উপেক্ষিত দেশের জনপ্রত্যাশা

৪ নভেম্বর, ২০২৪ | ৮:০০ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

‘হেসে-খেলে জীবনটা যদি চলে যায়’-কণ্ঠশিল্পী মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকীর এই গানের মতোই যেন অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা ‘সময় উপভোগ’ করছেন। ভারতে থেকে খুনি শেখ হাসিনা একের পর এক ষড়যন্ত্রের তীর ছুড়ছেন। আর এনজিও-মার্কা ও বয়োবৃদ্ধ উপদেষ্টারা সভা-সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে উপস্থিত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিয়ে ‘উপদেষ্টা পদ’ উপভোগ করছেন। দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন নেই, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে উৎসাহী করে তোলার উদ্যোগ নেই, গ্যাস-বিদ্যুৎ- যোগাযোগে ত্রিশঙ্কু অবস্থা; জনপ্রত্যাশা উপেক্ষা করে এনজিও এবং সুশীলের মতো উপদেষ্টারা আদেশ-উপদেশ বর্ষণ করছেন; ফলে একদিকে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি অব্যাহত রয়েছে; অন্যদিকে গণতন্ত্র পুনপ্রতিষ্ঠা ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। দীর্ঘ দিনেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা পুলিশ প্রশাসনে নিয়ন্ত্রণ ফেরেনি; বরং অভিযোগ উঠেছে ‘সর্ষের ভেতরে ভ‚ত’-এর মতো গণহত্যাকারী খুনি ও হত্যা মামলার আসামিদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করা হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একই এক শ’ হয়ে কাজ করছেন, বাকিদের বেশির ভাগই উপদেষ্টা পদ যেন উদযাপন করছেন। হাজারো ছাত্র-জনতা কী প্রত্যাশায় প্রাণ দিলেন, আমজনতা কী চায়, সঙ্কট সমাধানের উপায় কী, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলতে কী ধরনের ফাঁদ পেতেছে; সেদিকে ভ্রæক্ষেপ নেই। প্রেসিডেন্টকে সরানোর নন-ইস্যুকে ইস্যু বানিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে। দীর্ঘ ১৭ বছর ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যে দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী প্রাণ দিয়েছেন, জেল-জুলুম সহ্য করেছেন তাদের ঠেকিয়ে রাখতে কিছু শিক্ষার্থীকে দিয়ে কিং পার্টি গঠনের উসকানি দেয়া হচ্ছে। গতকালও ভারতের আদানি গ্রæপ হুমকি দিয়েছে, ৭ নভেম্বরের মধ্যে বকেয়া পরিশোধ করতে না পারলে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেবে। খুনি হাসিনা ভারতের মোদির অনুকম্পা পাওয়ার জন্য ভারতের আদানিকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে বিদ্যুৎ চুক্তি করেছিল। প্রবাদে রয়েছেÑ ‘সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়’। হাসিনার মতো নিষ্ঠুর স্বৈরশাসককে হাটিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেয়া উপদেষ্টারা নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ে ‘সময়ের কাজ সময়ে’ করার চেষ্টা করছেন না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সময়ের কাজ সময়ে করতে ব্যর্থ হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবেÑ তখন হাসিনার মতো জরুরি অবস্থা জারির পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। জরুরি অবস্থা জারি কোনো সরকারের জন্য স্বাভাবিক পরিস্থিতি হতে পারে না। জনগণের ভোটে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত সরকারের জন্য ‘হানিমুন পিরিয়ড’ নামে একটি সময় রয়েছে। হানিমুনের বাংলা প্রতিশব্দ ‘মধুচন্দ্রিমা’। পশ্চিমা সভ্যতায় নবদম্পতি একান্তে সময় কাটানোই হচ্ছে হানিমুন। জনগণের ভোটের নবনির্বাচিত সরকারের প্রথম ১০০ দিনকে অভিহিত করা হয় হানিমুন পিরিয়ড। এ সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, জানা-শোনা, ভুলত্রæটি শুধরানোর সময় দেয়া হয়। নির্বাচিত সরকারের জন্য হানিমুন পিরিয়ড কার্যকর হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য ‘হানিমুন’ প্রযোজ্য নয়। কারণ অল্প সময়ের মধ্যে এ ধরনের সরকারকে সব কিছু করতে হয়। এমনকি তত্ত¡াবধায়ক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকে ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করার ইতিহাস রয়েছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নিয়েছে ৮ আগস্ট। ক্যালেন্ডারের হিসাবে বর্তমান সরকার ৮৬ দিন পেরিয়ে ৮৭ দিনে পড়েছে। ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ৯০ দিনের মধ্যে প্রশাসনের দৈনন্দিনের কাজের সুরাহা করে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করেছিল। তাহলে ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার ৮৭ দিনে কতদূর এগুলো? অন্তর্বর্তী সরকার কয়েকটি সেক্টর সংস্কারের লক্ষ্যে কমিশন গঠন করেছে। এ সরকারে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এককভাবে সাফল্য দেখালেও বেশির ভাগ উপদেষ্টা সেমিনার-সিম্পোজিয়াম এবং সুশীল চেতনায় ভাবমূর্তি গড়তে ব্যস্ত। এ যেন বিপ্লবের সঙ্গে মশকরা। জনপ্রত্যাশা উপেক্ষা করে নন ইস্যুকে ইস্যু বানিয়ে গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের ফলোয়ার বাড়াচ্ছেন। বাস্তবে এ সময়ে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে ব্যাংকিং সেক্টরে দুর্গতি কমানো এবং রিজার্ভের ‘নি¤œগতি’ ঠেকানোর সাফল্য ছাড়া দৃশ্যমান কী হয়েছে? ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা পাহাড়সম। সরকার সেই জনপ্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করতে পারছে? দিল্লিতে আশ্রয় নেয়া পলাতক শেখ হাসিনা ভারতের চাণক্যনীতি কৌশলে অন্তর্বর্তী সরকারকে কাবু করতে একের পর এক ষড়যন্ত্রের তীর ছুড়ছেন। উপদেষ্টারা কি সেটা টের পাচ্ছেন না? ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনামলে মন্ত্রিসভার সব সদস্য যেমন ‘হাসিনাই সব সমস্যার সমাধান’ করবেন মানসিকতায় ¯্রােতে গা ভাসিয়ে দেশের সর্বনাশ করেছেন; অন্তর্বর্তী সরকারের তিন-চারজন উপদেষ্টা ছাড়া অন্য সব উপদেষ্টাই যেন সেই ‘চেতনা’ ধারণ করেছেন। তাদের ভাবখানাÑ সব কিছু প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস করবেন। ড. ইউনূস যদি সব কিছু করেন তাহলে রাষ্ট্রের লাখ লাখ টাকা খরচ করে আপনাদের উপদেষ্টা পদে রাখার প্রয়োজনীয়তা কি? মোদির ঘরে আশ্রয় নেতা খুনি হাসিনার বাংলাদেশ-বিরোধী ষড়যন্ত্র থেমে নেই। উপদেষ্টাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ উজান-ভাটির দেশ। মানুষের মন সাগরের ¯্রােতের মতো। জনতার ¯্রােত কখন কোনদিকে ধাবিত হয় বলা মুশকিল। ৮ আগস্ট দ্বিতীয় স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে সরকার গঠিত হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছেÑ এ সময়ে সরকার জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা কতটা পূরণ করতে পারছে? শুরুতে আমজনতার মধ্যে যে আশা জেগেছিল, সেটি কতটা ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে। ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারকে কাবু করতে দিল্লি থেকে ফ্যাসিস্ট হাসিনা জুডিশিয়াল ক্যু, সংখ্যালঘু নির্যাতনসহ কয়েকটি কার্ড ছুড়েছে। অতপর গার্মেন্টসে বিশঙ্খলা ও পাহাড়ে অশান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর মনে করা হয়েছিল, হাসিনা দমে গেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের গার্মেন্টস মালিকদের ষড়যন্ত্রে নতুন করে মীরপুরে গার্মেন্টসে বিশৃঙ্খলায় তথাকথিত শ্রমিকদের সেনা-পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, সাত কলেজের আন্দোলন, ইসকনের হঠাৎ আট দফার দাবি নিয়ে দেশ কাঁপানোর ষড়যন্ত্র, জাতীয় পার্টিকে অফিসে অগ্নিকাÐসহ একের পর এক বিশৃঙ্খল ষড়যন্ত্র চলছে। হাসিনা গতকালও বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘আজকের অবরুদ্ধ বাংলাদেশ কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে পরিণত হয়েছে।’ হাসিনার বিবৃতি ভারতীয় গণমাধ্যম প্রচার করেছে। সাবেক ক‚টনীতিক সাবিক আলী বলেছেন, ‘বাংলাদেশ নিয়ে ভারত সরকার ও সে দেশের গণমাধ্যমের অপপ্রচারের জবাব দেশের গণমাধ্যম দিতে পারত। দেশের গণমাধ্যমগুলোতে সেভাবে সরকার ব্যবহার করতে পারছে না। এমনকি সরকারের মালিকানাধীন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা, বিটিভি নীরব দর্শকের ভ‚মিকা পালন করছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টারা এ ব্যাপারে উদ্যোগী হলে ভারতকে পাল্টা জবাব দেয়া যেতো।’ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে পাহাড়সম প্রত্যাশার সমান্যতম না পাওয়ায় মানুষের মধ্যে অস্থিরতা এবং হতাশা বাড়ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এ সুযোগ নিয়ে হাসিনার অলিগার্ক বুদ্ধিজীবীরা অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। তারা ‘আগের সরকারই ভালো ছিল’ প্রচার করছেন। কিন্তু কি করছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা? ভারত গণহত্যাকারী হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে। হাসিনার মতো খুনিকে আশ্রয় দেয়ার পরও ভারতের গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশ নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। ‘হাসিনাকে ভারতে রাখতে হলে কথা বলতে দেয়া যাবে না’ প্রধান উপদেষ্টার এমন বক্তব্যের পরও ভারতের মোদি সরকার হাসিনার মুখ বন্ধ করেনি। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি করছে? পররাষ্ট্র উপদেষ্টার কথা বলার স্টাইল ও ‘বডি লেঙ্গুয়েজ’ দেখে মনে হয় উনি ‘এতিম’ হিসেবে অসহায়ত্ব প্রকাশ করছেন। তিনি কি ভারতকে এমন মিথ্যা প্রচারণা থেকে বিরত থাকতে ক‚টনৈতিক চ্যানেলে সতর্কবার্তা দিয়েছেন? বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশের দূতাবাস মিশনগুলোকে ভারতীয় অপপ্রচারের বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন? হিন্দু ইস্যুসহ নানা ইস্যুতে ভারত যে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে তিনি কী উদ্যোগ নিয়েছেন? হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ওয়াশিংটন ডিসির লবিং ফার্ম ‘স্ট্রেক গেøাবাল ডিপ্লোম্যাসিকে’ নিয়োগ করেছেন কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে। সেই লবিস্ট ফার্ম মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে ট্রাম্পকে দিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে টুইট করাচ্ছেন তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন? অস্বীকার করার উপায় নেই, অন্তর্বর্তী সরকার যখন দায়িত্ব গ্রহণ করে, তখন দেশে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। অর্থনীতিকে পঙ্গু করা হয়েছিল। দুর্নীতি করে বিদেশে টাকা পাচার করায় ডলার সঙ্কটে সব ধরনের পণ্যমূল্য বেড়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, জনপ্রশাসন, শিক্ষাঙ্গন, পরিবহন, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পকারখানা, বিদ্যুৎ, দ্রব্যমূল্য, স্বাস্থ্যসেবা সর্বত্র বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য চলছিল। সেই অবস্থা থেকে দেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসা কঠিন কাজ। এ জন্য প্রয়োজন ছিল অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি ও মেধাবীদের সমন্বয়ে একটি দক্ষ উপদেষ্টা পরিষদ। কিন্তু চট্টগ্রাম ও এনজিওকেন্দ্রীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করায় সরকার