চার কারণে এবার পাশের হার কম
চলতি বছর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় প্রায় তিল লাখ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। ঢাকাসহ তিনটি বোর্ডের পাশের হার ৮০ শতাংশের নিচে রয়েছে। গত বছরের চেয়ে এবার বোর্ডগুলোর গড় পাশের হারও কমেছে। মূলত চারটি কারণে এবার পাশের হার কম বলে জানা গেছে। তার মধ্যে ইংরেজি ও আইসিটি বিষয়ে খারাপ ফল করা, করোনায় শিখন ঘাটতি ও নবম-দশম শ্রেণি শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়া, বিষয়ভিত্তিক শিক্ষককের ঘাটতি ও উচ্চমাধ্যমিকে ক্লাসে নিয়মিত না হওয়া। এছাড়া আর বেশ কিছু কারণে থাকলে এই চারটির প্রভাব পড়েছে এবার এইচএসসি ও সমমানের ফলাফলে। এসএসসি ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এবার এইচএসসি, আলিম, এইচএসসি (বিএম-ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা) ও ডিপ্লোমা ইন কমার্স পরীক্ষার ফলাফলে গড় পাশের হার ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এর মধ্যে পাশের হারে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে ময়মনসিংহ, যশোর ও ঢাকা বোর্ড। দেখা গেছে ময়মনসিংহ বোর্ডের পাশের হার ৬৩.২২ শতাংশ, যশোর বোর্ডের পাশের হার ৬৪.২৯ শতাংশ এবং ঢাকা বোর্ডে পাশের হার ৭৯.২১ শতাংশ। মঙ্গলবার প্রকাশিত ফলাফল থেকে এই চিত্র পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২২ সালে এসএসসিতে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পাশ করা শিক্ষার্থীরা এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নেন। করোনাকালীন তারা নবম ও দশমের সিলেবাস শেষ করেছে অনলাইনে ক্লাস করে। এ সময় প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষার্থীরা ক্লাস করেছেন টেলিভিশনে। ফলে তারা বড় ধরনের শিখন ঘাটতি নিয়ে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। দীর্ঘদিন সশরীরে ক্লাস না করায় উচ্চমাধ্যমিকে এসে তাদের ক্লাসে উপস্থিতিও কমে যায়। ব্যাপক শিখন ঘাটতি থাকায় অন্য বছরের তুলনায় এবার শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ অপেক্ষাকৃত বেশি ছিল। এছাড়া বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের ঘাটতি ও কারিকুলামের ওপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় এবার ইংরেজি ও আইসিটি বিষয়ে অকৃতকার্যের হার বেড়েছে-যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে মোট ফলাফলে। তাছাড়া এবার এইচএসসি ও সমমানের সাতটি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর দেশজুড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যেসব বিষয়ের পরীক্ষা হয়েছে সেগুলোর উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হবে। আর যেসব বিষয়ের পরীক্ষা হয়নি সেগুলোর ফলাফল তৈরি হবে পরীক্ষার্থীদের এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে বিষয় ম্যাপিং করে। সব বিষয়ে পরীক্ষা হলে এই পাশের হার আরও কমে যেত। এ বিষয়ে ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আবু তাহের বলেন, ‘আইসিটি ও ইংরেজি বিষয়ের প্রশ্ন কঠিন হয়েছে। এতে আমাদের পাশের হার কিছুটা কমেছে। যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মর্জিনা আক্তার বলেন, ‘এই ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ২০২২ সালে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে এসএসসি উত্তীর্ণ হয়েছে। তাদের যে লার্নিং গ্যাপ ছিল তা এখনো পূরণ হয়নি।’ আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, ‘যে বিষয়গুলোর পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছিল, সেগুলোর ফলাফল উচ্চ মাধ্যমিকে গড় পাশের হারে বড় রকমের প্রভাব পড়ে না। পাশের হারটি মূলত নির্ভর করে ইংরেজি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ের ওপর। কিন্তু এবার এই দুটি বিষয়ের পরীক্ষা হয়েছিল। তাই পাশের হার কম। বোর্ডভিত্তিক পাশের হারে সবচেয়ে কম পাশ করেছে ময়মনসিংহ বোর্ডে, ৬৩.২২ শতাংশ। এর পরে রয়েছে যথাক্রমে যশোর বোর্ডে ৬৪.২৯, ঢাকা বোর্ডে ৭৯.২১, রাজশাহীতে ৮১.২৪, কুমিল্লায় ৭১.১৫, চট্টগ্রামে ৭০.৩২, বরিশালে ৮১.৮৫, সিলেটে ৮৫.৩৯, দিনাজপুরে ৭৭.৫৬; মাদ্রাসা বোর্ডে ৯৩.৪০ ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে ৮৮.০৯ শতাংশ। গত বছর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ৯২ হাজার ৫৯৫ জন জিপিএ-৫ পেয়েছিল। এ বছর জিপিএ-৫ পেয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন। অথচ গত বছরের চেয়ে পাশের হার বাড়েনি। গত বছর পাশের হার ছিল ৭৮.৬৪ শতাংশ। বিশ্লেষকদের ধারণা, বিষয় ম্যাপিংয়ের কারণে এবার জিপিএ-৫ বেশ বেড়েছে। এ বছর আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের শিক্ষার্থীদের ছয় বিষয়ের পরীক্ষা বাতিল হয়েছে। বিষয়ভিত্তিক ফল : এ বছর অধিকাংশ বোর্ডেই ইংরেজিতে বেশি খারাপ করেছে শিক্ষার্থীরা। সাধারণ শিক্ষা বোর্ডগুলোতে ইংরেজিতে গড়ে ১৮ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। ঢাকা বোর্ডে ইংরেজিতে পাশের হার ৮৬.১৬, রাজশাহীতে ৮৩.৯৮, কুমিল্লায় ৭৯.৯৩, যশোরে ৬৮.৭৬, চট্টগ্রামে ৬৯, বরিশালে ৮৩.৩৬, দিনাজপুরে ৮৩.৪৬, ময়মনসিংহ বোর্ডে ৭৭.১১; মাদ্রাসা বোর্ডে ৯৭.০৬ শতাংশ পাশ করেছে। সিলেট বোর্ডে ইংরেজি বিষয়ের পরীক্ষা না হওয়ায় বিষয় ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে শতভাগ শিক্ষার্থীই পাশ করেছে। এছাড়া আইসিটি বিষয়ে এবার দ্বিতীয় সর্বনিু পাশের হার। এতে বোর্ডগুলোর গড় পাশের হার ৮৭ দশমিক ২৯ শতাংশ। এতে প্রায় ১৩ শতাংশ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। আইসিটিতে সর্বোচ্চ পাশের হার রাজশাহী বোর্ড আর সর্বনিু পাশের হার ময়মনসিংহ। যেটি যথাক্রমে ৯৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং ৭৩ দশমিক ৭১ শতাংশ। এবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ১৩ লাখ ৩১ হাজার ৫৮ জন। পাশ করেছে ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৩০৯ জন। শতভাগ পাশ করেছে এক হাজার ৩৮৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। একজনও পাশ করেনি এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬৫টি। এছাড়া সিলেট বোর্ডে হয়েছে মাত্র দুই বিষয়ের পরীক্ষা। আর মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ডের শিক্ষার্থীদেরও চার থেকে ছয় বিষয়ের পরীক্ষা দিতে হয়নি। বাতিল হওয়া পরীক্ষায় নম্বর দেওয়া হয়েছে এসএসসির বিষয় ম্যাপিং করে। এতে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের পদার্থ, রসায়ন বা উচ্চতর গণিতের মতো পরীক্ষা দিতে না হওয়ায় জিপিএ-৫ বেড়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ ফেরদাউস বলেন, প্রায় সারা দেশেই ইংরেজির পাঠদানে বেহাল দশা বিরাজ করছে। একই সঙ্গে আইসিটি ও বিষয়ভিত্তিক শিক্ষককের ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া কারিকুলামের ওপর শিক্ষকদের কোনো ট্রেনিং দেওয়া হয় না। এবার এইচএসসির ও সমমানের ফল প্রকাশ করা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। তারা এসএসসি ও সমমানের পাশের আগে করোনার কারণে ক্লাস করতে না পারায় শিখন ঘাটতি রয়েছে। আবার এইচএসসিতে এসে ক্লাসে মনযোগ কম ছিল। তাদের ক্লাসে উপস্থিতিও কম দেখা গেছে। যার কারণে এর প্রভাব পড়েছে গড় পাশের হারে।