মাউশি ও অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানে ১৭ কোটির অনিয়ম মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের প্রতিবেদন
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এবং এর নিয়ন্ত্রণাধীন ৩৪ সরকারি কলেজ ও পাঁচটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৪৫ খাতে প্রায় ১৭ কোটি টাকার অনিয়ম পাওয়া গেছে। মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নিরীক্ষিত প্রতিষ্ঠানগুলোর অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং সরকারি বিধিবিধান পরিপালন না করায় নানা অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে। মাউশির হিসাব সম্পর্কিত কমপ্লায়েন্স অডিট ইন্সপেকশন রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, মোট ৪৫ খাতে অনিয়ম হয়েছে ১৬ কোটি ৭১ লাখ ৭১ হাজার ৮৬৪ টাকার। তাই আপত্তিতে জড়িত অর্থ আদায়/সমন্বয়ের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে মনে করে অডিট অফিস। মাউশির নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো হলো রংপুরের সরকারি কারমাইকেল কলেজ; বগুড়ার সরকারি শেখ মজিবুর রহমান মহিলা কলেজ; নওগাঁর সরকারি মহিলা কলেজ; রাজশাহীর সরকারি নিউ গভঃ ডিগ্রি কলেজ, সরকারি কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ও সরকারি পি এন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়; নাটোরের রানী ভবানী সরকারি মহিলা কলেজ ও আব্দুলপুর সরকারি কলেজ; ঢাকা কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ ও টিকাটুলী কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়; মাদারীপুর সরকারি কলেজ; মানিকগঞ্জের সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ; গাজীপুর সরকারি মহিলা কলেজ; টাঙ্গাইলের ইবরাহীম খাঁ সরকারি কলেজ ও বিন্দুবাসিনী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়; ময়মনসিংহের সরকারি আনন্দ মোহন কলেজ। আরও রয়েছে কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল সরকারি কলেজ; জামালপুরের মেলান্দহ সরকারি কলেজ; কক্সবাজার সরকারি কলেজ; চট্টগ্রামের সরকারি সিটি কলেজ, সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ ও চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়; রাঙামাটি সরকারি কলেজ; ফেনীর সরকারি জিয়া মহিলা কলেজ; নোয়াখালীর চৌমুহনী সরকারি সালেহ আহমেদ কলেজ। এ ছাড়া রয়েছে কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ ও লাকসামের নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজ; নরসিংদী সরকারি কলেজ; নারায়ণগঞ্জের সরকারি তোলারাম কলেজ; বরিশালের সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ; খুলনার সরকারি ব্রজলাল (বিএল) কলেজ ও খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ; যশোরের সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজ, যশোর সরকারি সিটি কলেজ ও যশোর সরকারি মহিলা কলেজ; কুষ্টিয়া সরকারি মহিলা কলেজ এবং চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজ। অনিয়মের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাউশির ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইনসিটু হিসেবে কর্মরত শিক্ষকদের প্রাপ্যতার অতিরিক্ত হারে বাড়িভাড়া ভাতা দেওয়ায় সরকারের ৫৫ লাখ ৩ হাজার ২৬৩ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। মাউশির অধীন সাতটি সরকারি কলেজের ২০১৫-১৬ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে উচ্চ মাধ্যমিক থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত বিভিন্ন সেশনে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন, ভর্তি ও পুনঃভর্তি ফি বাবদ আদায়কৃত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা