হাটে চট পেতে বসে ধান চাল কিনতেন সাধন
নওগাঁর বিভিন্ন হাটে চট পেতে বসে খুচরায় ধান-চাল কিনতেন। সেগুলো গরুর গাড়িতে দাদপুর, নীতপুর, সরাইগাছি ও সাপাহারসহ বিভিন্ন মোকামে দিতেন। এভাবেই হয়ে ওঠেন ধান-চালের পাকা ব্যাপারি। সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের জীবনের শুরুর গল্পটা ছিল এমনই। আশির দশকে নিজ এলাকা নওগাঁর নিয়ামতপুরে একটি ধান ভাঙার কল দেন তিনি। এরপর আস্তে আস্তে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৮৪ সালে প্রথমে ইউপি চেয়ারম্যান এবং পরে উপজেলা চেয়ারম্যান হন। ২০০৮ সালে প্রথমবার সংসদ-সদস্য হন নওগাঁ-১ আসন থেকে। ২০১৮ সাল থেকে সাড়ে ৫ বছর ছিলেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী। নিজেকে অমর করে রাখতে নিয়ামতপুর তিন মাথা মোড় থেকে পোরশা পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার একটি সড়কের নামকরণ করেন ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা সাধন চন্দ্র মজুমদার সড়ক’। এদিকে মন্ত্রী হওয়ার পর সাধনের সম্পদ বেড়েছে শতগুণ। এলাকার ও মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন কাজ থেকে বেপরোয়া কমিশন আদায়, সারা দেশের ধান-চালের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, চাল আমদানিতে দুর্নীতি, এলাকার পুকুর, জলাশয়, জমি দখলসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। নওগাঁর রাজনীতিতে একচ্ছত্র অধিপতিও ছিলেন তিনি। তার ভাই মনোরঞ্জন ওরফে মনা মজুমদার, ভাতিজা রাজেশ মজুমদার, মেয়ে তৃণা মজুমদারও এসব অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন। সরকার পতনের পর তারা সবাই এখন আত্মগোপনে। নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার শিবপুরে সাধনের দুই বাড়ি তালাবদ্ধ। নওগাঁ শহরের বাড়িটিতেও কারও কোনো আনাগোনা নেই। নওগাঁ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ এলাকাবাসী জানান, সাধনের উত্থান ঘটে আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আব্দুল জলিলের হাত ধরে। ১৯৮৪ সালে সাধন নিজ এলাকা নিয়ামতপুরের হাজিনগর ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তখন নওগাঁ শহরে থাকার মতো তার কোনো বাসাবাড়ি ছিল না। সাধন থাকতেন আব্দুল জলিলের গুদামঘরে। তখন আব্দুল জলিলের নওগাঁর ব্যবসা-বাণিজ্য দেখভাল ও তার বাসার বাজার-সদাইর কাজ করতেন। আব্দুল জলিলের আশীর্বাদে সাধন প্রথমে হাজিনগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। পর্যায়ক্রমে জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও পরে সাংগঠনিক সম্পাদক হন। আব্দুল জলিল বেঁচে থাকতেই তিনি জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক হন। ২০১৪ সালে আব্দুল জলিলের মৃত্যুর পর সাধন নওগাঁ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। নওগাঁ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য রেজাউল ইসলাম বলেন, সংসদ-সদস্য হওয়ার পর থেকেই সাধন বাবু সবকিছু নিয়ন্ত্রণে একটি পারিবারিক সিন্ডিকেট করে ফেলেন। দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা তার ধারেকাছে ঘেঁষতে পারেননি। আমাকে জেলা কমিটি থেকে এবং চেম্বারের পরিচালক পদ থেকে সরিয়ে দেন। অনেকের ওপর অত্যাচার করেন কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পাননি। নিয়ামতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি খালেকুজ্জামান বলেন, ক্ষমতার প্রভাবে সাধন বাবু নিজের ভাই মনা মজুমদারকে উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, ছোট মেয়ে তৃণা মজুমদারকে জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য এবং বড় মেয়ে কাবেরী মজুমদারকে জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি করেছিলেন। জেলার বিভিন্ন ইউপি ও উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ব্যাপক মনোনয়ন বাণিজ্য করেন সাধন বাবু। রাজশাহী অঞ্চলের কয়েকজন অটো রাইস মিল মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৮ থেকে সরকার পতনের আগ পর্যন্ত ধান চালের ক্রয়, সংগ্রহ, আমদানি মজুত-সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন সাধন নিজে ও তার ভাই মনা মজুমদার। ভারত থেকে চাল আমদানির বরাদ্দ পেতে ব্যবসায়ীরা মনার