ঝোপ বুঝে কোপ মারছে বিভিন্ন বাহিনীর চাকরিচ্যুতরা
রাজধানীর পোস্তগোলা এলাকায় এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীর প্রায় ৩৯ ভরি স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নেয় ডিবি পরিচয় দেওয়া একটি দল। মাইক্রোবাসে উঠিয়ে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীকে নিয়ে পালানোর সময় সন্দেহবশত এক ট্রাফিক সার্জেন্ট গাড়িটির গতিরোধ করেন। গাড়ির ভেতর থেকে দুজন নেমে ডিবি সদস্য পরিচয় দেয়। পুলিশ দেখে ভুক্তভোগী চিৎকার করলে উপস্থিত পুলিশ সদস্য ও স্থানীয়রা মিলে ডিবি পরিচয় দেওয়া চারজনকে আটক করেন। ২০২৩ সালের ২৮ নভেম্বর পোস্তগোলা সেতুর নিচে এ ঘটনা ঘটে। পরবর্তী সময়ে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ জানতে পারে, আটক চারজনের মধ্যে একজন পুলিশ থেকে চাকরিচ্যুত, আরেকজন সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য। সেই সময়ে মামলাটির তদন্তের দায়িত্বে থাকা একাধিক কর্মকর্তা জানান, আটক হওয়া চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্য আগে ঢাকায় কর্মরত ছিল। মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় তার চাকরি চলে যায়। পরবর্তী সময়ে আরও কয়েকজন চাকরিচ্যুত ও অন্যদের নিয়ে ডাকাত দল গঠন করে সে। যারা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ডিবি, র্যাব পরিচয় দিয়ে ডাকাতি করে। শুধু এই চক্রটি নয়, প্রায়ই এ ধরনের ভুয়া ডিবি বা র্যাব পরিচয় দিয়ে ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণের মতো সংঘবদ্ধ অপরাধে জড়ানোর অভিযোগে গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া যায়। এই চক্রগুলোর সঙ্গে যুক্ত থাকে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, মাদক নিয়ন্ত্রণের সাবেক বা চাকরিচ্যুত সদস্যরা। এ ধরনের একাধিক মামলা তদন্ত করা ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ডিবির সাবেক এক কর্মকর্তা (বর্তমানে রাজশাহীতে কর্মরত) বলেন, যেসব চাকরিচ্যুত সদস্য এ ধরনের অপরাধে জড়ায়, তারা বাহিনীতে থাকা অবস্থাতেও বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িয়েছিল। তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তাদের চাকরি চলে যায়। এই অপরাধীরা বিভিন্ন বাহিনীর সাবেক হওয়ায় একজন পুলিশ বা র্যাব সদস্য কীভাবে আচরণ করে, তাদের অ্যাপ্রোচ কেমন হয়, তা তাদের জানা। ডিবি বা র্যাবের জ্যাকেট বিভিন্ন মাধ্যম থেকে সংগ্রহ করে। সঙ্গে থাকে ওয়াকিটকি, হ্যান্ডকাফ ও আগ্নেয়াস্ত্র। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্রগুলো পাওয়া যায় ভুয়া। তারা এসব সরঞ্জাম নিয়ে ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণের মতো অপরাধগুলো ঘটায়। এতদিন ডিবি বা র্যাবের পরিচয়ে ছিনতাই, ডাকাতির মতো ঘটনাগুলো ঘটলেও সম্প্রতি সেনাবাহিনী ও র্যাবের পোশাকে মোহাম্মদপুরে একটি বাসায় ডাকাতি হয়েছে। গত ১১ অক্টোবর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের একটি বাসা থেকে নগদ ৭৫ লাখ টাকা, বিভিন্ন ধরনের ৭০ ভরি স্বর্ণালংকার ও মোবাইল ফোন নিয়ে যায় তারা। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী আবু বক্কর মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেছেন। জড়িতদের গ্রেপ্তারে ডিএমপি ডিবি, র্যাব, পুলিশ কাজ করছে। গতকাল রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব ও ডিবি। এই ১১ জনের মধ্যে ছয়জন বিভিন্ন বাহিনীর সাবেক সদস্য। ডিএমপির উপপুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ-উত্তর) মাসুদ আলম বলেন, গ্রেপ্তার তিনজনের মধ্যে একজন রয়েছে সাবেক বিজিবি সদস্য। সে কোনো কারণে চাকরিচ্যুত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ডাকাতিতে জড়িয়ে যায়। বাহিনীগুলো থেকে চাকরি যাওয়ার পর অতীতের অপরাধপ্রবণতা থেকে ডাকাতির মতো ঘটনায় জড়িয়ে যাচ্ছে। কেউই ধরাছোঁয়ায় বাইরে থাকছে না বলে জানিয়েছেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনিম ফেরদৌস। তিনি বলেন, এই চাকরিচ্যুতরা কর্মস্থলে থাকা অবস্থাতেও অপরাধে জড়িয়েছিল বলে পরবর্তী সময়ে তাদের চাকরি যায়। চাকরি চলে যাওয়ার পর তারা নতুনভাবে অপরাধে জড়ায়। আর সেক্ষেত্রে বাহিনীগুলোর নাম ব্যবহার করে। তারা মনে করে, অভিজ্ঞতার কারণে তারা পার পেয়ে যাবে। কিন্তু আমরা বলতে চাই, কেউ অপরাধ করে পার পাবে না। অতীতেও এ ধরনের কাজের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের আমরা গ্রেপ্তার করেছি। সম্প্রতি মোহাম্মদপুরে ঘটে যাওয়া ডাকাতির সঙ্গে যারা জড়িত, তাদেরও আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। বিভিন্ন অপরাধে চাকরিচ্যুত হওয়া সদস্যদের এ ধরনের অপরাধ ঠেকাতে কঠোর নজরদারি কথা জানিয়েছিল পুলিশ সদর দপ্তর। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে পুলিশ সদর দপ্তরে একসভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জানানো হয়, পুলিশ, বিজিবিসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে যারা চাকরিচ্যুত হয়, তাদের তালিকা করা হবে। চাকরিচ্যুতদের তালিকা সংশ্লিষ্ট থানা ও দপ্তরে পাঠিয়ে তাদের কার্যক্রম নজরদারিতে রাখা হবে। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এ সিদ্ধান্তের এক বছর পর এসেও অবস্থার উন্নতি হয়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, কোনো কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এসব সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু তা সঠিকভাবে প্রতিপালন হয় না। এই অপরাধপ্রবণ চাকরিচ্যুতদের তালিকা করা উচিত। একটি নির্ধারিত সময় পরপর এই তালিকা ধরে তাদের অবস্থান, কার্যক্রম নজরদারি করা প্রয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, বিভিন্ন বাহিনী থেকে চাকরি হারানো ব্যক্তিদের অপরাধে জড়ানো নতুন নয়। কিন্তু অতীতের যেসব ঘটনায় তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়, তাদের একটি অংশ আইনের আওতায় এলেও নানা অবহেলার কারণে দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয় না। উপরন্তু এইসব অপরাধী জানে, কীভাবে আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাওয়া যায়। সেভাবেই তারা কাজ করে। বিভিন্ন বাহিনীর পোশাকসহ অন্যান্য সরঞ্জাম সহজেই কেনা যায়। তা কঠোরভাবে বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন তৌহিদুল হক। তিনি বলেন, পোশাক, ওয়াকিটকি, হ্যান্ডকাফের মতো সরঞ্জাম সহজেই বাইরে থেকে কেনা যায়। তা বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি যেসব সদস্য অভিযানে যাবে, তারা আসল না নকল, তা চিহ্নিতের ব্যবস্থা থাকতে হবে।