ভারতের ভিসা নীতি কি ইউনূস সরকারের ওপর কূটনৈতিক চাপ?
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার যে সম্পর্ক ছিল সেখানে বড় ধরনের ছন্দপতন ঘটেছে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর। অভ্যুত্থান পরবর্তী অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার প্রায় আড়াই মাস পার করলেও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে বরফ গলার কোনো ইঙ্গিত মিলছে না। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ভিসা আবেদন কেন্দ্রগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় ভিসা সেন্টারগুলো বন্ধ থাকার পর সীমিত পরিসরে কার্যক্রম শুরু হলেও ভারত জানিয়ে দিয়েছে যে চিকিৎসার জন্য ভিসা এবং কিছু জরুরি প্রয়োজন ছাড়া অন্যান্য ভিসা তারা ইস্যু করবে না। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে সীমিত পরিসরে ভিসা আবেদন কেন্দ্র খুলে দেওয়া হয়। এরপর ১৬ আগস্ট ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কেবল সীমিত পরিসরে জরুরি ও মেডিকেল ভিসা ইস্যু করবে ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশন। একটি দেশের সঙ্গে আরেকটি দেশের কূটনীতিক সম্পর্ক কতোটা জোরালো সেটি প্রকাশ পায় ভিসা নীতির মাধ্যমে। সেজন্য স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠেছে, ভিসা দেওয়া ব্যাপকভাবে সীমিত করার মাধ্যমে ভারত কি বাংলাদেশের নতুন সরকারের ওপর কূটনৈতিক চাপ তৈরি করতে চাচ্ছে? ডিপ্লোম্যাটিক সিগন্যাল বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির মনে করেন, বর্তমান সরকারের ওপর কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের অংশ হিসেবে ভারত ভিসা ইস্যু ব্যবহার করছে। তিনি বলছেন, ভারতের দিক থেকে এটা একটা বার্তা যে তারা সম্পর্ককে স্বাভাবিক মনে করছে না। এটা হচ্ছে একটা ডিপ্লোম্যাটিক সিগন্যাল। তবে ভারতের দিক থেকে কখনো স্বীকার করা হয়নি যে কূটনীতিক চাপের অংশ হিসেবে ভিসা ইস্যু করা সীমিত করা হয়েছে। ভারতে বরাবরই বলছে, এ বিষয়টির সঙ্গে নিরাপত্তার বিষয় জড়িত। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বৃহস্পতিবার নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশে যখন স্বাভাবিক কাজকর্ম করার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো হবে তখন ভারত পুরোপুরি কাজ শুরু করবে। একথা ভারতের দিক থেকে এর আগেও বলা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে তিনি আবারও উদ্বেগ তুলে ধরেন। এসময় তিনি আরও বলেন, সদ্য সমাপ্ত দুর্গাপূজায় আমরা যে রকম দেখলাম বিভিন্ন পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনা ঘটল, আমরা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে মনে করিয়ে দেব তাদের অঙ্গীকারের কথা – সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার কথা, তারা যাতে নিশ্চিন্তে ধর্মীয় আচরণ পালন করতে পারেন। ভারতের জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বাংলাদেশ নিয়ে চর্চা ও গবেষণা করছেন বহু বছর ধরে। শ্রীরাধা দত্ত বলেন, নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে ভারতের দিক থেকে উদ্বেগ রয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শেখ হাসিনার শাসনামলে এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। আমাদের স্বাভাবিক একটা ভয় থাকে নন-আওয়ামী, নন-হাসিনা হলে সিচুয়েশনটা ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত মনে আছে বাইল্যাটারাল সম্পর্ক কতটা বাজে ছিল। তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পরে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের মধ্যে উদ্বেগ আছে। নিরাপত্তার বিষয়টি অজুহাত ভারতের দিক থেকে নিরাপত্তার ইস্যুটি সামনে আনা হলেও ঢাকায় অন্যান্য বিদেশি দূতাবাসগুলোর তরফ থেকে নিরাপত্তা নিয়ে প্রকাশ্যে এ ধরনের কোনো উদ্বেগ দেখা যায়নি। পাঁচ আগস্টের আগে ও পরে বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের অনেক কর্মী ঢাকা ছেড়ে গেলেও একমাসের মধ্যে তারা আবারও ফিরে এসেছে এবং ভিসা ইস্যু সংক্রান্ত কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু করেছে। ঢাকাস্থ বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাসের সামনে নিরাপত্তা জোরদার রয়েছে এবং কোথাও কোথাও সেনা সদস্যরা নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে। ভিয়েনা প্রটোকল অনুযায়ী বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর দূতাবাস এবং কূটনীতিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্বাগতিক দেশে বাধ্য থাকে। অন্যান্য দেশগুলোর দূতাবাস নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন না থাকলেও ভারতের এতো অস্বস্তি কেন? শ্রীরাধা দত্ত বলছেন, পাঁচ আগস্ট থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত পার হয়ে বহু মানুষ ভারতে ঢুকেছে। স্বাভাবিকভাবে এটা তো আমাদের একটা কনসার্ন দাঁড়ায় না? ডমেস্টিক সিচুয়েশনটা তো সেভাবে স্ট্যাবল না। বাংলাদেশিরা নিজেরাই আশঙ্কায় আছে। নিরাপত্তার বিষয়টিকে তারা এক্সকিউজ (অজুহাত) হিসেবে তুলে ধরছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ও দূতাবাসের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা বাংলাদেশের সরকারের পক্ষে অসুবিধা হবার কথা নয়। গত আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সীমিত পরিসরে ভিসা অ্যাপ্লিকেশন সেন্টার খোলার পর ঢাকায় ভারতীয় ভিসা কেন্দ্রে বিক্ষোভ করেন অনেকে। বিক্ষোভের পর নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। সেখানে সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট মোতায়েন করেছে সরকার। ভারতের পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়া এবং পালিয়ে যাবার বিষয়টি ভারতের মধ্যে একটা ‘সেট ব্যাক’ বা ‘আঘাত’ হিসেবে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে ভারতের সরকার তো বটেই, এমনকি বিভিন্ন পেশাজীবীরাও ধাতস্থ হতে পারছেন না। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে কিছুটা সময়ের প্রয়োজন। শেখ হাসিনার এমন পরিণতি হতে পারে সেটি ভারতের হিসাবনিকাশের মধ্যে ছিল না। সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলছেন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ভারত যেসব সুবিধা পেয়েছে সেগুলোর বিষয়ে তারা এক ধরনের অনিশ্চয়তায় ভুগছে। তার ধারণা, বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতি অনুধাবন করতে কিংবা মানিয়ে নিতে ভারতের সময় লাগছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা প্রথমদিকে এমন কিছু মন্তব্য করেছিলেন যেগুলো ভারত বিরোধী বলে মনে হতে পারে। হুমায়ুন কবির বলছেন, বাংলাদেশের তরফ থেকে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু সে প্রচেষ্টা ভারত কতটা আমলে নিচ্ছে সেটি এক বড় প্রশ্ন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে নিউইয়র্কে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা বৈঠক করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভারতে তাতে আগ্রহ দেখায়নি। দুদেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভারতের এক ধরনের অনিচ্ছা বা অনীহা আছে বলে মনে করছেন হুমায়ুন কবীর। তিনি বলছেন, আমার ধারণা, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টা যেসব কথা বলছেন সেগুলোকে তারা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য