যেন ত্রিশঙ্কু অবস্থায় পড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক পরিমÐলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি এবং গ্রহণযোগ্যতাও ব্যাপক। জাতিসংঘের ৭৯তম অধিবেশনে সেটি দেখা গেছে। ওই অধিবেশন ‘ইউনূসময়’ হয়ে উঠেছিল। সরকার একজনকে দিয়ে চলে না। সরকার চালানোর জন্য যাদের উপদেষ্টা করা হয়েছে তাদেরও সমানতালে চলার সামর্থ্য, সদিচ্ছা ও মন্ত্রণালয় চালানোর দৃঢ়তা থাকতে হয়। অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসনিক কাজে অভিজ্ঞতার অভাব ও দৃঢ়তা না থাকায় উপদেষ্টাদের অনেকেই হাসিনার অনুগত সচিবদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ আমলাদের নাচের পুতুল হয়ে মন্ত্রণালয়ে আসা-যাওয়া করছেন। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টালে দেখা যায়, নির্বাচিত সরকারগুলোর মন্ত্রিসভা ৪০ থেকে ৫০ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী নিয়ে গঠিত হতো। তার বাইরেও ছিল বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ভিত্তিক উপদেষ্টামÐলী। অন্তর্বর্তী সরকারে উপদেষ্টা পরিষদে আছেন মাত্র ২১ জন। এর বাইরে বিশেষ সহকারী আছেন দুজন। প্রধান উপদেষ্টার টিম হওয়ার কথা দক্ষ, অভিজ্ঞ ও উদ্যমী। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি, উপদেষ্টা পরিষদের অনেকেরই রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাজের অভিজ্ঞতার অভাব অনেকেই বয়সের ভারে চলাফেরা করতে পারেন না। আবু সাঈদ, মুগ্ধরা বন্দুকের সামনে বুক পেতে দিয়েছিল স্বৈরতান্ত্রিক ধারা ঝেটিয়ে বিদায় করে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে। সেই সঙ্গে চেয়েছে প্রশাসনিক কাজে নাগরিকের দৈনন্দিন সমস্যার সমাধান। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার প্রথমেই হোঁচট খায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে। পুলিশ অফিসারদের বেশির ভাগই হাসিনার একান্ত অনুগত ছিল। তারা অন্যায়-অত্যাচার-ঘুষ-দুর্নীতি করে টাকার পাহাড় গড়েছে। গ্রেফতারের ভয়ে তারা কাজে যোগদান না করে পালিয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে প্রথমে একজনকে দিয়ে পরে বেটার প্রত্যাশায় অরেকজনকে দেয়া হলো। সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দায়িত্ব নিলেও কথা বলতেই তার শরীর কাঁপে। দীর্ঘ আড়াই মাসেও তিনি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পারেননি। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার কারণে সরকার সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত করে। সেনা, বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশের সমন্বয়ে যৌথ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। সেনা সদস্যদের বিচারিক ক্ষমতাও দেয়া হয়। বাস্তবতা হচ্ছেÑ জানমালের নিরাপত্তাহীনতায় উদ্বিগ্ন জনগণ আশ্বস্ত হতে পারছে না। যিনি এক মন্ত্রণালয় চালাতে পারছেন না তাকে আবার দেয়া হয় কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব! হাসিনা রেজিমে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের মাত্রা ভয়াবহ রূপ নেয়। অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর অর্থনীতি ও ব্যাংকিং খাতে কিছু শক্ত পদক্ষেপ নেয়ায় শৃঙ্খলা ফিরে আসতে শুরু করেছে। প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠানোয় রিজার্ভ এখন ঊর্ধ্বমুখী। অর্থ উপদেষ্টাকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য সেক্টরে লেজেগোবরে অবস্থা। অর্থনীতির মূল যে চালিকাশক্তি বেসরকারি খাতের সঙ্গে সরকারের আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেননি। যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টাও নিজের সক্ষমতা