তিতাসের গলার কাঁটা ৪০ হাজার গ্রাহক

২৫ অক্টোবর, ২০২৪ | ১১:০৭ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

আবাসিক খাতে গত এক যুগ ধরে আত্মস্বীকৃত অবৈধ গ্যাস ব্যবহারকারী গ্রাহকদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। এসব গ্রাহক এখনো বাসাবাড়িতে অনুমোদন ছাড়াই গ্যাস ব্যবহার করছেন। বিষয়টি তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ, পেট্রোবাংলা ও জ্বালানি বিভাগ জানলেও এসব গ্রাহকের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কার্যত কোনো উদ্যোগ নেই। তিতাস সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে আবাসিক খাতে আত্মস্বীকৃত অবৈধ গ্যাস ব্যবহারকারী গ্রাহকের সংখ্যা ৪০ হাজার ৫০০। এসব গ্রাহক সবাই ডাবল বার্নারের চুলা ব্যবহার করেন। এই পরিমাণ চুলায় মাসে ২৪ লাখ ৩০ হাজার ঘনফুট গ্যাস অবৈধভাবে ব্যবহার হয়। ডাবল বার্নারের প্রতি চুলার বর্তমান মাসিক বিল ১০৮০ টাকা। এ হিসাবে প্রতি মাসে এসব অবৈধ চুলার বিপরীতে তিতাসের লোকসান ৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। বছরে লোকসান ৫২ কোটি টাকা। ২০১৩ সাল থেকে এসব গ্রাহক অবৈধ গ্যাস সংযোগ ব্যবহার করছেন। সে হিসাবে গত ১২ বছরে তিতাসের ক্ষতি হয়েছে ৬২৯ কোটি টাকা। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার এ প্রসঙ্গে বলেন, আবাসিকে কোনো সংযোগ হবে না, এটা সরকারের সিদ্ধান্ত। তাই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারব না। তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ বলেন, এসব আত্মস্বীকৃত অবৈধ আবাসিক গ্রাহকরা এক যুগ ধরে গ্যাস ব্যবহার করছেন। এজন্য আমাদের কোটি কোটি টাকার গ্যাস অপচয় হচ্ছে; কিন্তু আমরা টাকা পাচ্ছি না। তিনি বলেন, বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৪০ হাজার আত্মস্বীকৃত অবৈধ গ্যাস ব্যবহারকারী গ্রাহক রয়েছেন। এ বিষয়ে আমরা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে জানাব। সেখান থেকে সিদ্ধান্ত আসার পর পরবর্তী করণীয় ঠিক করব। তিতাস সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে গ্যাস আইন পাস করে। ওই বছরের ১৩ জুলাই থেকে তৎকালীন সরকার আবাসিক খাতে নতুন গ্যাস সংযোগ দেওয়া বন্ধ করে দেয়। তখন বলা হয়েছিল চাহিদা ও সরবরাহের ব্যবধান ছিল ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট। ওই সময় দেশে গ্যাস উৎপাদন হতো ১ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। গ্যাস উৎপাদন ২ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট অতিক্রম করলে নতুন সংযোগ দেওয়া হবে। ২০১৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তৎকালীন সরকারের নির্দেশে আবাসিকে গ্যাস সংযোগ বন্ধ ছিল। জানা গেছে, আবাসিক খাতে গ্যাসের সংযোগ সরকার বন্ধ করে দিলেও তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও ঠিকাদারদের সহযোগিতায় ব্যাপক হারে অবৈধ সংযোগ দেওয়া হয়। ২০১০ সালের ১৩ জুলাই থেকে ২০১৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত আবাসিকে ৫৭ হাজার ৪১৪টি অবৈধ সংযোগ দেওয়া হয়। অবৈধ এসব সংযোগের বিপরীতে ২০১১-১২ অর্থবছরে ১১৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা হলেও বৈধ না হওয়ায় ওই টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হয়নি। পরে সরকার ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে অবৈধ আবাসিক গ্যাস সংযোগ বৈধ করার সুযোগ দেয়। সারা দেশের অবৈধ গৃহস্থালির গ্যাস সংযোগ বৈধ করতে ওই বছরের ২০ জুন পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়। গ্যাস বিপণন নীতিমালা-২০০৪ অনুযায়ী ফ্ল্যাট রেটে এক বছরের বিল ও তিন মাসের বিলের সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা দিয়ে অবৈধ সংযোগ বৈধ করা যাবে বলে জানানো হয়। পেট্রোবাংলা থেকে বলা হয়, সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ২০ জুনের মধ্যে যেসব অবৈধ গ্রাহক স্বেচ্ছায় পেট্রোবাংলাকে জানাবেন, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। তাদের কাউন্টার পার্ট দেওয়া হবে। ভিজিলেন্স টিম বা মোবাইল কোর্ট অভিযান পরিচালনার সময় গ্রাহকরা এ কাউন্টার পার্ট প্রদর্শন করলে তার বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। কিন্তু সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়ের ভেতর মাত্র ১৬ হাজার ৯১৪টি অবৈধ সংযোগ বৈধ করা হয়। এদিকে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার সারা দেশে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ অভিযান জোরদার করে। দেশের সব বিতরণ কোম্পানির মধ্যে তিতাসে অবৈধ সংযোগের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। গত ৮ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত আবাসিক খাতে ৫ হাজার ১৭০টি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে তিতাস কর্তৃপক্ষ। আর বিচ্ছিন্নকৃত বার্নারের সংখ্যা ১৪ হাজার ৫০টি। অপসারণ করা অবৈধ পাইপলাইনের দৈর্ঘ্য ২৮ কিলোমিটার। এতে দৈনিক ২৩ লাখ ৬০ হাজার ৪০০ ঘনফুট সাশ্রয় হয়েছে। আর টাকার অঙ্কে দৈনিক সাশ্রয় হয়েছে ৫ লাখ ৫ হাজার ৮০০ টাকা। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতার আসার পর তিতাস কর্তৃপক্ষ সবচেয়ে বড় অভিযান পরিচালনা করে সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের পৈতৃক ও নির্বাচনী এলাকা কেরানীগঞ্জে। গত ৮ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত সেখানে অভিযানে ৮৩টি বাণিজ্যিক ও শিল্পের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। আবাসিকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে ৩৩ সংযোগ। তিতাসের কর্মকর্তারা জানান, তিতাসের একটি এলাকা থেকে এতগুলো অবৈধ শিল্প ও বাণিজ্যিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ঘটনা এটাই প্রথম। সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা হওয়ার কারণে বিগত সরকারের আমলে কেরানীগঞ্জে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ অভিযান চালাতে পারেনি তিতাস কর্তৃপক্ষ।