সিনওয়ারের মৃত্যু: এখন কোন কৌশলে হাঁটবেন নেতানিয়াহু?

২৪ অক্টোবর, ২০২৪ | ৭:৫৩ অপরাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারের মৃত্যু ইসরাইলের জন্য একটি বড় বিজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ তিনি হামাসের শীর্ষ নেতাদের একজন ছিলেন এবং ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন। তাকে হত্যার পর ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কৌশলে সম্ভাব্য পরিবর্তন আনলেও তা অবিলম্বে ঘটবে- এমনটা বলা যাচ্ছে না। তবে তার মৃত্যুর পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। নেতানিয়াহুর সামনে এখন বহু চ্যালেঞ্জ। সিনওয়ারের মৃত্যুর ফলে কূটনৈতিক আলোচনা, যেমন- বন্দিদের মুক্তির সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। তবে ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে এবং লেবাননের হিজবুল্লাহর সঙ্গে সংঘাতের বিস্তৃত চিত্রে তাৎক্ষণিক কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। উভয় পক্ষই এখনও নিজেদের অবস্থানে অটল। ইসরাইল তার সামরিক অভিযান অব্যাহত রেখেছে এবং হিজবুল্লাহও সংঘাতে আরও জড়িত হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। এর পাশাপাশি নেতানিয়াহুকে আঞ্চলিক দিকটাও বিবেচনায় নিতে হবে। বিশেষ করে ইরানের হামাস ও হিজবুল্লাহর প্রতি সমর্থন এবং লেবাননে সংঘাতের বিস্তারের সম্ভাবনা। আন্তর্জাতিক নেতাদের, যেমন- মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের চাপ সত্ত্বেও যারা সিনওয়ারের মৃত্যুকে কূটনৈতিক সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে ইসরাইলি সরকারের বর্তমান অবস্থান সামরিক উদ্দেশ্যগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়ার দিকেই ইঙ্গিত করছে। সুতরাং সিনওয়ারের মৃত্যু গুরুত্বপূর্ণ হলেও তাৎক্ষণিকভাবে ইসরাইলি কৌশলকে নরম করার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। নেতানিয়াহুর সরকার আপাতত তাদের অভিযান চালিয়ে যাওয়ার দিকে মনোযোগী বলে মনে হচ্ছে। এদিকে ইয়াহিয়া সিনওয়ারের মৃত্যুর পর ইসরাইলের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা চলছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস সিনওয়ারের মৃত্যুর প্রশংসা করেছেন। এ ঘটনাকে বিশ্বের জন্য একটি নিরাপত্তা বৃদ্ধির পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। বাইডেন এর আগে সিনওয়ারকে যুদ্ধবিরতি আলোচনার পথে একটি প্রধান বাধা হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। তবে অনেক বিশ্লেষক এবং কর্মকর্তার মতে, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুও আলোচনার পথে বাধা সৃষ্টি করেছেন। পশ্চিমা শক্তিগুলো সিনওয়ারের হত্যাকাণ্ডকে একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে দেখছে। যা নেতানিয়াহুর কট্টর ডানপন্থি সরকারকে রাজনৈতিক সমর্থন দেবে এবং বলবে যে তাদের লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। তবে ইসরাইল এখনও হামাসকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার লক্ষ্য নিয়ে অটল রয়েছে। যাতে তারা একটি সামরিক শক্তি ও গাজার শাসন ব্যবস্থার অংশ হিসেবে বিদ্যমান থাকতে না পারে। এদিকে হামাসও যুদ্ধ বন্ধ ও গাজা থেকে ইসরাইলের সেনা প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত বন্দিদের মুক্তি দিতে অস্বীকার করছে। হামাস মূলত নেতৃত্ব কেন্দ্রিক নয়, ফলে সিনওয়ারের মৃত্যুর পর তারা দ্রুত নতুন নেতা নির্বাচন করতে পারবে। আর এ কারণে অনেকেই মনে করছেন, সিনওয়ারের মৃত্যু হামাসের যোদ্ধাদের মনোবল আরও বাড়িয়ে তুলবে এবং নতুন যোদ্ধা নিয়োগের প্রচেষ্টাকে আরও শক্তিশালী করবে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, হামাসের নেতৃত্বের একটি বড় অংশকে ধ্বংস করে দেওয়া ও বড় ধরনের সামরিক