অবহেলিত বিপ্লবের নায়কেরা
জুলাই বিপ্লবের সময়ে সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ খায়রুলের পায়ের গোড়ালির উপরে গুলি লেগেছিল। সেই থেকে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান-নিটোরে (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসাধীন তিনি। দীর্ঘ চিকিৎসার পর এখনও তিনি ভালো করে হাঁটতে পারছেন না। আরও ভালো চিকিৎসা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। একই বিপ্লবে অংশ নিয়ে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন মো. হাসান। তিনিও তিন মাস ধরে নামমাত্র চিকিৎসা পাচ্ছেন। চিকিৎসার চেয়ে ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত সরকারের কাছ থেকে অবহেলায় বেশি পাচ্ছেন বলে মনে করছেন খায়রুল ও হাসান। এই দু’জনের মতো রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালেই শত শত আহত বিপ্লবীর চিকিৎসার চিত্র এবং মনের ক্ষোভ একই। ভিন্ন চিত্র নয়, রাজধানীর চক্ষু হাসপাতালসহ অন্যান্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিপ্লবীদের। যাদের রক্ত, ত্যাগ ও বিসর্জনের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে নতুন বাংলাদেশ, সূচনা হয়েছে নতুন দিনের সেই বিপ্লবের নায়কেরাই এখন অবহেলিত। যার কিছুটা ক্ষোভ ফুটে উঠেছে গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার। অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম পঙ্গু হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে দু’চারজনের খোঁজ-খবর নিয়ে ফিরে আসতে চাইলে তার গাড়ী অবরুদ্ধ এবং পরবর্তীতে আহতাবস্থায় রাস্তায় নেমে অবস্থান নেন তারা। বুধবার রাত আড়াইটা পর্যন্ত হাসপাতালের সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে থাকলে রাতে অন্তর্বর্তী সরকারের ৪ উপদেষ্টা তাদের সাথে গিয়ে কথা বলেন এবং দাবিগুলো মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলে সড়ক ছেড়ে হাসপাতালে চলে যান। জুলাই বিপ্লবে গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন খায়রুল বলেন, আমরা সাড়ে তিন মাস ধরে কষ্ট করতেছি। আমাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেছে না। উপদেষ্টা (স্বাস্থ্য উপদেষ্টা) এসে আমাদের না দেখেই চলে যান। আমরা গুলি খাইছি অথচ তিন মাস যেতে না যেতেই আমাদের কোন দাম নেই! জুলাই বিপ্লবে আহত হয়ে পঙ্গু হাসপাতালের তিনতলার বি-ওয়ার্ডে চিকিৎসা নেয়া মো. হাসান বলেন, ওনারা ওনাদের পছন্দের বিদেশি পাঁচজন সাংবাদিক নিয়ে এসেছেন এবং আমাদের দেশীয় কোনো সাংবাদিকদের ঢুকতে দেয়নি। আমরা এতজন আন্দোলনে আহত হয়ে চিকিৎসা নিলেও তারা দু-একজনের সঙ্গে কথা বলে চলে গেছেন। কিন্তু আমাদের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। আমাদের সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে আমরা কথা বলতে গেলেও বাধা দেয়া হয়েছে। অশ্রুশিক্ত হয়ে তিনি বলেন, আমাদেরকে সামান্য ট্রিটমেন্ট দিয়ে তিন মাস হাসপাতালে ফেলে রাখা হয়েছে। আমার পায়ে নয়টি অপারেশন করার পরেও এখনো সুস্থ হতে পারিনি। কবে হবো তার ঠিক নেই। অপরদিকে আহতদেরকে এক লাখ টাকা করে দেয়া হবে বললেও এখনো আমরা কিছুই পাইনি। শুধু চিকিৎসাই ফ্রি করা হচ্ছে। আমাদের কী অন্য কোনো খরচ লাগে না? আমাদের পরিবার আমাদের পেছনে খরচ করতে করতে সব শেষ করে ফেলেছে। দেশের জন্য এত ত্যাগ করে আমরা কী পেলাম। আজ আমাদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে যারা সরকার গঠন করেছে তারা এখন আমাদেরকেই চিনে না। আমরা চাই তারা সবাই আমাদের সঙ্গে কথা বলুক। আমাদের জন্য ঘোষণা করা সেই এক লাখ টাকা দিক এবং যাদের যাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন তাদেরকে সেভাবে চিকিৎসাসেবা দেয়া হোক। মোহাম্মদপুরে ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ মো. শাহীন নামে আরেক জন বলেন, আজ পর্যন্ত আমরা কোনো সুযোগ-সুবিধা পাইনি। সেই কথাই বলতে গিয়েছিলাম উপদেষ্টাকে। নিজেদের মানুষ মনে করে তার কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি আমাদের কথা তো শুনলেনই না উল্টো অপমান করলেন। আমরা দেশের জন্য নিজেকে বলি দিয়ে আজ চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিঃস্ব। আমরা এর প্রতিকার চাই। ৪ আগস্ট চোখে গুলিবিদ্ধ হয়ে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন কিশোরগঞ্জ পলিটেকনিকের শিক্ষার্থী শেখ সাদী বলেন, আমার বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইলে। আমি গত ৬ আগস্ট থেকে চক্ষু বিজ্ঞানে ভর্তি। আমার ডান চোখে এখনো গুলি ঢুকে আছে। চিকিৎসকেরা বলেছেন, আমরা সর্বোচ্চ ট্রিটমেন্ট দিয়েছি। এদেশ থেকে আমার চোখের গুলি বের করা সম্ভব নয়। বিদেশে যেতে হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কেউ কোনো আলাপ করলো না। আমাদের শুধু ফ্রি চিকিৎসা দিয়ে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু এই ওষুধ ছাড়াও যে একটা রোগীর কতো খরচ লাগে সে হিসাব কেউ নেয় না। রোগীর সঙ্গে যেই স্বজনরা থাকে, তাদের খরচ কেউ দেয় না। এমনকি এক লাখ টাকা করে দেয়ার কথা তাও আমরা পাইনি। আমাদের অনুদানের টাকা পর্যন্ত মেরে খাওয়া হচ্ছে। আমরা এসবের প্রতিকার চাই। আমাদের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের সকল দাবি পূরণ করতে হবে। এই ঘটনার বিসয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, আমরা দিন দিন বড় রকম সংকটের মধ্যে পড়ে যাচ্ছি। কত রকম আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বিদেশ থেকে ডেকে এনে সংবর্ধনা দিয়ে দায়িত্ব দেওয়া হলো। কিন্তু তিনি আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা পর্যন্ত করতে পারলেন না। এর আগে গত বুধবার বাংলাদেশে নিযুক্ত বৃটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুককে সঙ্গে নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহতদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে যান স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। হাসপাতালে চতুর্থ তলায় ভর্তিদের দেখে নিচে নেমে যাওয়ায় তৃতীয় তলায় থাকা আহতরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। তারা নিচে নেমে বিক্ষোভ শুরু করেন। সব আহতকে না দেখা এবং তাদের সঙ্গে কথা না বলার প্রতিবাদ জানিয়ে ৬ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে সড়ক অবরোধ করে নজিরবিহীন প্রতিবাদ করেন আহত রোগীরা। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা পেছনের পথ ধরে হাসপাতাল ছাড়ায় আহতদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ আরও বেড়ে যায়। তারা সড়কে অবস্থান নিয়ে স্বাস্থ্য উপদেষ্টাসহ তিন উপদেষ্টাকে ঘটনাস্থলে হাজির হওয়ার আল্টিমেটাম দেন। পরে রাত আড়াইটার দিকে সেখান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রাতে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং উপদেষ্টা মাহফুজ আলম উপস্থিত হন। এ সময় স্বাস্থ্য উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. সায়েদুর রহমানও তাদের সঙ্গে ছিলেন। আহতদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক এবং তাদের দাবি পূরণের আশ্বাস দিলে তারা সড়ক ছেড়ে দেন। আজীবন রাষ্ট্রীয় খরচে চিকিৎসা : জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের আজীবন রাষ্ট্রীয় খরচে চিকিৎসা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (স্বাস্থ্য) ড. সায়েদুর রহমান। গতকাল স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আহত ছাত্র-জনতার একটি অংশের সঙ্গে ছয় উপদেষ্টার বৈঠক শেষে তিনি একথা জানান। সায়েদুর