লালনের তিরোধন দিবস ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি/ মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি—সত্যি তো মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হওয়া যায়। মানবনীতিতে বিশ্বাসী হয়ে তাই তো তিনি সারাজীবন মানবতার কথা বলেছেন, গেয়েছেন মানব-ঐক্যের গান। বলেছেন, সৃষ্টিকে বাসলে ভালো, পাইবে তার স্রষ্টাকে। সেজন্য তিনি কারও কাছে সাধক, কারও কাছে বাউল গায়ক হিসেবে পরিচিত। কেউ তাকে বলেন সমাজ সংস্কারক আবার কেউ বা মানবতাবাদী দার্শনিক। একেকজনের কাছে পরিচিতি একেক নামে হলেও তার দর্শন ও জীবনবোধ সবাইকে একই শিক্ষা দেয়—তা হলো মানবপ্রেম। বলছি লালন সাঁইয়ের কথা। গতকাল বৃহস্পতিবার ছিল সেই সাধকের ১৩৪তম তিরোধান দিবস। এ উপলক্ষে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে শুরু হয়েছে তিন দিনের স্মরণোৎসব। হেমন্তের শুরুর দিনে গরমের তীব্রতা কম হলেও মানুষের ভিড়ে সরগরম পুরো আখড়াবাড়ি। আগত ভক্ত-অনুরাগীরা বলছেন, বছরান্তে দুবার তারা আসেন আখড়াবাড়ির সাধুসঙ্গে। এ শুধু উৎসব নয়, এ যেন প্রাণের সঙ্গে প্রাণের মেলবন্ধন। এ ভবের হাটে চলে ভাবের লেনাদেনা। আচার-বিচার শেষে তারা ফিরে যান পরিশুদ্ধ হয়ে, আবার ফিরে আসার আশায়। স্মরণোৎসবের প্রথম দিন মাজার প্রাঙ্গণে জড়ো হয়েছেন লাখো ভক্ত সাধু, লালন অনুসারী ও দর্শনার্থী। চৈত্রের এক দোলপূর্ণিমার দিনে দুরারোগ্য ব্যাধি নিয়ে লালন সাঁইয়ের আবির্ভাব ঘটেছিল ছেঁউড়িয়ার কালীগঙ্গার ঘাটে। সাঁইজির দেহত্যাগের পর তার স্মৃতি ধরে রাখার জন্য এবং মরমি বাণী প্রচার করার জন্য তার অনুসারীরা এ দিনটিতে তাকে বিশেষভাবে স্মরণ করেন। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় আনুষ্ঠানিকভাবে এ স্মরণোৎসব উদ্বোধন করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। অনুষ্ঠান চলবে শনিবার পর্যন্ত। আখড়াবাড়ির আঙিনা ও মরা কালীগঙ্গা নদীর বুকচিরে গড়ে ওঠা বিশাল উন্মুক্ত মাঠে খণ্ড খণ্ড দলে বিভক্ত হয়ে আস্তানা গেড়ে গান গাইছেন লালনভক্ত সাধু অনুসারী বাউলরা। তাদের গান শুনতে আখড়াবাড়িতে জড়ো হচ্ছেন নানা মত-পথ-ধর্মের মানুষ। গানের মাধ্যমেই সাধু গুরু বাউলরা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছেন লালনের আধ্যাত্মিক অহিংস মানবতাবাদী বাণী ও তার মতবাদ এবং দর্শনের কথা। উন্মুক্ত মঞ্চের সামনের মাঠে বসেছে লালন মেলা। এতে বিভিন্ন ধরনের পণ্যের ও খাবারের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। মেলা প্রাঙ্গণের দোকানগুলো দর্শনার্থীর ভিড়ে সরগরম হয়ে উঠেছে। তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে উন্মুক্ত মঞ্চে প্রতিদিন সন্ধ্যায় লালনের জীবনী নিয়ে বিশিষ্টজন আলোচনা করবেন। শেষে শুরু হবে লালন গানের আসর। লালন ভক্ত-সাধু ও দর্শনার্থীদের নিরাপত্তায় আখড়াবাড়ি ও আশপাশে মোতায়েন রয়েছে আট শতাধিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। সিরাজগঞ্জ থেকে আখড়াবাড়িতে এসেছেন ফকির আবু তাহের। তিনি বলেন, এখানে আমাদের গুরুপাঠ। আমরা আত্মতত্ত্ব জ্ঞানের জন্য এখানে আসি। এই গুরুপাঠের মেরুদণ্ড ফকির লালন সাঁইজি। প্রয়াণ দিবসে সাঁইজিকে স্মরণ করতে আখড়াবাড়িতে এসেছেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের ফকির আবুল কালাম। সাঁইজির বাণী স্মরণ করে এ সাধক বলেন, সাঁইজির আখড়ায় মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি। মানুষকে ভালোবাসলে স্রষ্টাকে ভালোবাসা হয়। গানে গানে গুরুবন্দনা, তত্ত্ব ও পদ পরিবেশনে লালনকে স্মরণ: গানে গানে গুরুবন্দনা, তত্ত্ব ও পদ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে মহাত্মা লালন সাঁইজিকে স্মরণ করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে ‘লালন স্মরণোৎসব’ ও ‘আশাসিন্ধু তীরে’ শীর্ষক প্রথম দিনের আয়োজন উদ্বোধন করেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির তিন দিনব্যাপী আয়োজনের প্রথম দিনে সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ। স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির চারুকলা বিভাগের পরিচালক মোস্তফা জামান। এরপর লালন সাঁইকে উপস্থাপন করেন শিল্পী অরূপ রাহী ও জহুরা ফকিরানী। তাদের গান ও তত্ত্বে সাঁইজিকে স্মরণ করা হয়।