মার্কিনিদের ‘বাংলাদেশ নীতি’ পরিবর্তন হবে না
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে শেষ পর্যন্ত রাজকীয় প্রত্যাবর্তনই হলো ডোনাল্ড ট্রাম্পের। সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আবারও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে ১৩২ বছরের এক রেকর্ড ভাঙলেন ট্রাম্প। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় ২৭০ ইলেকটোরাল ভোটের ল্যান্ডমার্ক পার করে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলাকে পরিষ্কার ব্যবধানে হারিয়ে দিয়েছেন তিনি। একইসঙ্গে সিনেটেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত হয়ে গেছে তার দল রিপাবলিকান পার্টির। দারুণ এ জয়ে বাঁধভাঙা উল্লাসে মেতে উঠেছে রিপাবলিকান শিবির। অবশ্য, যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে ট্রাম্পকে ভালোই টক্কর দিয়েছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা। এদিকে মার্কিন নির্বাচনে রিপাবলিক্যাম প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ের প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতেও। ইতিমধ্যে শেয়ার বাজার চাঙ্গা হয়ে ওঠার পাশাপাশি স্বর্ণ ও অপরিশোধিত তেলের দাম কমে গেছে। বিদেশি গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি আউন্স সোনার দাম ১৮ ডলার কমে ২৭৩১ ডলারে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববাজারে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম ১ দশমিক ১৭ ডলার কমে ৭০ দশমিক ৮২ ডলারে দাঁড়িয়েছে। মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, ডাও জোন্স ১১১৪ পয়েন্ট বেড়ে ৪৬৪৯৫-এ রয়েছে। বাংলাদেশের রফতানির সবচেয়ে বড় একক বাজার যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিবছর মোটামুটি ১০ বিলিয়ন বা এক হাজার কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। এই রফতানির বেশির ভাগই তৈরি পোশাক। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার হিস্যার ৯ শতাংশ দখলে নিয়ে বাংলাদেশ তৃতীয় সর্বোচ্চ পোশাক রফতানিকারক দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি পোশাক রফতানি করে চীন আর ভিয়েতনাম। ট্রাম্প সরকার যদি তার ট্যারিফ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন, তবে তা বাংলাদেশের জন্য সুবিধাজনক হতে পারে। চীনের ওপর অতিরিক্ত ট্যারিফ বসানো হলে চীন তখন বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে বেছে নিবে পণ্য উৎপাদনের জন্য। যা বাংলাদেশসহ আরও অনেক দেশের জন্য সুযোগ বয়ে আনতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে চীনের বিশাল বাজার ধরতে পারবে এসব দেশ। কারণ, এসব দেশকে তুলনামূলক কম শুল্ক দিতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে শ্বেতপত্র তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেই ক্ষমতায় আসুক বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়বে না। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বর্তমান বিশ্বের যে জটিল পরিস্থিতি রয়েছে তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফলাফল আরও সুদুর প্রসারি প্রভাব রাখবে বলে মনে করি। আমরা বাংলাদেশের মানুষ বহুদিন ভোট দিতে পারিনি বিভিন্ন কারণে সেহেতু অন্য দেশের ভোটের অভিজ্ঞতা থেকে নিজেদের জন্য আমরা বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে চাই। অর্থনীতিবিদ, বাণিজ্য বিশ্লেষক ও রপ্তানিকারকরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। কেউ মনে করেন, সাধারণত মার্কিন প্রেসিডেন্ট পরিবর্তনের সঙ্গে তাদের বৈদেশিক নীতি বা বাণিজ্য নীতিতে কোনো পরিবর্তন হয় না। কেউ মনে করেন, রিপাবলিকান পার্টির ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ায় তিনি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের জন্য আরও অনেক কিছু দিতে পারেন, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যকে প্রভাবিত করতে পারে। আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচাম) সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, আমেরিকান পররাষ্ট্রনীতি দ্রুত পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তাই খারাপ কিছু হওয়ার সুযোগ নেই। বরং বাংলাদেশের জন্য ভালো হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। একই সঙ্গে নতুন যারা আসবে তাদের সঙ্গে সঠিকভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে পারলে বাংলাদেশ বেনিপিটেব হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তিনি যদি তার ট্যারিফ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন, তবে তা বাংলাদেশের জন্য সুবিধাজনক হতে পারে। ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পোশাকপণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা আছে। সুতরাং ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ হলে তা বাংলাদেশের রফতানিকে প্রভাবিত করবে না। তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যদি শাস্তিমূলক কোনো শুল্ক আরোপ করেন, তাহলে তা দুশ্চিন্তার বিষয় হবে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের ব্যাপারে তার মনোভাবের কথা তিনি প্রকাশ করেছেন। চীনের ওপর প্রস্তাবিত ট্যারিফের প্রসঙ্গে এই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য-বিশেষজ্ঞ বলেন, চীন বিশ্বের অন্যতম বড় রফতানিকারক দেশ। ট্রাম্প যদি তার কথামতো চীনের ওপর বড় হারে শুল্ক আরোপ করেন, তাহলে তা বাংলাদেশসহ আরও অনেক দেশের জন্য সুযোগ বয়ে আনতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে চীনের বিশাল বাজার ধরতে পারবে এসব দেশ। কারণ, এসব দেশকে তুলনামূলক কম শুল্ক দিতে হবে। অন্যদিকে, ট্রাম্প যদি তার বিশেষ কোনো বন্ধুরাষ্ট্রকে আবার শুল্ক সুবিধা দেন, তাহলে তা বাংলাদেশের জন্য চিন্তার কারণ হতে পারে বলে মনে করেন ড. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি যে কোনো দিকেই যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত কী হয়, সেটার দিকে আমাদের নজর রাখতে হবে। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি খোন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, ট্রাম্প একজন ব্যবসায়ী হওয়ায় তিনি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের জন্য ভালো হবেন। যদি চীনা পণ্যের ওপর ট্রাম্পের শুল্ক পরিকল্পনা কার্যকর করা হয়, তাহলে অনেক মার্কিন পোশাক খুচরা বিক্রেতা এবং ব্র্যান্ড পোশাক পণ্যের সোর্সিং স্থানান্তর করার চেষ্টা করবেন। এটি অন্যান্য দেশ ও একটি বড় সরবরাহকারী হিসেবে বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কমলা হ্যারিস নির্বাচিত হলেও চীনের জন্য বিদ্যমান মার্কিন শুল্ক অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। আরেক ব্যবসায়ী নেতা ও বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, প্রেসিডেন্টের পরিবর্তনে পররাষ্ট্রনীতির কোনো পরিবর্তন হবে না। তাই আমাদের ব্যবসার ওপর বড় প্রভাব ফেলবে না। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্টের একটি সুসম্পর্ক রয়েছে, যা ব্যবসায়িক সম্পর্ক সম্প্রসারণের একটি হাতিয়ার হতে পারে। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যিনিই নির্বাচিত হন, তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো পরিবর্তন হবে না। তার নির্বাচনী প্রচারণার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, তিনি করপোরেট ট্যাক্স কমিয়ে দেবেন। এতে বাজেট ঘাটতি বাড়বে। ফলস্বরূপ, মার্কিন সরকারের অন্যান্য দেশের উন্নয়ন বাজেট এবং সাহায্য হ্রাস পেতে পারে।