দেখাতে পারেননি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্রাইব্যুনালে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলেও আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নানা কারণে বিতর্কিত। তার অবস্থা ‘দুদিনের যোগী হয়ে ভাতকে বলে অন্ন’ প্রবাদের মতোই। তাকে সংস্কৃতি ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়ায় ওই মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলোতে তিনি তথাকথিত প্রগতিশীল ও ভারতীয় চেতনাধারীদের দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি জামায়াতের লোকজনকে কিছুটা গুরুত্ব দিলেও বিএনপি সমর্থিত সাংবাদিকদের প্রতি উষ্মা প্রকাশ করেন। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা এনজিওর বাইরে বের হতে পারছেন না। তিনি সভা-সেমিনার আর কথার ফুলঝুড়ি ছড়ানোয় ব্যস্ত। ২০০৩ সালে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থাকা মুক্তিযুদ্ধের সময়ের চার খলিয়ার একজন শাহজাহান সিরাজ পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করেছিলেন। এখন পরিবেশ উপদেষ্টার পলিথিনের ব্যবহার বন্ধের উদ্যোগও প্রশংসার দাবিদার। সমাজ-কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কাজকর্মেও গতিহীন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যাকে দেয়া হয়েছে তিনি নাকি স্বাস্থ্য সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতাদের এ অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণের কোনো চেষ্টা দেখা যায়নি। শিক্ষা উপদেষ্টা বয়সের কারণে অফিস করতে পারেন না। তিনি নাকি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তাকে না দেয়ার অনুরোধ করেছিলেন। ধর্ম উপদেষ্টা পদে যাকে দেয়া হয়েছে তার ভ‚মিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। নিয়োগ-বদলিতে তার একাধিক সিদ্ধান্ত প্রতিরোধের মুখে পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে হজ ইস্যুতে তার ভ‚মিকা প্রশংসা পেয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদে ছাত্র আন্দোলন থেকে আসা দুই তরুণ সদস্যের তৎপরতাও দৃশ্যমান। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই দুই সমন্বয়কের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও তারা নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ে কাজের গতি এনেছেন। ২০১ সালে তত্ত¡াবধায়ক সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ২৪ ঘণ্টার অর্ধেক সচিবকে বিদায় করে দিয়েছিলেন। হাসিনার অনুগত সচিবদের দিয়ে প্রশাসন গতিশীল করা সম্ভব নয়, সে কারণে এটি করা হয়েছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ প্রায় তিন মাস হতে চলল। এখনো হাসিনার অনুগত আমলা, পুলিশ কর্মকর্তারা বহাল তবিয়তে। প্রশাসনে রদবদল করা হয়েছে নামে মাত্র। জেলা প্রশাসন নিয়োগ দিতে গিয়ে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। পুলিশ প্রশাসন এখনো স্বাভাবিক হয়নি। দেশের ব্যবসায়ী সমাজ এখনো আস্থাহীনতায়। নন-ইস্যুকে ইস্যু বানিয়ে উপদেষ্টাদের কেউ কেউ আলোচনায় রয়েছেন। এ অবস্থায় একের পর এক অনাকাক্সিক্ষত সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। উপদেষ্টারা সাধারণ মানুষের কাছে গেলে বুঝতে পারতেন, তারা কতটা কষ্টে আছেন। উপদেষ্টাদের উচিত সচিবালয়ে নিজেদের বন্দি না রেখে এবং সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে কথা না বলে জনগণের কাছে যাওয়া, মন্ত্রণালয়ের অধীন সব প্রতিষ্ঠানকে সচক্ষে দেখা। ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’-(কুসুমকুমারী দাশ)। কবির মতোই বলতে হচ্ছে- অন্তর্বর্তী সরকারে উপদেষ্টারা কথায় না বড় হয়ে কবে কাজে বড় হবে সেটি দেখার জন্য মানুষ মুখিয়ে রয়েছে।