ঘুমন্ত বিবেককে জাগিয়ে দেয় যে ‘তুফান’
গ্রাফিতি কী ও এর বার্তা কতটা শক্তিশালী, তা হয়তো ৫ আগস্টের আগে অতটা জানা ছিল না দেশের মানুষের। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের রাস্তায় রাস্তায় দেয়ালজুড়ে নানা রঙে আঁকা গ্রাফিতিগুলো যে নতুন বাংলাদেশের জানান দিচ্ছে, তা আর এখন কারও অজানা নয়। এসব গ্রাফিতিতে নতুন বাংলাদেশ নিয়ে যেমন শিক্ষার্থীদের স্বপ্নগুলো মূর্ত হয়ে উঠছে, ঠিক তেমনি তাতে বিশ্বের নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের হয়ে প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গও দেখা যাচ্ছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এমনই এক গ্রাফিতি এখন সবার নজর কাড়ছে। ‘তুফান’ নামের সেই গ্রাফিতিতে রংতুলির আঁচড়ে ফুটে উঠেছে ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলি বর্বরতার কথা। ফুটে উঠেছে মুসলমানদের প্রথম কিবলা অবরুদ্ধ আল আকসা মসজিদের চিত্র। ব্যাপক সাড়া ফেলে দেওয়া এ গ্রাফিতিটি দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে লোক আসছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পাওয়ার হাউস রোডে। ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান ইসরায়েলি বর্বরতায় নীরবে কাঁদছে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। বিক্ষোভ মিছিলেও যখন কিছু হচ্ছে না, তখন অনেক দেশের রাজপথের দেয়ালগুলোও প্রতিবাদের ভাষায় মূর্ত হয়ে উঠছে। বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষ গ্রাফিতির মাধ্যমে ইসরায়েলের প্রতি তাদের ধিক্কার জানাচ্ছে। গ্রাফিতি মানেই হচ্ছে প্রতিবাদ, দেশপ্রেম, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের বার্তা। আর এর মাধ্যমে এবার ফিলিস্তিনের মানুষের প্রতি অনন্য ভালোবাসায় শামিল হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রংতুলির আঁচড়ে অসহায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের নির্মম নির্যাতন ও বর্বরতার চিত্র জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। তুফান নামের এক গ্রাফিতি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। গ্রাফিতিটি আঁকা হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের শিমরাইলকান্দি এলাকার পুরোনো পাওয়ার হাউস ভবনের দেয়ালজুড়ে। এঁকেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফরিদপুর জেলার দুজন যুবক। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ওমর ফারুক ও ফরিদপুরের উসাইদ মুহাম্মদ। দুজনই মাদ্রাসাছাত্র। ওমর ফারুক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার তাকমিল জামাত বিভাগে অধ্যয়নরত। অন্যদিকে উসাইদ মুহাম্মদ ঢাকার লালবাগের একটি মাদ্রাসা থেকে তাকমিল ফিল হাদিস (মাস্টার্স) বিভাগ শেষ করে বর্তমানে এশিয়াটিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে অধ্যয়নরত। এই গ্রাফিতি অঙ্কন করতে ৭ দিন সময় লেগেছে, যাতে ব্যয় হয়েছে ৮০ হাজার টাকা। প্রতিদিন গড়ে ৪-৫ ঘণ্টা কাজ করা হয়েছে। তবে ‘তুফান’ অঙ্কনের শেষ দুই দিন নির্ঘুম কেটেছে তাদের। গত ১০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সবচেয়ে বড় গ্রাফিতি ‘তুফান’-এর কাজ শেষ করা হয়। কাজ শেষ হওয়ার পর চিত্রকর্মটি বেশ সাড়া জাগিয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। গ্রাফিতিটি দেখতে প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থী এসে ভিড় করছেন। স্থানীয় বাসিন্দা ও দর্শনার্থীরা বলেন, এটি শুধু চিত্রকর্ম নয়, এটি ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ। রংতুলির আঁচড়েও যে প্রতিবাদের ভাষা এমন তীব্র হতে পারে, তা এই চিত্রকর্মটি না দেখলে বোঝা যাবে না। তারা বলেন, অসহায় ফিলিস্তিনিদের ওপর এত নির্যাতন। মুসলিমদের প্রাণের আল আকসা মসজিদ দখল করে নেওয়া, তার পরও বিশ্ব বিবেক ঘুমিয়ে আছে। আমরা মনে করি, চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে এই প্রতিবাদ সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। গ্রাফিতিশিল্পী ওমর ফারুক বলেন, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর সারা দেশেই দেয়ালে দেয়ালে চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে প্রতিবাদের চিত্র তুলে ধরা হচ্ছিল। ঠিক তখনই এ ধরনের একটি দেয়ালচিত্র আঁকার চিন্তা আসে আমাদের মাথায়। তার গ্রাফিতি সঙ্গী হিসেবে ছিলেন ফরিদপুরের উসাইদ মুহাম্মদ। তিনি এবং তার সঙ্গী উসাইদ মুহাম্মদ চিন্তা করেন নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়াতে কিছু একটা করা। সেই চিন্তা থেকেই তারা পাওয়ার হাউস ভবনে গ্রাফিতি অঙ্কনের সিদ্ধান্ত নেন। পরে স্থানীয়দের সহযোগিতায় তারা এটির কাজ শেষ করেন। উসাইদ মোহাম্মদ বলেন, যেহেতু আমরা শিল্পী, আমরা চেষ্টা করেছি আমাদের অবস্থান থেকে কিছু একটা করার। গ্রাফিতিটিতে ফিলিস্তিনের প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গাজা অঞ্চল, আল আকসা মসজিদ এবং আরব বিশ্বের যে নীরবতা, সেটি ফুটিয়ে তুলেছি। একই সঙ্গে ফিলিস্তিনিরা যে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, সেটিও এখানে ফুটে উঠেছে। তাই এর নাম দেওয়া হয়েছে তুফান। আমরা তাদের প্রতিবাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে চিত্রকর্মটি করি। মূলত অসহায় ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়াতে সমগ্র বিশ্বের ঘুমিয়ে থাকা বিবেককে জাগাতেই এ গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে বলে তারা জানান। এ কাজটি বাস্তবায়নে সামাজিক সংগঠন ক্লিন ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ মোহাম্মদ রকি, তার স্ত্রী জিনাত নাহার, মাহমুদুল ইসলাম মাহিন, শামীম সাইম, জয় মহাজনসহ আরও অনেকে সহযোগিতা করেছেন।