বেতন গ্রেডে বৈষম্যের শিকার কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা

২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ | ৬:৩৮ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

পদমর্যাদা অনুপাতে বেতন গ্রেডের দিক দিয়ে বঞ্চিত কারা অধিদপ্তরের অধীনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অন্য অধিদপ্তরের তুলনায় তারা বৈষম্যের শিকার। কারারক্ষী থেকে শুরু করে আইজি (প্রিজন্স)-কেউই বৈষম্যের বাইরে নন। যুগের পর যুগ চলছে এ বৈষম্য। সমস্যা সমাধানের যৌক্তিকতা তুলে ধরে বিভিন্ন সময় অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সরকারের উচ্চপর্যায়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি। গত বছরের ডিসেম্বরে তৎকালীন কারা মহাপরিদর্শক এএসএম আনিসুল হক এ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাঠান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু সেটি ফেরত আসে। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টরা ক্ষোভ প্রকাশ করলেও তেমন কিছুই করার ছিল না। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এ দাবি ফের জোরালো হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে এআইজি জান্নাতুল ফরহাদের নেতৃত্বাধীন একটি টিম। ইতোমধ্যে দাবিদাওয়ার খসড়া তৈরি করা হয়েছে। শিগ্গিরই এ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাঠানো হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। সূত্র জানায়, কারা মহাপরিদর্শক হলেন অধিদপ্তরের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা। তার পদমর্যাদা দ্বিতীয় গ্রেড। অথচ পুলিশ, পাসপোর্ট, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ এবং ফায়ার সার্ভিসসহ অন্য অধিদপ্তরের প্রধানরা হলেন প্রথম গ্রেডের কর্মকর্তা। অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক হলেন কারা অধিদপ্তরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কর্মকর্তা। তার পদমর্যাদা চতুর্থ গ্রেড। অন্য অধিদপ্তরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কর্মকর্তা হলেন দ্বিতীয় ও তৃতীয় গ্রেডের। ডিআইজি (প্রিজন্স) সব কেন্দ্রীয় ও জেলা কারাগার তদারকি করেন। তার দপ্তর থেকে সব চিঠিপত্র কারা অধিদপ্তরসহ ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে অগ্রগামী হয়। তিনি হলেন পঞ্চম গ্রেডের কর্মকর্তা। অথচ পুলিশের ডিআইজি তৃতীয় এবং পাসপোর্ট অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ এবং হিসাব নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান চতুর্থ গ্রেডের কর্মকর্তা। সূত্র আরও জানায়, সিনিয়র কারা তত্ত্বাবধায়ক (সিনিয়র জেল সুপার) বিভাগীয় পর্যায়ে কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তার অধীনে ৫০০ থেকে ৯০০ ফোর্স কর্মরত থাকেন। কারা উপমহাপরিদর্শকের অনুপস্থিতিতে ডিআইজির (প্রিজন্স) দায়িত্ব পালন করেন সিনিয়র জেল সুপার। তিনি সপ্তম গ্রেডের কর্মকর্তা। আনসার বাহিনীতে ৪০০ ফোর্সের সমন্বয়ে গঠিত ব্যাটালিয়নের প্রধান থাকেন একজন পরিচালক (পঞ্চম গ্রেড)। জেলা কারাগারের প্রধান হিসাবে কাজ করেন কারা তত্ত্বাবধায়ক (জেল সুপার)। এ পদটি অষ্টম গ্রেডের। অথচ জেলার অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রধান চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ গ্রেডের। প্রস্তাবের খসড়ায় বলা হয়ছে, বাংলাদেশ জেলের প্রারম্ভিক পদ কারারক্ষী। এ পদটি ১৭তম গ্রেডের। পদোন্নতির সোপান অনুযায়ী, কারারক্ষী থেকে পদোন্নতি পেয়ে সহকারী প্রধান কারারক্ষী (১৬তম গ্রেড), সহকারী প্রধান কারারক্ষী থেকে পদোন্নতি পেয়ে প্রধান কারারক্ষী (১৫তম গ্রেড) হন। প্রধান কারারক্ষী থেকে পদোন্নতি পেয়ে সর্বপ্রধান কারারক্ষী (১৪তম গ্রেড) ও সর্বপ্রধান কারারক্ষী থেকে পদোন্নতি পেয়ে সার্জেন্ট ইনস্ট্রাক্টর (১৩তম গ্রেড) হন। এক্ষেত্রে দেখা যায়, কারারক্ষীরা ৪০ বছরের চাকরিজীবনে তৃতীয় শ্রেণিতে যোগদান করার পর ৪টি পদোন্নতি পেয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে থাকা অবস্থায়ই অবসরে যাচ্ছেন। কারারক্ষীদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রতিটি গ্রেড অতিক্রম করতে হয়। কিন্তু অন্য বাহিনী বা সরকারি প্রতিষ্ঠানে এ নিয়ম নেই। চারটি পদে পদোন্নতি পাওয়ার পর তারা দশম বা নবম গ্রেডে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। উদাহরণ হিসাবে পুলিশের কনস্টেবলদের পদোন্নতির সোপান তুলে ধরা হয় প্রস্তাবে। বলা হয়, কনস্টেবল ১৭ তম গ্রেডের পদ। তারা পদোন্নতি পেয়ে নায়েক হন। এ পদটি ১৫তম গ্রেডের। আর নায়েক থেকে পদোন্নতি পেয়ে এএসআই হন। এ পদটি ১৪তম গ্রেডের। তারা এএসআই থেকে এসআই হিসাবে পদোন্নতি পেয়ে চলে যান দশম গ্রেডে। আর দশম গ্রেড থেকে পদোন্নতি পেয়ে হন পরিদর্শক (নবম গ্রেড)। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সিপাহি, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ফায়ার ফাইটার ও বিজিবির সিপাহিরাও একইভাবে পদোন্নতি পচ্ছেন। কিন্তু ব্যত্যয় শুধু কারারক্ষীদের ক্ষেত্রে। ডেপুটি জেলাররা বঞ্চিত উল্লেখ করে প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কারাগারের নির্বাহী কর্মকর্তা হিসাবে বন্দি ও স্টাফ ব্যবস্থাপনায় জেলারের সহযোগী হিসাবে কাজ করেন ডেপুটি জেলাররা। জেলারদের অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত জেলার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন তারা। অধীনস্থ পাঁচ স্তরের কর্মীদের (কারারক্ষী থেকে সার্জেন্ট ইনস্ট্রাক্টর) কমান্ড করেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করা চাকরিপ্রার্থীরা ব্রিটিশ আমল থেকেই ডেপুটি জেলার হিসাবে নিয়োগ পাচ্ছিলেন। বর্তমানে বিসিএস (নন ক্যাডার ) থেকে তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এটি দ্বিতীয় শ্রেণির পদ। অথচ তারা বেতন পান ১১তম গ্রেডে। ২০০৬ সালের নিয়োগবিধি অনুযায়ী ৫ বছর পর এবং ২০১১ সালের নিয়োগবিধি অনুযায়ী ডেপুটি জেলার পদে যোগদানের ৭ বছর পর পদোন্নতি পেয়ে নবম গ্রেডে পদোন্নতি লাভের কথা থাকলেও অনেকেই ১২-১৫ বছর এক পদে কর্মরত। এ কারণে তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বাড়ছে। হতাশা থেকে অনেক ডেপুটি জেলার ইতোমধ্যেই চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন। একজন জেলার জানান, জেল কোডের ২৪১ ধারা অনুযায়ী ডেপুটি জেলার থেকে শতভাগ হারে জেলার পদে পদোন্নতি দেওয়ার কথা। কিন্তু ২০১৭ সালে জেলার পদে সরাসরি ৫০ ভাগ নিয়োগের বিধান রেখে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রণালয়। পরে ডেপুটি জেলাররা ওই প্রজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করেন। বিষয়টি বিচারাধীন থাকায় জারীকৃত প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ৫০ ভাগ পদ সংরক্ষণ করে ডেপুটি জেলারদের পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে ডেপুটি জেলারদের মধ্যে তীব্র হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। জানতে চাইলে অতিরিক্ত আইজি (প্রিজন্স) শেখ সুজাউর রহমান বলেন, কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদমর্যাদা ও বেতন গ্রেড উন্নীতকরণের যৌক্তিকতা তুলে ধরে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। সেই প্রস্তাবটি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবা হচ্ছে। ডিআইজি (প্রিজন্স) জাহাঙ্গীর কবির বলেন, ৫ আগস্টের আগে ও পরে দেশে অনেক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। ওই প্রেক্ষাপটে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের অনেকেই পালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ জেলের কেউ পালাননি। পুলিশের মতো যদি কারাসংশ্লিষ্টরা পালিয়ে যেত, তাহলে দেশের পরিস্থিতি কী হতো? আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজেদের জীবনবাজি রেখে দায়িত্ব পালন করেছেন। এজন্য আমাদের পুরস্কার পাওয়ার কথা। বাস্তবতা হচ্ছে, পুরস্কার তো দূরের কথা, আমরা আমাদের প্রাপ্যটুকু পাচ্ছি না। বিষয়টি নিয়ে একজন এআইজির নেতৃত্বে কারা অধিদপ্তরের একটি টিম কাজ করছে। কারা আধিপ্তরের এআইজি জান্নাতুল ফরহাদ বলেন, কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদমর্যাদা ও বেতন গ্রেড উন্নীতকরণের যৌক্তিকতা তুলে ইতোমধ্যেই আমরা একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি করেছি। আশা করছি প্রস্তাবটি দ্রুতই মন্ত্রণালয়ের বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করা হবে।