দুই কোটি কর্মক্ষম মানুষ ভুগছেন মনোরোগে
বহুজাতিক কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগে কাজ করেন ইফতেখার আহমেদ। কর্মক্ষেত্রে চাপ আর পারিবারিক দায়িত্বে দিশেহারা তিনি। তবে বহুদিন ধরে এ সমস্যায় ভুগলেও চিকিৎসকের কাছে যাননি। অবস্থার অবনতি হলে নিরুপায় হয়ে গত মঙ্গলবার যান জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে। চিকিৎসকের পরামর্শে এখন স্বস্তিবোধ করছেন ইফতেখার। তিনিই নন, দেশের প্রায় ১৯ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। গবেষণা বলছে, আর্থসামাজিক অবস্থা, মানসিক চাপ ও মনোসামাজিক কারণে মানসিক রোগের প্রকোপ বাড়ছে। তবে শুরুর দিকে এটিকে রোগ হিসেবে গুরুত্বও দেওয়া হয় না। এতেই বাড়তে থাকে সমস্যা। যার প্রভাব পড়ে পরিবার, সমাজ ও অর্থনীতিতে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, শুধু হতাশা ও উদ্বেগের কারণে প্রতি বছর প্রায় ১২০০ কোটি কর্মদিবস নষ্ট হয়। অন্যদিকে পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৬২ শতাংশ কর্মক্ষম, যাদের বয়স ১৫ থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে। সংখ্যায় যা ১০ কোটি ৫০ লাখ। সে হিসেবে প্রায় এক কোটি ৯০ লাখের বেশি মানুষ মানসিক সমস্যায় ভুগছে। এমন প্রেক্ষাপটে আজ বৃহস্পতিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘কর্মস্থলে মানসিক স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দেয়ার এখনই সময়’। দিবসটি উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া করেছে। বিশ্বব্যাপী মানসিক রোগ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা, কুসংস্কার দূর এবং জনসচেতনতা সৃষ্টিতে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথ ১৯৯২ সাল থেকে ১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালন শুরু করে। দিবসটি উপলক্ষে র্যালি, আলোচনা সভা, লিফলেট বিতরণ, পোস্টার ও ব্যানার প্রদর্শন এবং বিনামূল্যে মানসিক চিকিৎসাসেবা প্রদান কর্মসূটি গ্রহণ করেছে। সুষ্ঠু, সমর্থনমূলক এবং সুস্থ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে কর্মীরা যেমন কাজের প্রতি মনোযোগী হবে, তেমনি প্রতিষ্ঠানও হবে লাভবান। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে সামগ্রিক অর্থনীতিতেও। কর্মক্ষেত্রে সুস্থ কর্ম পরিবেশ তৈরি, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা আলোচনা, পর্যাপ্ত বিরতি ও বিশ্রাম নিশ্চিত করা, অফিস সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করার চর্চা, মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন এবং মেন্টাল হেলথ সাপোর্ট প্রোগ্রাম চালুর মাধ্যমে মানসিক রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে মত দিয়েছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। মনের যত্ন নিতে হবে। তারপরও কারও মধ্যে মানসিক রোগ বা সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হতে হবে। দেশের মানসিক স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এবং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) যৌথ গবেষণায় দেখা যায়, দেশে প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ মানসিক রোগাক্রান্ত। এর মধ্যে উদ্বেগ আধিক্যে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ, বিষণ্ণতায় ৬ দশমিক ৭ শতাংশ, সোমাটিক সিমটিম ডিজঅর্ডার ২ দশমিক ৩ শতাংশ, অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার দশমিক সাত শতাংশ, বাইপোলার ডিজঅর্ডার দশমিক পাঁচ শতাংশ এবং সিজোফ্রেনিয়া দশমিক এক শতাংশ। মাদকাসক্তে শিশু-কিশোরদের মধ্যে মানসিক রোগের অবস্থা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১২ দশমিক ৬ শতাংশ মানসিক রোগাক্রান্ত। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তথ্য: দেশে প্রতি দুই লাখ মানুষের জন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আছেন মাত্র ৩৫০ জন। সেন হিসেবে প্রতি ৬ লাখ মানুষের জন্য একজন। সাইকোলজিস্ট আছে মাত্র ৫৬৫ জন। সাইকিয়াট্রিক সোস্যাল ওয়ার্কার ৭ জন এবং ৩২৪ জন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট। সীমিত এই জনবলের মধ্যেও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সেবা ও জনসচেতনতার লক্ষ্যে দেশের ২১ হাজার ২৬৭ জন চিকিৎসককে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও ৯ হাজার ৪০০ স্বাস্থ্যকর্মী, সরকারি হাসপাতালের ৭০০ নার্স, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ২৮ হাজার নার্স এবং ১৭২ জন ইমামকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে ৬০ জন চিকিৎসক, ১৬৮ জন স্বাস্থ্যকর্মী এবং ৭২ জন এনজিও কর্মীকে দুর্যোগ-পরবর্তী মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সেবার প্রাপ্যতা: মানসিক রোগীদের চিকিৎসায় রাজধানী ঢাকায় ৪০০ শয্যার জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এবং পাবনায় ৫০০ শয্যার মানসিক হাসপাতাল রয়েছে। এ ছাড়াও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০ শয্যার একটি পরিপূর্ণ বিভাগ রয়েছে। এর বাইরে দেশের বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজে আনুমানিক ১৫০ শয্যার মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক অন্তঃবিভাগ, সিএমএইচের মনোবিদ্যা বিভাগে ২০ শয্যা এবং চারটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে আছে ১৯৯টি শয্যা। এ ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাসিরউল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিটসহ দেশের ৩৫টি শিশু বিকাশ কেন্দ্রে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে রোগীর সেবায় এডাল্ট সাইকিয়াট্রিক বিভাগে শয্যা রয়েছে ৫০টি। জেরিয়াট্রিক অ্যান্ড অরগানিক সাইকিয়াট্রি বিভাগে ৪৫টি, চাইল্ড, অ্যাডোলেসেন্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি বিভাগে ৩৪টি, কমিউনিটি অ্যান্ড সোসাল সাইকিয়াট্রি বিভাগে ৩৯টি, সাইকোথেরাপি অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগে ৪০টি, এডিকশন সাইকিয়াট্রি বিভাগে ২৫টি, ফরেনসিক সাইকিয়াট্রি বিভাগে ২২টি, স্পেশাল ইউনিট (ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের এবং হতাহত ব্যক্তির পরিবারের জন্য) ২০টি এবং কেবিন রয়েছে ২৫টি। সেবা গ্রহণ: চলতি বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগে সেবা নিয়েছে ৬ হাজার ১৯৬ জন। ভর্তি হয়েছেন ৪ হাজার ৩৩৩ জন এবং বহির্বিভাগে স্বাস্থ্যসেবা নিয়েছেন ৬৪ হাজার ২১৫ জন। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর সেবা দিয়েছেন ১৪১ জন চিকিৎসক, ১৫৮ জন নার্স এবং ২৪৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী।