আশুলিয়ায় গুলিতে এক শ্রমিক নিহত, চারজন গুলিবিদ্ধসহ আহত ৩০
শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায় বকেয়া বেতন ও পোশাক কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে শ্রমিকদের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে কাউসার নামে এক শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া চারজন গুলিবিদ্ধসহ অন্তত ৩০ শ্রমিক আহত হয়েছেন। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্তত ৫টি গাড়ি ভাঙচুর করেছে। এ ঘটনায় শিল্প পুলিশ-১-এর পুলিশ সুপার সারোয়ার আলমসহ যৌথ বাহিনীর কয়েকজন সদস্য আহত হয়েছেন। শ্রমিক নিহতের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে বিজিএমইএ জানিয়েছে, নিহত শ্রমিকের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসাবে ৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। শ্রম আইন অনুযায়ী তার সব পাওনা অতি দ্রুত পরিশোধ করা হবে। সোমবার বেলা ১২টার দিকে টঙ্গী-আশুলিয়া-ইপিজেড সড়কের জিরাবো এলাকার মন্ডল গ্রুপের কারখানার সামনে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। নিহত শ্রমিক কাউসার হোসাইন খান (২৭) আশুলিয়ার জিরাবো এলাকার ম্যাঙ্গো টেক্স লিমিটেড কারখানায় কাজ করতেন। দুপুর ২টার দিকে তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার মো. ইউসুফ আলী। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবে রক্তক্ষয়ী অধ্যায়ের মাধ্যমে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক হতাহতের ঘটনা এটাই প্রথম। প্রাথমিকভাবে আহতদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ দুজনের নাম জানা গেছে। তারা হলেন-ন্যাচারাল ডেনিমসের শ্রমিক হাবীব ও ন্যাচারাল ইন্ডিগো কারখানার শ্রমিক নাজমুল হাসান। আহত অন্যদের নাম-পরিচয় জানা যায়নি। গুলিবিদ্ধ দুজন শ্রমিককে পিএমকে হাসপাতাল ও দুজনকে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। শ্রমিকরা জানান, সকালে মন্ডল গ্রুপের শ্রমিকদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মালিকপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ত্রিপক্ষীয় মিটিং চলছিল। এ সময় সমঝোতা না হওয়ায় শ্রমিকরা কারখানার বাইরে অবস্থান নেন। পরে অন্যান্য কারখানার শ্রমিকরা সেখানে জড়ো হতে থাকেন। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও শ্রমিকরা মুখোমুখি অবস্থান নেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা লাঠিচার্জ শুরু করেন। শ্রমিকরা র্যাব ও পুলিশের কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে। পরে শ্রমিকরা আরও উত্তেজিত হলে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে গুলি চালায়। এ সময় ৫ জন শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হলে তাদের উদ্ধার করে স্থানীয় পিএমকে হাসপাতাল ও সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এনাম মেডিকেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক শ্রমিক কাউসার হোসাইন খানকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লাঠিচার্জে অন্তত ৩০ জন শ্রমিক আহত হয়েছেন। এনাম মেডিকেলের ডিউটি ম্যানেজার ইউসুফ আলী বলেন, আমাদের হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ তিনজনকে আনা হয়। তাদের মধ্যে কাউসার মারা গেছেন। বাকি দুজনের চিকিৎসা চলছে। ন্যাচারাল ডেনিমসের শ্রমিক সুমন বলেন, সকালে তাদের কারখানায় সবাই কাজ করছিল। তাদের কারখানায় কোনো ধরনের আন্দোলন হয়নি। তবে মন্ডল গ্রুপের শ্রমিকরা কারখানার সামনে আন্দোলন শুরু করলে তাদের শ্রমিকরা সংহতি জানিয়ে মন্ডল গ্রুপের কারখানার সামনে যায়। সেখানে আরও কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা যোগ দেয়। এ সময় শ্রমিকদের ওপর লাঠিচার্জ শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। একপর্যায়ে গুলি ছুড়লে ৫ জন গুলিবিদ্ধ হয়। পরে আমি তাদের মধ্যে দুজনকে হাসপাতালে নিয়ে আসি। এ ছাড়া প্রায় ৩০ জন শ্রমিক আহত হয়েছেন। তারা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। পিএমকে হাসপাতালের অ্যাডমিন ম্যানেজার নাজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের হাসপাতালে চার জন শ্রমিককে আহত অবস্থায় আনা হয়েছে। তাদের মধ্যে দুজনের পায়ে গুলি লেগেছে। তাদের চিকিৎসা চলছে। এ ব্যাপারে ন্যাচারাল ডেনিম কারখানার এইচআর অ্যাডমিন সবুজ হাওলাদার বলেন, আমাদের কারখানায় কোনো সমস্যা ছিল না। সকাল থেকেই শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করছিল। হঠাৎ শ্রমিকদের কাছে গুজব আসে পাশের মন্ডল গার্মেন্টসের শ্রমিক মারা গেছে। এটা শুনেই সব শ্রমিক একসঙ্গে কারখানা থেকে বেরিয়ে মন্ডল গার্মেন্টসের সামনে চলে যায়। পরে ওখানে কী ঘটেছে আমার জানা নেই। এদিকে সকালের দিকে পুলিশ জানায়, সোমবার সকালে নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের বাইপাইল