না করায় সরকারের ২ কোটি ১২ লাখ ৭৪ হাজার ৯৫৯ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। ১৯টি সরকারি কলেজ ও একটি স্কুলের ২০১৩-১৪ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পরিপত্র বহির্ভূতভাবে এক খাতের অর্থ অন্য খাতে এবং খাতবিহীন ক্ষেত্রে অনিয়মিতভাবে ১ কোটি ৩৯ লাখ ৩৮ হাজার ১৪৮ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে খাতভিত্তিক আদায়কৃত অর্থ খাতের জন্য নির্ধারিত ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বাইরে অনিয়মিতভাবে এফডিআর করায় অনিয়ম ৪ কোটি ২১ লাখ ৩৪ হাজার ৭২১ টাকা; ছাত্রসংসদ কার্যকরী না থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় ১ কোটি ৬৫ লাখ ৮১ হাজার ৭০৯ টাকা; নন রেসপনসিভ দরদাতাকে রেসপনসিভ দেখিয়ে অনিয়মিতভাবে ব্যয় ১ কোটি ৪১ লাখ ১৪ হাজার ৫৯৩ টাকা। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পরিপত্র বহির্ভূত খাতে এবং পরিপত্রের নির্ধারিত হার অপেক্ষা অতিরিক্ত হারে আদায় ৪৪ লাখ ৬৮ হাজার ৬৩ টাকা; সরবরাহকারীর অনুকূলে চেক/ক্রসড চেক ইস্যু না করে অধ্যক্ষ এবং অন্য ব্যক্তিদের অনুকূলে চেক ইস্যু করে অনিয়মিতভাবে ব্যয় ৫৭ লাখ ৩৭ হাজার ৭১৪ টাকা; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বিদ্যুৎ সংযোগ না নিয়ে বাণিজ্যিক হিসেবে সংযোগ নেওয়ায় এবং অতিরিক্ত ডিমান্ড চার্জ দেওয়ায় ক্ষতি ২৬ লাখ ৬ হাজার ১৯০ টাকা; আরএফকিউ পদ্ধতিতে ক্রয়ের বার্ষিক সিলিং সীমা অতিক্রম করে অনিয়মিতভাবে ব্যয় ২১ লাখ ৪৬ হাজার ৫৪৭ টাকা। নগদ ক্রয়ের নির্ধারিত সীমার ঊর্ধ্বে পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে দরপত্র আহ্বান না করে অনিয়মিতভাবে ব্যয় ২৮ লাখ ৭৩ হাজার ২৮৭ টাকা; পরিপত্রবহির্ভূত অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার খাতে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে প্রতি বিষয়/পত্রের জন্য অতিরিক্ত ফি আদায় করায় আর্থিক ক্ষতি ৩৩ লাখ ৫৫ হাজার ৩২০ টাকা; সাজানো মূল্য-সংবলিত কোটেশনের মাধ্যমে অনিয়মিতভাবে ব্যয় ১০ লাখ ৫৬ হাজার ৯৮৩ টাকা। পিপিআর ২০০৮ লঙ্ঘন পূর্বক একক কাজকে একাধিক প্যাকেজে বিভক্ত করে খণ্ড খণ্ড ভাউচারের মাধ্যমে সরবরাহকারীদের কাছ থেকে অনিয়মিতভাবে নগদে ক্রয় ৮ লাখ ৫ হাজার টাকা; প্রযোজ্য না হওয়া সত্ত্বেও ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে ‘পরিবহন’ খাতে অনিয়মিতভাবে আদায় করা হয়েছে ৫৬ লাখ ৮২ হাজার ৯১০ টাকা; ক্রয়কৃত মালপত্র স্টক রেজিস্টারে এন্ট্রি না থাকায় সরকারের ক্ষতি ২৮ লাখ ৯২ হাজার ৮৩৫ টাকা; বিভিন্ন কাজে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্তৃক গৃহীত অগ্রিম সমন্বয় করা হয়নি ২৯ লাখ ৩৬ হাজার ১৮৫ টাকা। কলেজের অভ্যন্তরে সরকারি স্থাপনায় বসবাসকারী এবং দোকানি ও হোস্টেল থেকে আদায়কৃত বিদ্যুৎ ও পানির বিল আদায় করা সত্ত্বেও সরকারি কোষাগারে জমা না করায় ক্ষতি ১৯ লাখ ৫৭ হাজার ২৪১ টাকা। মাউশির মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক এ বি এম রেজাউল করীম বলেন, আমরা বিষয়টি সম্পর্কে জানি না। অডিট অফিস থেকে আমাদের জানানো হলে বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে দিয়ে খোঁজ নেব। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যদি অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হয়ে থাকে কিংবা নামে-বেনামে অর্থ আদায় হয়ে থাকে এবং সেটি প্রমাণ হয়ে থাকলে নিশ্চিতভাবে এখানে দুর্নীতি হয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহার হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত তদন্তে প্রমাণিত হলে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। যারা দুর্নীতির সুযোগ করে দিয়েছেন, তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।