ক্ষতি করে ইসরাইল এখন তাদের অভিযান আরও জোরদার করতে পারে। সিনওয়ারের মৃত্যুর পরও ইসরাইল ও তার শত্রুপক্ষের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত অব্যাহত রয়েছে। ইরান, হামাস, হিজবুল্লাহ এবং ইসরাইল এই সংঘাতের অবস্থা থেকে নিজেদের জন্য উপকার পাওয়ার প্রত্যাশায় আছে। ফলে এটি একটি সহনশীলতার পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইরানের কৌশলগত লক্ষ্য হলো ইসরাইলের সম্পদগুলোকে নিঃশেষ করে ফেলা। ইরান বিভিন্ন ফ্রন্ট খুলে ইসরাইলকে একাধিক দিক থেকে চাপে ফেলেছে। লেবানন, ইয়েমেন ও ইরাক থেকে সংঘাত বাড়ানোর মাধ্যমে ইসরাইলকে ক্লান্ত করা এবং গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ তৈরি করা হচ্ছে। এ বিষয়ে নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষা বিষয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান INEGMA মিডল ইস্টের প্রধান নির্বাহী ও সামরিক বিশেষজ্ঞ রিয়াদ কাহওজি বলেছেন, ইরান এই সংঘাতের মাধ্যমে ইসরাইলকে ক্লান্ত করার কৌশল ব্যবহার করছে। গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে ইরানের উদ্দেশ্য হলো ইসরাইলের সম্পদকে নিঃশেষ করা। তারা বিভিন্ন ফ্রন্ট খুলে ইসরাইলকে অবরুদ্ধ করার চেষ্টা করছে এবং গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। কাহওজি আরও বলেন, অর্থনৈতিক সংকটসহ ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাগুলো তাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করছে। তিনি মনে করেন, ইরানের জন্য লেবানন বা হিজবুল্লাহর ক্ষয়ক্ষতি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ এটি কেবল আরেকটি যুদ্ধক্ষেত্র, যেখানে ইরান সরাসরি জড়িত নয়। লেবানন ইরানের কাছে কৌশলগত দিক থেকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ না হলেও, হিজবুল্লাহ একটি প্রধান মিলিশিয়া গোষ্ঠী হিসেবে ইরানের হয়ে যুদ্ধ করে চলেছে। এদিকে হিজবুল্লাহ লেবাননের সীমান্তে ইসরাইলি বাহিনীকে প্রতিরোধ করে চলেছে। ইসরাইলও হিজবুল্লাহর শক্ত ঘাঁটিতে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের স্থলবাহিনী মোতায়েন করেছে। ইসরাইল ২০২৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে লেবাননে তাদের সামরিক কার্যক্রম বাড়িয়ে দিয়েছে এবং তারা হিজবুল্লাহর শক্ত ঘাঁটিগুলোতে বিমান হামলা চালাচ্ছে। ইসরাইলের স্থলবাহিনীও লেবাননের অভ্যন্তরে অভিযান চালিয়েছে, যেখানে অন্তত ১,৫৫২ জন নিহত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পশ্চিমা এবং আরব দেশগুলো চলমান এই সংঘাত নিরসনের জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে শান্তি প্রতিষ্ঠার আশা ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। মার্কিন বিশেষ দূত আমোস হকস্টেইনের মত কূটনৈতিক প্রতিনিধিরা লেবানন সফর করেছেন। এই সংঘাতের স্থায়ী সমাধানের জন্য কাজ করছেন। তবে হকস্টেইন উল্লেখ করেছেন যে, কেবল পূর্ববর্তী জাতিসংঘের রেজুলেশন অনুযায়ী কাজ করলে তা যথেষ্ট হবে না। অন্যদিকে গাজায় ইসরাইলের দীর্ঘমেয়াদী কৌশল এখনও অস্পষ্ট। তারা হামাসকে ধ্বংস করতে মনোযোগ দিচ্ছে। তবে নেতানিয়াহুর পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নেই। কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, একটি আদর্শ পরিস্থিতিতে সম্ভবত মিশরের নেতৃত্বে একটি আরব জোট হয়তো এর নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে। তবে এই মুহূর্তে তা অসম্ভব মনে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা ও আরব দেশগুলো সংঘাত নিরসনের জন্য চাপ দিলেও শান্তি প্রতিষ্ঠার আশা খুবই ক্ষীণ। মোটকথা, ইয়াহিয়া সিনওয়ারের মৃত্যু হয়তো একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটিয়েছে। তবে ইসরাইলের দীর্ঘমেয়াদী সামরিক ও কৌশলগত লড়াই এখনও বহাল তবিয়তে আছে।