এলাকায় অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে বার্ডস গ্রুপের শ্রমিকরা। ২৮ আগস্ট থেকে আশুলিয়ার বুড়িবাজার এলাকার বার্ডস গ্রুপ বন্ধ ঘোষণা করে মালিকপক্ষ। সোমবার শ্রমিকদের সকল পাওনাদি পরিশোধের কথা থাকলেও মালিকপক্ষ তা করেনি। এরই প্রতিবাদে সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা শ্রমিকদের বুঝিয়ে সড়ক ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। এদিকে শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায় সোমবার খোলা দেখা গেছে অধিকাংশ পোশাক কারখানা। এর মধ্যে শ্রম আইনের ১৩(১) ধারায় ১১টি ও সাধারণ ছুটির কারণে ৭টিসহ মোট ১৮টি কারখানা বন্ধ রয়েছে। শিল্প পুলিশ বলছে, যে কোনো ধরনের সহিংসতা এড়াতে শিল্পাঞ্চল ঘিরে রয়েছে যৌথবাহিনীর সমন্বয়ে পুলিশ, আর্মড পুলিশ, শিল্প পুলিশ, বিজিবি ও সেনা সদস্যদের তৎপরতা। বিজিএমইএ’র দুঃখ প্রকাশ : এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে শ্রমিক নিহতের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে বিজিএমইএ জানিয়েছে, নিহত শ্রমিক কাউসার হোসেন খানের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসাবে ৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। শ্রম আইন অনুযায়ী তার সব পাওনাদি অতি দ্রুত পরিশোধ করা হবে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সোমবার সকালে টঙ্গী-আশুলিয়া-ইপিজেড সড়কের জিরাবো এলাকার মন্ডল গ্রুপের কারখানায় মন্ডল গ্রুপের শ্রমিকদের দাবিদাওয়া নিয়ে সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে মালিকপক্ষের আলোচনা চলছিল। এ সময় কিছু বহিরাগত ব্যক্তি মন্ডল গ্রুপের ২ জন শ্রমিকের মৃত্যুর গুজব তুলে কারখানার বাইরে অবস্থান নেন। পরে অন্যান্য কারখানার শ্রমিকরাও সেখানে জড়ো হতে থাকেন। এ সময় ২ জন বহিরাগত ব্যক্তি কারখানার বাইরে থেকে কারখানা লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করেন। এতে করে কারখানা ভবনের কাচ ভেঙে যায় এবং আসবাবপত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কারখানার নিচে নেমে আসেন। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও শ্রমিকরা মুখোমুখি অবস্থান নেন। বহিরাগতরা ও শ্রমিকরা মিলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে। পরে শ্রমিকরা আরও উত্তেজিত হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আত্মরক্ষার্থে গুলি চালাতে বাধ্য হয়। পোশাক কারখানা ভাঙচুর-কোনাবাড়ীতে আটক ৮ জন : গাজীপুর ও দক্ষিণ প্রতিনিধি জানান, গাজীপুর মহানগরীর কোনাবাড়ীতে পোশাক কারখানায় ভাঙচুরের অভিযোগে ৮ জনকে আটক করেছে যৌথ বাহিনী। সোমবার বিকালে কোনাবাড়ী থানার আমবাগ পি.এন. কম্পোজিট লিমিটেড কারখানার সামনে থেকে তাদের আটক করা হয়। আটকরা হলো-সজিব, আলাউদ্দিন, মঞ্জু, সম্রাট, মোশাররফ হোসেন, শাকিল, হৃদয় মন্ডল এবং মোয়াজ্জেম আলী। তাদেরকে কোনাবাড়ী থানায় হস্তান্তর করেছে যৌথ বাহিনী। এম এম নিটওয়্যার লিমিটেড কারখানার এডমিন ম্যানেজার মো. মনোয়ার হোসেন বলেন, বিজিএমইএ ঘোষিত শ্রমিকদের যে দাবি তা মেনে নেওয়া হয়েছে। তারপরও কেন তারা আন্দোলন করছে বুঝতে পারছি না। পি.এন. কম্পোজিট কারখানার এডমিন ম্যানেজার খালেকুজ্জামান বলেন, আমাদের শ্রমিকদের আগে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পার্শ্ববর্তী একটি কারখানার শ্রমিকরা এসে আমাদের কারখানায় ভাঙচুর চালায়। গাজীপুর মেট্রোপলিটন কোনাবাড়ী থানার এসআই তাইম উদ্দিন জানান, সোমবার দুপুরে এম এম নীটওয়্যার কারখানার শ্রমিকরা টিফিন বিল, নাইট বিল এবং হাজিরা বোনাস বৃদ্ধির দাবিতে কোনাবাড়ী আমবাগ আঞ্চলিক সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। পরে তারা আমবাগে পি.এন. কম্পোজিট কারখানার সামনে গিয়ে ভাঙচুর চালায়। শ্রমিকরা ওই কারখানার মূল ফটক ও বিল্ডিংয়ের গ্লাস ভাঙচুর করে। খবর পেয়ে শিল্প পুলিশ, মেট্রো পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসে শ্রমিকদের বুঝিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেন। এ সময় ভাঙচুর করার অভিযোগে ৮ জনকে আটক করা হয়। বাকি কারখানায় উৎপাদন স্বাভাবিক : গাজীপুর সদর উপজেলার ভবানীপুর এলাকার আরএন্ডজি বিডি লিমিটেড শ্রমিকরা কারখানা বন্ধ পেয়ে সকালে ফের বিক্ষোভ করেছে। পরে সকাল ৯টার দিকে শ্রমিকরা অবরোধ করে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক। এছাড়া জেলার বাকি সব কারখানায় উৎপাদন স্বাভাবিক রয়েছে। বেশ কিছু দিনের শ্রমিক আন্দোলনের কারণে গাজীপুরে চারটি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। সেগুলো সোমবারও খোলার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। গাজীপুর শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. খলিলুর রহমান বলেন, গাজীপুর জেলার ৯টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করায় সেগুলো বন্ধ রয়েছে। এছাড়া বলা যায় ৯৮ ভাগ কারখানায় উৎপাদন স্বাভাবিক রয়েছে।