রহমান বলেন, আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলতে চাই আন্দোলনে আহত যোদ্ধাদের একটি ইউনিক আইডি কার্ড থাকবে এবং এই আইডি কার্ডের মাধ্যমে আন্দোলনে আহতদের সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। এদেশের সব সরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান থেকে তারা আজীবন বিনামূল্যে চিকিৎসা পাবেন। এমনকি যেসব বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে সরকারের চুক্তি হবে সেখানে তারা বিনামূল্যে চিকিৎসা পাবেন এবং চিকিৎসা ব্যয়ভার আংশিক সরকার বহন করবে। এরই মধ্যে আহতরা চিকিৎসার জন্য যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছেন সেগুলো যথাযথ ডকুমেন্টেশন পাওয়ার পর তাদের অর্থ ফেরত দেওয়া হবে। যারা পঙ্গুত্ব এবং অন্ধত্ব বরণ করেছেন তাদের প্রতি রাষ্ট্রের সমবেদনা এবং সহানুভূতি। কিন্তু আমরা সেখানে ক্ষান্ত নই। তিনি আরও বলেন, প্রতিটি অন্ধ মানুষের জীবন পরিচালনার জন্য তার শিক্ষাগত যোগ্যতা, তার সামর্থ্যের সঙ্গে মিলিয়ে তাকে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে তার পরিবারের আর্থিক সাহায্য ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। যারা পঙ্গুত্ববরণ করেছেন তাদের জন্য যেসব মেশিন, চিকিৎসা সেবা এবং যে ধরনের যন্ত্রপাতি সহায়তা প্রয়োজন হয় তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। আন্দোলনে যারা আহত হয়েছেন এবং মানসিকভাবে যে ট্রমার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন তাদের সবাইকে টেলিমেডিসিন নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হবে। যাদের প্রয়োজন হবে তাদের স্ক্রিনিং করে আমাদের আটটি বিভাগে সাইকো থেরাপি দেওয়া হবে। আগামী ১৭ তারিখের মধ্যে যারা আহত হয়েছেন তাদের জন্য একটি সাপোর্ট সেন্টার তৈরি করা হবে। আহতদের সব অভিযোগ সেখানে আসবে এবং সেখান থেকে তার নিষ্পত্তি করা হবে। সায়েদুর রহমান বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আমরা বলতে চাই আহত যোদ্ধাদের চিকিৎসার ব্যাপারে গাফিলতি সহ্য করা হবে না। আহতদের চিকিৎসা সেবা, সেবা প্রাপ্তি অর্থলাভসহ সবক্ষেত্রে গাফিলতির অভিযোগ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হবে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তথ্য উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, আমরা বিশেষ একটি পরিস্থিতিতে মিলিত হয়েছি এবং আহতদের চিকিৎসার জন্য নানামুখী প্রক্রিয়া চলমান। স্বাস্থ্য খাতে সর্বোচ্চ সহযোগিতা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা সম্পন্ন একজন বিশেষ সহকারী নিযুক্ত করা হয়েছে। আন্দোলনে আহত অনেকেই হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে আছেন। তাদের ভেতর ট্রমা এবং নানা কারণে বিভিন্ন রকম অনাস্থা তৈরি হয়েছে। রাষ্ট্রের অনেকগুলো সমস্যা আমাদের একসাথে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তাই আমরা বারবার এটা নিশ্চিত করতে চাই আহতদের চিকিৎসার ব্যাপারে আমাদের সর্বোচ্চ রকম অগ্রাধিকার দিচ্ছি। তিনি বলেন, এই উদ্যোগগুলো আমাদের আগে থেকেই ছিল এবং কার্যক্রম চলমান। বিশেষ সহকারী নিয়োগ বিভিন্ন রকম দাবির আগেই করা হয়েছে। বৈঠকে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম, সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আক্তার, উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি এবং তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম, যুব ও ক্রীড়া এবং স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ, জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম, আন্দোলনে শহীদ মুগ্ধর জমজ ভাই ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ অংশ নিয়েছেন। আর শতাধিক আহত ছাত্র-জনতা উপস্থিত ছিলেন।