আরজি করে কতটা চাপে মমতা

১০ অক্টোবর, ২০২৪ | ১০:৪৫ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

কলকাতার আরজি কর হাসপাতালে গত ৮ আগস্ট এক নারী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ তো বটে, পুরো ভারতেই প্রতিবাদে বিক্ষোভ শুরু হয়। পরে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ থেমে গেলেও পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা এখনো উত্তাল। আরজি কর ঘটনার দ্রুত বিচারসহ ১০ দফা দাবিতে দুর্গাপূজার মধ্যেও অনশনে নেমেছেন জুনিয়র চিকিৎসকরা। এখন রাজ্যের বিভিন্ন জেলার সিনিয়র চিকিৎসকরাও কাজে ইস্তফা দিয়ে তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করায় আরও তীব্র হচ্ছে এ আন্দোলন। এ অবস্থায় রাজ্য সরকার বেশ বিপাকে পড়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। বিশ্লেষকদের মতে, দুই মাস পরও ঘটনার কোনো সুরাহা না হওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে। তাদের মতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার শাসনামলে তো বটেই—এমনকি পুরো রাজনৈতিক জীবনে এতটা চাপে পড়েননি। বিস্তারিত জানাচ্ছেন ওয়াহেদুজ্জামান সরকার জুনিয়রদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে মঙ্গলবার ‘গণইস্তফার’ পথে হেঁটেছিলেন আরজি কর হাসপাতালের ৫০ জন সিনিয়র চিকিৎসক। বুধবার একইভাবে ‘গণইস্তফা’ দেন কলকাতা মেডিকেল কলেজের সিনিয়ররাও। মঙ্গলবারই তারা রাজ্য প্রশাসনের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি দিয়ে জানিয়েছিলেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জুনিয়রদের দাবি পূরণ না হলে, তারাও ‘গণইস্তফা’ দেবেন। কলকাতা মেডিকেলের সিনিয়র ডাক্তারদের অভিযোগ, ২৪ ঘণ্টার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হলেও রাজ্য সরকারের তরফে কোনো ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। তাই বাধ্য হয়েই ‘গণইস্তফা’ দিচ্ছেন। এর পরই বুধবার রাজ্যের বিভিন্ন জেলার মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকদেরও গণইস্তফা দেওয়ার খবর আসতে থাকে। এ অবস্থায় পুরো রাজ্যের চিকিৎসাসেবা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাজ্য সচিবালয় নবান্নের ওপর চাপ বাড়ল বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও রাজ্য প্রশাসন মনে করছে, এটা কোনো ইস্তফাই নয়। কোনো সরকারি কর্মী এভাবে ইস্তফা দিতে পারেন না। তার আলাদা প্রক্রিয়া রয়েছে। ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্ট’-এর সাতজন প্রতিনিধি ১০ দফা দাবিতে আমরণ অনশন করছেন ধর্মতলায়। গত শনিবার শুরু হয় এ কর্মসূচি। পূজার মধ্যেও এ কর্মসূচি দিনে দিনে বড় হচ্ছে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ আরজি করের ঘটনার পর পরই যেভাবে কলকাতায় রাত দখলের কর্মসূচিতে নেমেছিলেন, ঠিক সেভাবেই এ অনশন কর্মসূচিতেও সমর্থন জানাচ্ছেন। রাজ্য সরকার অবশ্য শুরু থেকেই বলে আসছে বিজেপিসহ বিরোধী দলগুলো এ আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে পরিচালিত করছে। তাদের উদ্দেশ্য ভিন্ন। তারা ঘটনার বিচার চান না। তারা চান ক্ষমতার চেয়ার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার মতো তাকেও ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর ষড়যন্ত্র হচ্ছে; কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। কারণ দুই দেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। তাকে এভাবে নামানো যাবে না। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, মমতা যাই বলুন না কেন তিনি বেশ চাপে পড়েছেন। কারণ এর আগে পশ্চিমবঙ্গের কোনো আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এভাবে নামেনি। এটা স্রেফ আরজি করের একটি ঘটনা নিয়ে নয়। এর আগেও এ ধরনের ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের অনেক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সেগুলোরও কোনো বিচার হয়নি। বরং সে ঘটনাগুলো ভিন্ন খাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাদের মতে, এর আগে নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়ে কিছুটা এ ধরনের নাগরিক প্রতিবাদ দেখা গিয়েছিল। তবে সেটি ছিল তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের নীতির বিরুদ্ধে। আর এবারের প্রতিবাদ যেমন হচ্ছে বিচারের দাবিতে, তেমনই উঠে আসছে সমাজে পুঞ্জীভূত ক্ষোভও। রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভাশিস মৈত্র বলেন, এই সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ক্ষমতাসীন দল এবং সরকারের কাছে অভিনব। তার কথায়, ‘এর একটা কারণ হলো এই প্রতিবাদীরা একেবারেই অচেনা-অজানা। কীভাবে এদের মোকাবিলা করা হবে, সেটা ক্ষমতাসীন দল বা সরকার জানে না।’ তিনি বলেন, ‘সাধারণ নাগরিকদের প্রতিবাদ-যেটা শুরু হয়েছিল ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হওয়া এক নারীর বিচারের দাবিতে, বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে নারী-সুরক্ষার দাবিতে। রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল বিজেপি সেভাবে সরাসরি এই আন্দোলনে ছিল না গোড়ার দিকে। তারা দেখলে যে, পতাকা-ছাড়া কোনো প্রতিবাদে তো ব্যাপক সাড়া পড়ছে, তাই এখন বিজেপি নেমে পড়লে নবান্ন ঘেরাও বা বন্ধ ইত্যাদিতে। সেটা আদৌ সাড়া ফেলেছে কি না, তা ভিন্ন প্রসঙ্গ। বিজেপির আন্দোলন মোকাবিলা করা তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে অনেক সুবিধাজনক। কারণ এটা দুপক্ষের কাছেই চেনা রাজনৈতিক ময়দান, চেনা প্রতিপক্ষ। কিন্তু সমাজের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ নিয়ে চিকিৎসকদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে যেভাবে সাধারণ মানুষ এক কাতারে মিলে যাচ্ছেন, তা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে কতদিন সামাল দেওয়া সম্ভব সেটা একটা প্রশ্ন। তা ছাড়া রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বয়য়কটের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘রাজ্যে যা ঘটনা ঘটছে তাতে আমি রাজ্যপাল হয়ে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারি না। বাংলার সমাজের পাশে দাঁড়িয়ে আমি স্থির করেছি, আমি মুখ্যমন্ত্রীকে সামাজিকভাবে বয়কট করব।’ রাজ্যপালের এ ঘোষণাও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য একটি অশনি সংকেত।