মনে করছেন না, কিংবা তাদের মনে করার ইচ্ছে নেই। হুমায়ুন কবির বলেন, আমাদের দিক থেকে আমরা উদ্যোগ নিচ্ছি। তাদের দিক থেকেও যে তারা উদ্যোগ নিচ্ছে না সেটা আমি বলবো না। তাদের হাইকমিশনারও বিভিন্ন জনের সঙ্গে দেখা করছে, যোগাযোগ রাখছে। বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে সেটি নিয়ে এখনো নানা বিশ্লেষণ চলছে ভারতে। ভারতের সরকার ও বিভিন্ন মহলে এক ধরনের ধারণা তৈরি হয়েছে যে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে বাংলাদেশে ইসলামপন্থিদের প্রভাব বেড়েছে। এ বিষয়ে শ্রীরাধা দত্ত বলেন, হঠাৎ করে আমরা দেখছি কত ছোট ছোট ইসলামিক দল বেরিয়ে এসেছে রাস্তায়। আমরা তো বুঝতেই পারছি না এরা কোথা থেকে জেগে উঠছে। আশঙ্কার একটা জায়গা তো নিশ্চয়ই আছে। তারপরে মাইনরিটি অ্যাটাক আছে। এসব বিষয় তো আমাদের ন্যাচারালি কনফিডেন্স দিচ্ছে না। বাংলাদেশের যেসব বিষয় নিয়ে ভারতের উদ্বেগ রয়েছে সেগুলো নিরসনের ক্ষেত্রে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ভারতকে আশ্বস্ত করেছে কি না সেটি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন শ্রীরাধা দত্ত। শ্রীরাধা দত্ত মনে করেন, দুদেশের দিক থেকে সম্পর্ক ভালো করার কোনো তাগিদ দেখা যাচ্ছে না। আমি বিশ্বাস করি দুই দেশের সম্পর্কটা এমন যে তাদের নিজেদের লোকদের ভালো করতে হলে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। ভিসা সংকটের সমাধান হবে? গত ১ অক্টোবর ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, নিউইয়র্কে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে। আমরা উভয়পক্ষ একমত হয়েছি যে আমাদের পরস্পরের সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন নিজেদের স্বার্থে। এটাতে বাংলাদেশের স্বার্থ আছে, এখানে ভারতেরও স্বার্থ আছে। দুদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে কবে নাগাদ বৈঠক হতে পারে সেটি এখনো নিশ্চিত নয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা আশা করছেন, আগামী নভেম্বরে বিমসটেক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। কিন্তু এটি প্রত্যাশা মাত্র, এখনো নিশ্চিত কিছু নয়। বাংলাদেশিদের ভারতীয় ভিসা ইস্যুর বিষয়টি নিয়ে নিউইয়র্কে তৌহিদ হোসেন এবং এস জয়শঙ্করের মধ্যে কথা হয়েছে। জয়শঙ্কর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনকে জানিয়েছেন যে, ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসে ভিসা ইস্যুর সঙ্গে যেসব কর্মকর্তা জড়িত তাদের অনেকেই ভারতে চলে গেছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জানিয়েছেন, তারা আশা করছেন যে কিছু দিনের মধ্যে ভিসা ইস্যু কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু হবে। খুব বেশি সময় হয়তো লাগবে না। তবে দিল্লিতে বিবিসির সংবাদদাতা শুভজ্যেতি ঘোষ বলেন, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় ভিসা ইস্যু কার্যক্রম দ্রুত শুরু হবার কোনো ইঙ্গিত মিলছে না। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মা ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে বলেন, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ১৬ লাখ মানুষ ভিসা নিয়ে ভারতে যাচ্ছে। এ সংখ্যা কখনও কখনও বাড়েও। তিনি তখন বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভারতীয় ভিসা সেন্টার ঢাকায় অবস্থিত এবং সমগ্র বাংলাদেশে ভারতের ১৫টি ভিসা সেন্টার রয়েছে। ভারতীয় এই হাইকমিশনার বলছেন, প্রতিদিন প্রায় ৫ হাজারের ওপরে ভিসা ইস্যু করা হচ্ছে। এ সংখ্যা বাড়ছেই। সবই করছি সাধারণ মানুষের সুবিধার্থে। দুই দেশের মধ্যে যে সম্পর্ক তা অসাধারণ ও অনন্য। তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা