সবার টার্গেট জাতীয় নির্বাচন
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দায়িত্বভার গ্রহণ করে রাষ্ট্র সংস্কারে মনোযোগ দেয় নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। তার অংশ হিসেবে বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নির্বাচন কমিশন সংস্কারে কমিশন গঠন করে দেওয়া হয়। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থার স্থায়ী রূপ দিতে এ কমিশন কাজ শুরু করেছে। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন। এদিকে আগামী ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন হওয়া উচিত বলে মনে করেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। পাশাপাশি বিএনপি, জামায়াত, হেফাজতে ইসলাম, এবি পার্টি, ইসলামী আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে। ভিন্ন প্রেক্ষাপটে তারাও চাইছে কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন। সে লক্ষ্যে ভেতরে ভেতরে নির্বাচনের প্রস্তুতিও সেরে নিচ্ছে দলগুলো। দেশের সাধারণ মানুষও মেতে উঠতে চায় নির্বাচন উপলক্ষে। সবারই টার্গেট জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মতে, দলীয় সরকারের অধীনে বিগত তিনটি ভোট আয়োজন করে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাই ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। নিজেদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন নাগরিকরা। এসব নির্বাচন নিয়ে দেশ-বিদেশে সবসময়ই বিতর্ক ছিল তুঙ্গে। কখনো একতরফা, কখনো রাতের ভোট এবং কখনো ডামি ভোটের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতা নবায়ন করে নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল। এ কাজে সহযোগী হিসেবে পাশে ছিল নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও কোনো কোনো রাজনৈতিক দল। ফলে সরকার পতনের পর নির্বাচন ব্যবস্থাকে নতুন করে সাজাতে শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ভোটাধিকার নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন দেশের ভোটাররাও। নির্বাচন কমিশন সংস্কারের পর অনুষ্ঠিত কাঙ্ক্ষিত সেই নির্বাচনে দল মত নির্বিশেষে সবার মতেরই প্রতিফলন ঘটবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তারা। ছাত্র-জনতার প্রবল বিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর শুরু থেকেই নির্বাচনী চাপ রয়েছে। অন্যদিকে, রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুতই নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন সরকারের উপদেষ্টারা। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেও প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচনের কথা বলেছেন। এরই মধ্যে দলীয় বিভিন্ন ফোরাম ও সভা-সমাবেশে দ্রুতই নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছে রাজনৈতিক দলগুলো। সর্বশেষ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে অনুষ্ঠিত সংলাপেও নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করেন দলগুলোর নেতারা। গত ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্র সংস্কারে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন। মূলত এই সংস্কার কমিশনগুলোকে দলগুলো কীভাবে সহযোগিতা করতে পারে, সেটি নিয়ে সংলাপে মতামত চাওয়া হলেও সেখানে সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচন ইস্যুতে জোর দেন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা। জানা গেছে, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ওই সংলাপে দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা এবং সেজন্য একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করাসহ আরও বেশকিছু দাবি তুলে ধরে বিএনপি। এক ঘণ্টাব্যাপী এ সংলাপে বিএনপির মহাসচিব ছাড়াও দলটির স্থায়ী কমিটির আরও পাঁচজন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। সংলাপের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ‘নির্বাচন আমাদের এক নম্বর প্রায়োরিটি।’ একই দিন বিএনপির পরই প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। তাদের নেতৃত্ব দেন দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের দেওয়া দুটি রোডম্যাপের মধ্যে একটি সংস্কারের এবং আরেকটি নির্বাচনের। আমরা আশা করছি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিরপেক্ষ দৃষ্টি থেকে দেশকে ভালো জায়গায় নিয়ে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে সক্ষম হবে। এক্ষেত্রে এটাও আমরা আশা করছি যে, এ সময়টা নাতিদীর্ঘ হবে।’ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অনুষ্ঠিত সংলাপে গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষ থেকে নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দেওয়া সংস্কারের বিষয়গুলো তুলে ধরে বলেন, ‘আমরা একটা সরকার বদলানোর আন্দোলন করছি না, নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করছি না। সামগ্রিকভাবে আন্দোলন করছি যাতে নির্বাচন ব্যবস্থা ও সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায়।’ এই সংলাপে অংশ নিয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘স্বৈরাচার, খুনি, ফ্যাসিস্টরা যেন নির্বাচন করার সুযোগ না পায়, সেটা নিয়ে আমরা উপদেষ্টাদের বলেছি। দলের পক্ষ থেকে নির্বাচন সংস্কারের পাশাপাশি ভোটের আনুপাতিক হারে সংসদে প্রতিনিধিত্ব চালুর দাবি জানিয়েছে ইসলামী আন্দোলন।’ বাম গণতান্ত্রিক জোটের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে পূর্ণাঙ্গ সংস্কার করে নির্বাচন কবে হবে, সেটার রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে।’ সংস্কার প্রস্তাবের সেই ধারাবাহিকতায় আগামী শনিবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আবারও সংলাপে বসতে যাচ্ছে সরকার। তার আগে গত ৩০ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাপানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম এনএইচকেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দ্রুত সংস্কারকাজ এগিয়ে নিয়ে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে প্রতিশ্রুতির কথা জানান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব সংস্কারকাজ করা এবং প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে নির্বাচন আয়োজন করবে সরকার। তাদের ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই বলেও জানান প্রধান উপদেষ্টা। তারও আগে ২৪ সেপ্টেম্বর রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জানান, আগামী ১৮ মাসের মধ্যে যেন নির্বাচন হতে পারে, সেজন্য যে কোনো পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করবেন। এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণ হওয়া উচিত মন্তব্য করে এ সময় ধৈর্য ধরার প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দেন তিনি। এদিকে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারকে প্রধান করে গঠিত নির্বাচন কমিশন (ইসি) সংস্কার কমিশন পুরোদমে কাজ শুরু করেছে। আগামী তিন মাসের মধ্যেই এ কমিশন সুপারিশ চূড়ান্ত করে সরকারের কাছে উপস্থাপন করতে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন কমিশন প্রধান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমরা যথাসময়ে কাজ শুরু করেছি। নির্বাচনী আইনগুলো ব্যাপকভাবে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। আমরা লাইন ধরে ধরে পর্যালোচনা করছি। এরপর সেগুলোর ত্রুটি-বিচ্যূতি তুলে ধরা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন নিয়োগের আইন অগ্রাধিকার। সরকার যখন চাইবে আমরা আশা করি তখনই উনাদের একটা খসড়া দিতে পারব।’ নির্বাচনের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘রাষ্ট্র ও শাসন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কারের কথা বলছে, তা নির্বাচিত সরকারেরই করা উচিত। দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। সেজন্য নির্বাচনের রোডম্যাপ এখন বিএনপির প্রধান দাবি। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দলীয় সরকারের অধীনে বিগত তিনটি ভোট আয়োজন করে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাই ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। নিজেদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন নাগরিকরা। ফলে সরকার পতনের পর নির্বাচন ব্যবস্থাকে নতুন করে সাজাতে শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ভোটাধিকার নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন দেশের ভোটাররাও। নির্বাচন কমিশন সংস্কারের পর অনুষ্ঠিত কাঙ্ক্ষিত সেই নির্বাচনে দল-মত নির্বিশেষে সবার মতেরই প্রতিফলন ঘটবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তারা। এ ব্যাপারে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, ‘বিগত তিনটি নির্বাচনের মাধ্যমে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এখন সবার আকাঙ্ক্ষা একটি ভালো, উৎসবমুখর, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। যে নির্বাচনে জনগণ নির্ভয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। জনগণের ভোটের মাধ্যমে জনগণের সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারে। তবে কাঙ্ক্ষিত সেই নির্বাচনের জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করা উচিত। কারণ, ভেঙে পড়া রাষ্ট্র ও নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার দরকার। প্রয়োজনীয় সেই সংস্কারের জন্য সরকারকে খানিকটা সময় দিতে হবে। যাতে আর কোনো সরকার স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে না পারে। নির্বাচন ব্যবস্থাকে যাতে ধ্বংস ও বিতর্কিত করতে না পারে। সবার আকাঙ্ক্ষার এমন রাষ্ট্র ও নির্বাচন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলেই শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে।’ আগামী নির্বাচন ও সরকারের ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাইলে সরকারের পাট ও বস্ত্র এবং নৌ পরিবহনবিষয়ক উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর আমাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে একটি সুন্দর নির্বাচন। সেই নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য হতে হবে। এ নির্বাচন সঠিক না হলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে না। এতে আবারও কোনো এক স্বৈরশাসন ভর করতে পারে, বিগত তিনটি নির্বাচনের মাধ্যমে যা হয়েছিল।’ সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার আরও বলেন, ‘অতীতের মতো নির্বাচনের যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, সেজন্য প্রতিটি রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব রয়েছে। জনগণকেও এ বিষয়ে সজাগ ও সচেতন হতে হবে। তবেই ছাত্র-জনতার রক্তের ঋণ কিছুটা হলেও শোধ হবে।’