কালো পতাকায় কালেমা: বিপজ্জনক প্রবণতা
শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর এ দেশের মানুষের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে কথা বলার স্বাধীনতা ফিরে পাওয়া। গত দেড় দশকে যেসব রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠনের কন্ঠরোধ করা হয়েছিলো তারা আবার স্বাধীন ভাবে মত প্রকাশ করতে পারছে। শেখ হাসিনার শাসনে ধর্মীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলো নিপীড়নের শিকার হয়েছে। এসব সংগঠন এখন নানা ধরনের কর্মসূচী নিয়ে মাঠে নেমেছে। আমরা দেখছি রাজধানীর বড় শিক্ষা প্রতিষ্টানের শিক্ষার্থীরাও ধর্মীয় নানা ইস্যুতে মিছিল ও সমাবেশে অংশ নিচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে মানুষের কথা বলার যে স্বাধীনতা হরন করা হয়েছে তার প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরাই যেনো বেশি সরব। ভবিষ্যত বাংলাদেশের জন্য এগুলো ইতিবাচক উদ্যেগ হিসাবে দেখা উচিত। গত কয়েক সপ্তাহ থেকে রাজধানী ও রাজধানীর বাইরে সীরাত বিষয়ে নানা অনুষ্ঠান হচ্ছে। ভারতে রাসুল সা. এর অবমাননার প্রতিবাদে হয়েছে মিছিল ও সমাবেশ। এ ধরনের সমাবেশ ও মিছিল অতীতেও বাংলাদেশে হয়েছে। কিন্তু এরমধ্যে আমরা কিছু সন্দেহজনক তৎপরতা লক্ষ্য করছি। দেখা যাচ্ছে বেশি কিছু মিছিল ও সমাবেশে কালেমা খচিত কালো পতাকা নিয়ে অনেক তরুণ মিছিলে অংশ নিচ্ছেন। এ ধরনের পতাকা সন্ত্রাসবাদী সংগঠন দায়েশ ব্যবহার করে থাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন তথ্য পাওয়া গেছে, মিছিল শুরু হওয়ার পর কিছু লোক এসে হঠাৎ ছাত্রদের হাতে এসব পতাকা ধরে দিচ্ছে। আবার অনলাইনে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত কিছু সংগঠন এ ধরনের পতাকা নিয়ে মিছিল সমাবেশে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করছে বলে খবর এসেছে। ধর্মীয় সমাবেশ ও আলোচনায় কালেমা খচিত পতাকার ব্যবহার নিয়ে কারো কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু সেই প্রতীক যখন উগ্রপন্থী বিশেষ গোষ্ঠীর প্রতীকের সঙ্গে মিলে যায় তখন তাতে সন্দেহ করার মতো উপাদান যোগ হয়। বাংলাদেশে কালেমা খচিত পতাকার ব্যবহার নতুন কিছু নয়। প্রতি ঈদে রাজধানী প্রধান প্রধান সড়ক ও সড়ক দ্বীপগুলো কালেমা খচিত পতাকায় সজ্জিত করা হয়। ফলে কালেমার পতাকা যে কেউ ব্যবহার করতে পারে। বহু মুসলিম দেশের বিভিন্ন সংগঠন কালেমা খচিত পতাকা ব্যবহার করে থাকে। সৌদি আরবের জাতীয় পতাকায় কালেমা খচিত রয়েছে। আবার লেবাননের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হিজবুল্লাহ তাদের সভা সমাবেশে লালের মধ্যে কালো লেখা কালেমা খচিত পতাকা ব্যবহার করে থাকে। সাধারনভাবে মুসলমানরা ব্র্যান্ড কালার হিসাবে সবুজ ব্যবহার করে থাকে। মসজিদে নববীতে রাসুল সা. এর রওজা মোবারক গম্বুজ সবুজ রংয়ে সজ্জিত। এছাড়া যুগ যুগ ধরে মুসলিমদের আরেকটি প্রতীক হচ্ছে ক্রিসেন্ট বা চাঁদ- তারার ব্যবহার। অপরদিকে কালো কাপড়ে কালেমা খচিত পতাকা ব্যবহার আমরা দেখছি ২০১৩ সাল থেকে মধ্যপ্রাচ্যে দায়েশের উত্থানের পর থেকে। বাংলাদেশে যে কোনো মিছিল সমাবেশে এ ধরনের পতাকার ব্যবহার আর্ন্তজাতিক বিশ্বে ভুল বার্তা দিতে পারে। ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের পর থেকে ভারতের গণমাধ্যম বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারনায় মেতে উঠেছে। তারা শুরু থেকে এই অভ্যুত্থানকে দেখাতে চাইছে ইসলামপন্থীদের উত্থান হিসাবে। অথচ এই অভ্যুত্থান ছিলো বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরনের বিরুদ্ধে একটি গণজাগরন। যেখানে সব রাজনৈতিক দল ও মত- পথের লোকের অংশগ্রহণ ছিলো। এই আন্দোলনে অবশ্যই ইসলামপন্থীদের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা ছিলো। তারা এই আন্দোলনে শামিল হয়েছিলো ফ্যাসিস্ট শাসন অবসানের জন্য। দায়েশের মতো ধ্বংসাত্মক কোনো রাষ্ট্র গঠনের ধারনা থেকে নয়। ড. ইউনুসের নেতৃত্বে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার এখন পর্যন্ত সবচেয়ে যে বড় সাফল্য দেখিয়েছে- তা হলো স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির পথ অনুসরন করা। পশ্চিমা বিশ্বের জোরালো সমর্থন ছাড়াও তিনি মুসলিম দেশগুলোর সমর্থন পাচ্ছেন। আমরা এর বেশ কিছু উদহারন দেখছি। মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী দেশ মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহীম প্রথম কোনো সরকার প্রধান হিসাবে বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। জাতিসংঘে সাধারন অধিবেশনে যোগ দিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফের সাথে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুসের বৈঠক হয়েছে। আরব আমিরাতে গণআন্দোলনের পক্ষে অংশ নিয়ে কারাবন্দি বাংলাদেশি নাগরিকদের মুক্তি দেয়া হয়েছে। সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্সের বাংলাদেশ সফর নিয়ে আলোচনা চলছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। এসব তৎপরতা থেকে আমরা বুঝতে পারি, ভারত নির্ভর পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তে বাংলাদেশ স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি এগিয়ে যাচ্ছে। যেখানে মুসলিম বিশ্বের সাথে সর্ম্পকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আবার পশ্চিমা বিশ্বের সর্ম্পক নতুন উচ্চতায় পৌছেছে। জাতিসংঘ সাধারন অধিবেশনের ফাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে বৈঠক হয়েছে। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এই স্বাধীন ও ভারসাম্যমুলক অবস্থান ভারতের পছন্দ হওয়ার কোনো কারন নেই। ফলে ভারতীয় নীতি নির্ধারকরা বাংলাদেশে বিরোধী অবস্থান তীব্র করছে। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বাংলাদেশের মানুষের প্রতি নূন্যতম সম্মান ও মর্যাদা না দেখিয়ে তাদেরকে উল্টো ঝুলিয়ে মারার কথা বলছে। খোদ মোদিও ঝাড়খন্ডে বাংলাদেশ নিয়ে সর্তকতা উচ্চারন করছেন। এ ধরনের বক্তব্য থেকে বোঝা যায় বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট শাসনের অবসান এখনও ভারত মেনে নিতে পারেনি। আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে ভারত চেষ্টা করে যাচ্ছে বাংলাদেশকে মৌলবাদী রাষ্ট্র হিসাবে উপসাস্থাপন করতে। পশ্চিমা গণমাধ্যমের ভারত ও ভারতীয় বংশোদ্ভুত ব্যক্তিদের যথেষ্ট প্রভাব আছে। ইতোমধ্যে ব্লুমবার্গের মতো প্রভাবশালী পশ্চিমা গণমাধ্যমে বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থানের ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। এ ধরনের প্রচারনা বাংলাদেশের সরকারের ওপর আগামী দিনে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করতে পারে। ভারত ও তার অনুগত বাংলাদেশের ফ্যাসিস্টরা দেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করবে। যেখানে দেখানো সম্ভব হবে বাংলাদেশে উগ্রপন্থীরা রাষ্ট্রপরিচালনায় ভূমিকা রাখছে। ছাত্র গণ অভূত্থানের পর সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ভুয়া খবর প্রচার করে বাংলাদেশের এমন চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছিলো। এই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিলো দেশের সব রাজনৈতিক দল ও ইসলামপন্থীদের সক্রিয় ভূমিকার কারনে। মাদ্রাসা ছাত্রদের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার নানা উদ্যেগ আর্ন্তজাতিক গণমাধ্যমে প্রশংসিত হয়েছে। এখন বাংলাদেশে দায়েশের সংশ্লিষ্টতা দেখানের যে কোনো গোপন তৎপরতার বিরুদ্ধে ইসলামপন্থীদের এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষার্থীরা যাতে সন্ত্রাসবাদী কোনো সংগঠনের প্রতীক ব্যবহার না করেন সে ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি করা দরকার। মনে রাখতে হবে এ ধরনের তৎপরতা শুধু বাংলাদেশ বিরোধী প্রোপাগাণ্ডা উসকে দেবে না, ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলোর জন্য বিপদের কারণ হতে পারে। লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট