কট্টর আ.লীগবিরোধী থেকে শেখ হাসিনার ‘একনিষ্ঠ সমর্থক’
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক বর্ণাঢ্য রাজনীতিকের নাম মতিয়া চৌধুরী।মন্ত্রিত্বসহ প্রায় ছয় দশকের রাজনৈতিক জীবনে বরাবরই সাদামাটা জীবনযাপনের জন্য প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি। ছাত্র ইউনিয়ন থেকে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি হয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া প্রবীণ এই রাজনীতিক আদর্শের রাজনীতি করেছেন সারা জীবন। রাজপথে তার বিচরণ সব সময়ই চোখে পড়েছে। মতিয়া চৌধুরী রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘অগ্নিকন্যা’ নামে পরিচিত। ‘কট্টর আওয়ামী লীগ বিরোধী’ থেকে সময়ের পরিক্রমায় মতিয়া চৌধুরী হয়ে উঠেছিলেন দলটির সভানেত্রী শেখ হাসিনার ‘ঘনিষ্ঠ অনুসারী ও একনিষ্ঠ সমর্থক’।শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত হিসেবে দলীয় পরিমণ্ডলে শক্ত অবস্থান করে নিয়ে কয়েক দফায় তার মন্ত্রিসভার সদস্য ও সংসদের উপনেতা হয়েছিলেন। বুধবার ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন এবং শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর বাতিল হওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদের উপনেতা ছিলেন। গবেষক, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদের ভাষ্য, মতিয়া চৌধুরীকে ছাত্রনেতা হিসেবে ষাটের দশকে মানুষ এক নামে চিনতো। তিনি ঝড়ের গতিতে এসে তখন তরুণদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ দিকে শেখ হাসিনাকে বেপরোয়া শাসক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে তার নিরঙ্কুশ সমর্থনও ভূমিকা রেখেছে। সিনিয়র সাংবাদিক ও বিশ্লেষক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু বলেন, ‘আমাদের ছাত্র বয়সে তিনি ছিলেন অনুসরণীয়। আমরা মনে করতাম বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণের মতো বক্তা ছিলেন মতিয়া চৌধুরী। কিন্তু তিনি তার বিশাল অভিজ্ঞতা ও অবস্থানকে আওয়ামী লীগকে ইতিবাচক ধারায় রাখার ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারেননি।’ মন্ত্রিসভায় মতিয়া চৌধুরীর সহকর্মী সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, একদিকে সব সংগ্রামে থাকা আবার অন্যদিকে সরকারে থেকে গণমানুষের স্বার্থে কাজ করার জন্য তিনি অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবেন বলে তিনি মনে করেন। ইডেন থেকে উত্থান দীর্ঘকাল ধরে কর্মী ও অনুসারী ছিলেন এবং তার পরিবারের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ ছিলেন এমন কয়েকজন জানিয়েছেন যে, পুলিশ কর্মকর্তা বাবার সন্তান মতিয়া চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেছিলেন পিরোজপুরে ১৯৪২ সালের ৩০ জুন। স্কুলজীবন শেষে ইডেন কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হন এবং এর মধ্যে ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। পরে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬৪ সালে ছাত্র ইউনিয়ন থেকেই তিনি ডাকসুর জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন।ওই বছরেই তিনি সাংবাদিক বজলুর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। প্রয়াত বজলুর রহমান পরবর্তীকালে দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন। ষাটের দশকে পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে তুমুল আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তাতে মতিয়া চৌধুরী সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। সে সময় কয়েক দফায় কারাগারে যেতে হয়েছে এবং এর মধ্যে একবার টানা দুবছর জেলে ছিলেন তিনি। ষাটের দশকেই দেশজুড়ে ‘অগ্নিকন্যা’ হিসেবে পরিচিত পান এবং তিনি গুরুত্বপূর্ণ ছাত্রনেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। এক পর্যায়ে ছাত্র ইউনিয়ন দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে- তার ও রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে।তখন আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের সঙ্গে না থাকলেও ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষিত ছয় দফার সমর্থনে ব্যাপক সক্রিয় ছিলেন মতিয়া চৌধুরী। ন্যাপ থেকে আওয়ামী লীগে ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার পর ১৯৬৭ সালে তিনি যোগ দিয়েছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে। এ সময় রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের পতনের পর আরও অনেক রাজনীতিবিদের সঙ্গে তিনিও জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবার রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেন। মুক্তিযুদ্ধেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়ন যে গেরিলা বাহিনী গঠন করেছিল, তাতেও তিনি সংগঠক ছিলেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের পর আবার ন্যাপের রাজনীতি শুরু করেন। সে সময় তিনি আওয়ামী লীগের কট্টর সমালোচক হিসেবে আলোচিত ছিলেন। মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সমালোচক ছিলেন। পরে ১৯৭৯ সালে আওয়ামী লীগেই যোগ দিয়ে শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হয়ে উঠেছিলেন। মূলত শেখ হাসিনার বিষয়ে কট্টর ছিলেন তিনি। শেখ হাসিনাকে যারা ঘিরে ছিলেন এবং পরে তাকে বেপরোয়া হয়ে উঠতেও সাহায্য করেছেন- মতিয়া চৌধুরীও ছিলেন তাদের একজন।’ ২০০৭ সালে বাংলাদেশে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা দলটিতে সংস্কার আনার পক্ষে অবস্থান নেন। এর বিপরীতে মতিয়া চৌধুরীসহ অন্যরা শেখ হাসিনার পক্ষে তাদের দৃঢ় অবস্থান প্রকাশ করেন।পরে শেখ হাসিনা কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন এবং ২০০৯ সালের নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় গেলে মতিয়া চৌধুরীর অবস্থান দলে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠে। মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু বলেন, মুক্তিযুদ্ধসহ জাতীয় জীবনের নানা উত্থান পতনে মতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্ব তারা দেখেছেন।ষাটের দশকের বর্ণাঢ্য যুগে যে কয়জন ছাত্রনেতার নাম শুনেছি তার মধ্যে একজন মতিয়া চৌধুরী। তবে দীর্ঘ বাম রাজনীতির অভিজ্ঞতা ও ব্যক্তিত্বের প্রখরতা নিয়ে তিনি হয়ে গেলেন শেখ হাসিনার অনুসারী। দলকে ইতিবাচক ধারায় রাখতে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি তিনি।’ তবে তিনি মনে করেন, মতিয়া চৌধুরীর ব্যক্তিগত আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেম তাকে অনেকটা সময় রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক করে রাখবে।এমন দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগ খুব বেশি দেখা যায় না। মন্ত্রী হিসেবেও তার খুব একটা সমালোচনা নেই। মতিয়া চৌধুরী শেরপুর-১ আসন থেকে বেশ কয়েকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৯৬, ২০০৯ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। এরপর ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর জাতীয় সংসদের উপনেতা করা হয়েছিল তাকে। মন্ত্রিসভায় মতিয়া চৌধুরীর সহকর্মী সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, সততা ও সাদামাটা জীবনযাপন মতিয়া চৌধুরীকে গণমানুষের নেতায় পরিণত করেছিল।তিনি ছিলেন আমাদের ছাত্রজীবনের আইকন। সব প্রগতিশীল আন্দোলনে ছিলেন সামনের সাড়িতে। মন্ত্রী হিসেবেও প্রশংসা কুড়িয়েছেন। সততা ও নিষ্ঠার প্রশ্নে কখনো তাকে আপস করতে দেখিনি। সূত্র: বিবিসি বাংলা।