কাছে ধরনা দিতেন। এজন্য তাকে দিতে হতো মোটা অঙ্কের কমিশন। ধান চালের অভ্যন্তরীণ সংগ্রহেও মনা মজুমদার ছিলেন শেষ কথা। গত কয়েক বছরে সাধনের ঘনিষ্ঠ নওগাঁ ও বগুড়ার কয়েকজন মিল মালিক ও চাল ব্যবসায়ীকে একচেটিয়া আমদানির বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সাধন ঘনিষ্ঠ বগুড়া, নওগাঁ, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ডজনখানেক মিল মালিক নিয়ন্ত্রণ করেছেন চালের মজুত ও বাজার। একাধিক খাদ্য কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভাতিজা রাজেস, মেয়ে তৃণা ও জামাই আবু নাসের (পিএস) মন্ত্রণালয়সহ খাদ্য বিভাগের নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়নে ও বদলিতে বাণিজ্য করেছেন। বিশেষ করে গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি-এলএসডি), খাদ্য পরিদর্শক, উপজেলা-জেলা ও আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক পদে বদলিতে কোটি টাকা পর্যন্ত বাণিজ্য হতো। সাধন পরিবারের বিরুদ্ধে নওগাঁর তিন উপজেলা সাপাহার, পোরশা ও নিয়ামতপুরের সরকারি-বেসরকারি পুকুর-জলাশয় দখলের অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, এই তিন উপজেলায় ৬ হাজারের বেশি সরকারি পুকুর রয়েছে। গত সাড়ে ১৫ বছরে সাধনের ভাই মনা মজুমদার ও ভাতিজা রাজেশের সম্মতি ছাড়া সরকারি পুকুর ইজারা দিতে পারেনি উপজেলা প্রশাসন। নিয়ামতপুরের মাছ চাষি আব্দুল হাকিম বলেন, কোনো সরকারি পুকুর নিলাম প্রকাশ্যে হতো না। সাধন সিন্ডিকেট কিছু পুকুরে নিজেরা মাছ চাষ করত আবার অন্যগুলো টাকা নিয়ে দিয়ে দিত। আমরা যারা মাছ চাষি তাদের সাধ্য ছিল না পুকুরের কাছে ঘেঁষার। এলাকাবাসী আরও জানান, শুধু পুকুর-জলাশয় নয়, এলাকার হাট-বাজারের ইজারা পেতেও সাধনের ভাই মনাকে দিতে হতো টাকা। মনার নির্দেশে হাট-বাজারের নিলাম দেখানো হতো কাগজ-কলমে। মনা যার কাছে বেশি টাকা পেতেন তাকেই দিতেন হাট-বাজারের ইজারা। আব্দুস সামাদ নামে পোরশার এক ব্যবসায়ী বলেন, তিন উপজেলার হাট-বাজার নিলামে কারচুপির কারণে সরকার কয়েক কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে। জানা গেছে, ২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনের সময় সাধনের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ৪৩ হাজার ৫০০ টাকা। বছরে আয় করতেন আড়াই লাখ টাকা। তিন মেয়াদে সংসদ-সদস্য ও এক মেয়াদে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পর ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে দেওয়া হলফনামায় তার সম্পদের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১০ কোটি ২৩ লাখ ১৮ হাজার ৬৬০ টাকা। এ সময়ে সাধনের বার্ষিক আয় দাঁড়ায় চার কোটি টাকার বেশি। সেই হিসাবে গত ১৫ বছরে তার সম্পদ বেড়েছে ৯৯ গুণ। আর বার্ষিক আয় বেড়েছে ১৫৭ গুণের বেশি। দুদক বর্তমানে তার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করছে। নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার শিবপুরের বাসিন্দারা জানান, উত্তরাধিকার সূত্রে বাবা কামিনী কুমার মজুমদারের ধান-চালের ছোট ব্যবসা পেয়েছিলেন সাধন চন্দ্র মজুমদার। নয় ভাই-বোনের মধ্যে সাধন মজুমদার অষ্টম। তাদের আদি নিবাস ছিল নোয়াখালীর চৌমুহনী। ১৯৪৬ সালে সেখানে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হলে সাধনের বাবা কামিনী মজুমদার এখানে চলে আসেন। সাধনের জন্ম শিবপুরেই। বাবার মাত্র ৪ বিঘা ধানি জমি ছিল এলাকায়। এখন তার পরিবার শত শত বিঘা জমির মালিক। এছাড়া নওগাঁ শহরে একাধিক বাড়ি-জমি এবং ঢাকায়ও ফ্ল্যাট রয়েছে। ৩ অক্টোবর রাতে সাধন চন্দ্র মজুমদার রাজধানীতে গ্রেফতার হয়েছেন। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে তার ভাই মনা মজুমদারের মোবাইল নম্বরে ফোন দিলে সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে। তার ফেসবুক আইডি ও হোয়াটসঅ্যাপও সচল পাওয়া যায়নি। পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে ভাতিজা রাজেশ মজুমদার, মেয়ে তৃণা মজুমদার ও জামাই আবু নাসের বেগের মোবাইল নম্বরও বন্ধ পাওয়া গেছে। এছাড়া সাধনের নওগাঁ শহরের বাড়ি ও নিয়ামতপুরের শিবপুরের গ্রামের বাড়িতেও কাউকে পাওয়া যায়নি। ফলে কারও মন্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।