ভাসানীর ৪৮তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ
উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিক মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ৪৮তম মৃত্যুবাষিকী আজ। আফ্রো-এশিয়ার গণমানুষের অধিকার আদায়ের অবিসম্বাদিত এই নেতা ১৯৭৬ সালের এইদিনে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। বিএনপি, জাগপা, বাংলাদেশ নাপ, গণদল, বাংলাদেশ ন্যাপসহ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন দিবসটি পালনে নানা ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। টাঙ্গাইলের সন্তোষে মরহুমের কবরে ফাতেহা পাঠ, মিলাদ মাহফিল ও ঢাকায় আলোচনার সভার আয়োজন করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। দিবসটি উপলক্ষ্যে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা বাণী দিয়েছেন। মওলানা ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবছর নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে। গতকাল শনিবার মওলানা ভাসানীর ৪৮তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ‘গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব ও মাওলানা ভাসানী’ শীর্ষক এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে প্রখ্যাত দার্শিনিক ড. সলিমুল্লাহ বক্তৃতা করেন। আজ মরহুমের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও জিয়ারতের মধ্যদিয়ে কর্মসূচির উদ্বোধন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল এবং ক্যাম্পাসে অবস্থিত শাহ্ নাসিরউদ্দিন বোগদাদী এতিমখানায় কোরআন খতম ও এতিমদের জন্য খাবার পরিবেশন করা হবে। ঢাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল স্মরণ সভার আয়োজন করবে। আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার ধানগড়া গ্রামের জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাকনাম চেগা মিয়া। ৫ বছর বয়সে মক্তবে ওস্তাদের কাছে পড়ালেখা শুরু করেন। ৬ বছর বয়সে পিতৃহীন হন এবং ১২ বছর বয়সে মাকে হারান। ভাসানী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন না পেলেও ওস্তাদের কাছে মক্তবের পাঠ সমাপ্ত করেন। তিনি উর্দু, ফার্সি, হিন্দি, অসমিয়া, আরবি ও ইংরেজি ভাষায় পারদর্শি ছিলেন। মওলানা ভাসানী অল্প বয়সে রাজনীতিতে যোগদেন। তিনি ১৯০৮ সালে আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯১৫ সালে তিনি আসাম আঞ্জুমান ওলামার সভাপতি এবং ১৯১৬ সালে আসাম কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯১৯ সাল থেকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, মাওলানা আজাদ সুবহানী ও মাওলানা আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে রাজনীতি করেন। ২৪ বছর বয়সের তরুণ মওলানা আসামে বাস্তুহারা বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রিয় নেতা হয়ে উঠেন। ব্রিটিশ সরকার ঘোষিত কুখ্যাত ‘লাইন প্রথার’ বিরুদ্ধে তিনি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৩১ সালের এই সময়ে তিনি ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসানচরে বসবাস করতেন। অসামান্য নেতৃত্বে মুগ্ধ হয়ে জনগণ তাকে ‘ভাসানী’ উপাধি দেন। আসাম থেকে মওলানা ভাসানী ১৯৩৭ সালে টাঙ্গাইলে আসেন। আস্তানা গড়ে তোলেন কাগমারীতে। তার আসামের ১৩ বছরের জীবনে ৮ বছরই কারাগারে কেটেছে। বাঙালিদের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি আসাম আইনসভার সদস্য ছিলেন ১১ বছর। ১৯৪৬ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে টাঙ্গাইল মহকুমায় মওলানা ভাসানী নিখিল ভারত মুসলিম লীগের পক্ষে যে গণআন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন; তার ফলে মুসলিম লীগের পক্ষে বিপুল ভোট পড়ে। ১৯৪৮ সালে আসামের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে তিনি পূর্ব বাংলায় ফিরে আসেন। টাঙ্গাইলের সন্তোষে বসবাস শুরু করেন। আপসহীন সংগ্রামী নেতা ভাসানী সময়োপযোগী ও অগ্রগামী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মতো দূরদর্শিতার জন্য ব্রিটিশ আমলেই জাতীয় নেতার মর্যাদা লাভ করেন। ১৯৪৮ সাল থেকেই তিনি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট গড়ে তোলেন। ১৯৪৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকা সফরে এলে মওলানা ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন তারই নেতৃত্বে ঢাকার টিকাটুলিতে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা হয় এবং তিনি দলের সভাপতি হন। তিনিই মূলত তরুণ শেখ মুজিবুর রহমানকে দলের সহ সম্পাদক পদে বসান। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি কেটে দেয়া নিয়ে সোহরাওয়ার্দীসহ অন্যান্য নেতার সাথে তার মতবিরোধ ঘটে। তিনি দল ত্যাগ করে কৃষক সমিতি গঠন করেন। ১৯৫৭ সালে ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে ‘আসসালামু আলাইকুম’ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের ডাক দেন। তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। মওলানা ভাসানী ১৯৬৪, ১৯৬৫, ১৯৬৮ সালের আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মওলানা ভাসানী ভারতে চলে যান এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টামন্ডলীর সভাপতি হন। মুজিবের শাসনামলে ১৯৭২ সালের ২ এপ্রিল ঢাকায় পল্টনের জনসভায় চোরাচালানের বিরুদ্ধে আপসহীন মনোভাব ব্যক্ত করেন। ১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি এবং দুর্ভিক্ষের প্রতিবাদে অনশন ধর্মঘট করেন। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে ভারত গঙ্গা নদীর পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার এবং মরণফাঁদ ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে সে বছর ১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা মিছিলের নেতৃত্ব দান করে সারা পৃথিবীতে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর ৯৬ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন।