গতি পাচ্ছে নির্বাচনী প্রক্রিয়া
সংস্কারের অজুহাতে ত্রায়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া ‘কার্পেটের নিচে চাপা’ দিয়ে রাখার অপচেষ্টায় পানি ঢেলে দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বার্তা সংস্থা এএফপিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ যতটা সম্ভব কম হওয়া উচিত। সংস্কারের গতিই সিদ্ধান্ত দেবেÑ কত তাড়াতাড়ি নির্বাচন হবে।’ এতে করে উপদেষ্টাদের মধ্যে এতদিন যারা সংস্কারের নামে ‘দীর্ঘদিন ক্ষমতায়’ থাকার স্বপ্ন দেখছেন; যারা আওয়ামী লীগ পুনর্বাসন অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে ‘আগে সংস্কার পরে নির্বাচন’ প্রচারণা চালাচ্ছেন তারা হোঁচট খেয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হলে বর্তমানের ঘোলাটে চিত্র বদলে যাবে। পাল্টে যাবে দেশের রাজনীতির গতিধারা। দেশের মানুষ নির্বাচনকে উৎসব মনে করে। পরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে না পারা মানুষ আগামী জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেয়ার জন্য মুখিয়ে রয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ভারতের নীলনকশায় অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা ‘সংস্কার’ অজুহাতে নির্বাচন প্রলম্বিত করার চেষ্টা করছেন। একই সঙ্গে কিছু জনভিত্তিহীন রাজনৈতিক দল ‘সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন’ ধোঁয়া তুলে নির্বাচনী আইন প্রণয়ন এবং নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা প্রলম্বিত করতে চাচ্ছে। তবে নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটি গঠন করায় ‘নির্বাচনমুখী যাত্রা’ শুরু হয়ে গেছে। নতুন কমিশনের জন্য সবার কাছে নাম চাওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এএফপিকে ড. ইউনূস জানিয়েছেন, দেশকে তিনি একটি গণতান্ত্রিক ভোটের পথে নিয়ে যাবেন। তিনি বলেন, আমরা জনগণকে এই প্রতিশ্রুতিই দিয়েছি। প্রতিশ্রুতি দিয়েছি যে, যত তাড়াতাড়ি আমরা প্রস্তুত হবো, তত তাড়াতাড়ি নির্বাচন হবে। নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসবে এবং দেশ পরিচালনা করবে। দ্রুততার সঙ্গে সম্ভাব্য সাংবিধানিক সংস্কার, পাশাপাশি সরকার, পার্লামেন্ট এবং নির্বাচনী আইনের ধরনের বিষয়ে দেশকে দ্রুতই একমত হতে হবে। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দুই দফায় পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করেছেন। প্রতিটি সংলাপে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল প্রয়োজনীয় সংস্কার দ্রুত করে স্বল্প সময়ের মধ্যে নির্বাচন দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। কেউ সংস্কার রূপরেখা কেউ সরাসরি দাবিনামা দিয়েছে। কিন্তু দেশের সবচেয়ে বৃহৎ এবং জনসম্পৃক্ত দল বিএনপি নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করলেও জামায়াত ভারতের ফাঁদে পড়ে ধীরেসুস্থে সংস্কার করে নির্বাচন দেয়ার পক্ষে অবস্থান নেয়। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ড. ইউনূসের সরলতার সুযোগ নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকজন দিল্লির অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে দীর্ঘমেয়াদে সরকারে থাকার ফন্দিফিকির করছেন। কিন্তু ড. ইউনূস যৌক্তিক সময়ের মধ্যে সংস্কার করে নির্বাচন দেয়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাবেক কূটনীতিক সাকিব আলী বলেন, নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা হলেই রাজনীতির গতিধারা পাল্টে যাবে। একদিকে দিল্লিতে বসে হাসিনার একের পর এক ষড়যন্ত্র মাঠে মারা যাবে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দল, সিভিল প্রশাসন, পুলিশ, সেনাবাহিনী নির্বাচনমুখী হবে এবং সবখানে অস্থিরতা কমে যাবে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলা এমনকি গ্রাম পর্যায়ে বসবাস করেন এমন কয়েকজন ভিন্ন পেশাজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে তারা ভোট দেয়ার জন্য মুখিয়ে রয়েছেন। ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪ সালের পাতানো নির্বাচনে কেউ ভোট দিতে যাননি। এমনকি ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভোট দিলেও প্রকৃত ফলাফল পাননি। ফলে তারা চান যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের আয়োজন করা হোক। কথা প্রসঙ্গে রংপুরের একটি কলেজের একজন প্রফেসর বললেন, ‘১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের অন্তর্বর্তী সরকার, ১৯৯৬ সালে বিচারপতির হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার, ২০০১ সালের বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন উপহার দিতে পারলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে এক বছরের মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন সম্ভব। এ জন্য ইচ্ছা থাকতে হবে। ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের সরকার দুই বছর ক্ষমতায় থাকায় ভারতীয় নীলনকশায় ভোট হয়েছিল। এবার সংস্কারের নামে বিলম্ব করলে দেশের রাজনীতিতে ভারত ফের আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করবে’। অবশ্য কিছু দিন আগে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামান বলেছেন, ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব হতে পারে। দেশে যাদের বয়স ৩২ বছরের নিচে তারা নতুন ভোটার হলেও জীবনে ভোট দিতে পারেননি। প্রায় চার কোটি তরুণ-তরুণী ভোটার প্রথমবার ভোট দেয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. নুরুল আমিন ব্যাপারী বলেন, নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হলে অস্থিরতা কেটে যাবে। রাজনীতির গতিধারা পাল্টে যাবে। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনমুখী হয়ে পড়বে। মানুষ নির্বাচনমুখী হয়ে পড়বে। প্রশাসনও নির্বাচনের দিকে ঝুঁকে যাবে। ভারতে নিরাপদে থেকে হাসিনা যে আস্ফালন করছেন এবং একের পর এক ষড়যন্ত্র কার্ড ছুড়ছেন নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করলে এগুলো পাত্তা পাবে না। শেখ হাসিনা কার্যত ১৫ বছর দেশে মাফিয়া শাসন চালিয়েছেন। ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা এসে তিনি রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট, বিদেশে টাকা পাচার, প্রশাসনকে দলীয়করণ করেছেন। পাশাপাশি প্রতিটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও সেক্টর ধ্বংস করেছেন। বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, ব্যাংকিং সেক্টরÑ সবগুলোর মেরুদ- ভেঙে দিয়েছেন। এ কারণে কিছু কিছু সেক্টরে সংস্কারের প্রয়োজন। অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে ১০টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। পুলিশ সংস্কার কমিশন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, সংবিধান সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন, শ্রমিক অধিকার সংস্কার কমিশন, নারী-বিষয়ক কমিশন। এসব সংস্কার কমিশনের একাধিক কমিশনে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক, যুক্তরাজ্যের নাগরিককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ফলে সংস্কার কমিশনগুলো কতদূর কি করতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তবে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একাধিক বৈঠকসহ কর্মতৎপরতা চালাচ্ছে। তবে সংস্কার কমিশনের বাইরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তৎপরতা চোখে পড়ার মতো। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আগে টানা কয়েক দিন শেখ হাসিনার নির্দেশে গণহত্যা চালানো হয়েছে। গণহত্যার বিচারের লক্ষ্যে ১৪ অক্টোবর বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারকে চেয়ারম্যান করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ১৭ অক্টোবর পৃথক মামলায় শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এমনকি শেখ হাসিনাকে ধরিয়ে দিতে ইন্টারপোলে রেড অ্যালাট জারি করা হচ্ছে। এদিকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে নির্বাচন সংলাপে অংশ নিয়েছেন এমন নেতাদের সঙ্গে কথা বললে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকেই নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ দেয়া উচিত ছিল। নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সেনাপ্রধান যে ১৮ মাস সময়ের কথা বলেছেন, এর মাধ্যমে তিনি অন্তত সেনাবাহিনীর অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। গণদলের চেয়ারম্যান এটিএম গোলাম মাওলা চৌধুরী বলেন, ভারতের ষড়যন্ত্র থেকে আন্তর্বর্তী সরকার ও দেশকে রক্ষা করতে হলে দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ দেয়া উচিত। সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে তবে অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের রূপরেখা দেবে নির্বাচিত সরকার সেটির বাস্তবায়ন করবে। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকী বলেন, রাজনৈতিক দল, শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে অন্তর্বর্তী সরকার একটি রোডম্যাপ তৈরি করবে, সেটিই প্রত্যাশা। বিএনপির একাধিক নেতা বলেছেন, একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন করতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। নির্বাচন কমিশনে যতটুকু স্বাধীনতা নিশ্চিত হওয়া দরকার, সে সব প্রয়োজনীয় সংস্কারের সুপারিশ করে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। এএফপির সাক্ষাৎকারে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ যতটা সম্ভব কম হওয়া উচিত। নির্বাচনের আগে সংস্কার প্রয়োজন। তবে সংস্কারের গতিই সিদ্ধান্ত দেবে কত তাড়াতাড়ি নির্বাচন হবে।