ্যতামূলকভাবে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের কাছে সম্পদের হ্রাসবৃদ্ধি উল্লেখ করে সম্পদবিবরণী জমা দেবেন। তবে সম্পদবিবরণী ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, যা এ উদ্যোগের দুর্বলতা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সয়সসীমা ৩২ বছর নির্ধারণ করা ছিল গত ১০০ দিনে প্রশাসনের অন্যতম কাজ। বয়সসীমা বৃদ্ধির বিষয়ে প্রায় একযুগ ধরে চাকরিপ্রত্যাশীরা আন্দোলন করে আসছেন। কিন্তু কেউ বিষয়টি আমলে নেয়নি। ৩০ সেপ্টেম্বর বয়সসীমা বৃদ্ধির জন্য মিছিলসহ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলার দাবিতে তার বাসভবনের সামনে রাস্তায় বসে পড়েন চাকরি প্রত্যাশীরা। এ সময় পুলিশের সঙ্গে চাকরিপ্রত্যাশীদের পালটাপালটি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে তার প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার পর সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধির দাবি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সুপারিশ উপদেষ্টা পরিষদে উপস্থাপনের পর আলোচনা হয়। এতে ছেলে-মেয়ে উভয়ের জন্য ৩২ বছর করার সিদ্ধান্ত হয়। তবে এখনো এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করা হয়নি। প্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন হয়েছে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সচিব আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীকে প্রধান করে এ কমিশন গঠন করা হয়। কমিটি একাধিক সেমিনার ও আলোচনাসভার আয়োজন করেছে। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারের কাছে সুপারিশ পেশ করবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রশাসনে ৮০ কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে। ৪ জনকে বাধ্যতামূলকভাবে অবসরে পাঠানো হয়েছে। তাদের অতীত অপকর্মের কারণে এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া আরও বেশকিছু কর্মকর্তার অতীত আমলনামা যাচাই-বাছাই হচ্ছে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে একাধিক অনিয়ম বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিশেষ করে জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে তিনটি কমিটি গঠন করে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ডিসি নিয়োগে আর্থিক দুর্নীতর বিষয়টি তদন্তে সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। তবে ডিসি নিয়োগ নিয়ে সংঘটিত হট্টোগোলের বিষয়টি তদন্ত করতে গিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা তালগোল পাকিয়ে ফেলেন, যা প্রশাসনে খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তরা জানান। এছাড়া ঈদুলফিতর ও ঈদুল-আজহার ছুটি যথাক্রমে ৫ ও ৬ দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। দুর্গাপুজার ছুটি ২ দিন করা হয়েছে। এতসব কাজের মধ্যেও প্রশাসনে বেশকিছু কাজ এখনো অসমাপ্ত, যা নিয়ে ক্যাডার ও নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে মনোবেদনা রয়েছে। বিশেষ করে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি করা হলেও অবসরের সীমা বাড়ানো হয়নি। বিষয়টি নিয়ে সব গ্রেডের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। এছাড়া নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদ সংরক্ষণসহ বিভিন্ন দাবিদাওয়া পূরণ না হওয়ায় তারা ক্ষুব্ধ। তারা বলছেন, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি হলেও তারা যেই, সেই আছেন। না বাড়ছে তাদের বেতনভাতা, না পেয়েছেন পদ ও পদবি পরিবর্তনের সুবিধা। এসব বিষয় সুরাহা হওয়া জরুরি বলে দাবি করেন কর্মচারী নেতারা।