বহু অভিযোগ, ডিএমপির একই দপ্তরে তবু ১৭ বছর
মিনিস্টিরিয়াল স্টাফ (নন-পুলিশ সদস্য) নজরুল ইসলাম। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা তিনি। ওয়ারেন্টপ্রাপ্ত আসামির সঙ্গে বিশেষ সখ্য, কর্মকর্তার বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন (এসিআর) পরিবর্তন, সরকারি পিকআপ ভ্যান ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার এবং অবৈধভাবে সরকারি মোবাইল সিম ব্যবহারসহ নানা অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। অভিযোগ, তিনি সহকর্মীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। হাতাহাতি করেন, এমনকি সহকর্মীর ওপর হামলাও চালিয়েছেন। দিয়েছেন প্রাণনাশের হুমকিও। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই কিনেছেন লাখ লাখ টাকার সম্পত্তি। চাঁদাবাজির অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। বিভাগীয় তদন্তে অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে। কিন্তু তার কিছুই হয়নি। পদোন্নতি পাওয়ার পর সাধারণত সরকারি কর্মকর্তাদের দপ্তর পরিবর্তন করা হয়। এছাড়া মিনিস্টারিয়াল স্টাফদের তিন বছর পর পর বদলির নির্দেশনা আছে। কিন্তু নজরুলের ক্ষেত্রে একেবারেই ব্যতিক্রম। গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত ১৫ বছরে তিন দফায় তার পদোন্নতি হয়েছে। অফিস সহকারী থেকে উচ্চমান সহকারী, উচ্চমান সহকারী থেকে প্রধান সহকারী হয়েছেন। এরপর হয়েছেন ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা। কিন্তু একবারের জন্যও তার দপ্তর পরিবর্তন হয়নি। ডিএমপি সদর দপ্তরের প্রশাসন শাখায় কর্মরত আছেন গত ১৭ বছর ধরে। শুধু তাই নয়, তার পদোন্নতির ক্ষেত্রে লঙ্ঘন করা হয়েছে জ্যেষ্ঠতার নীতিমালা। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নজরুল ইসলাম ডিএমপি সদর দপ্তরে অফিস সহকারী পদে যোগদান করেন ১৯৯৩ সালে। তার প্রথম পোস্টিং হয় ডিএমপির গোপনীয় শাখায়। এ শাখায় থাকার সময় মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এক এসআইয়ের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন (এসিআর) পরিবর্তন করে ফেলেন। এসআইএর এসিআরে থাকা বিরূপ মন্তব্য পরিবর্তন করে নতুন এসিআর তৈরি করেন। ওই এসআইয়ের পদোন্নতির সময় বিষয়টি ধরা পড়ে। কারণ, এসিআরে যে কর্মকর্তা (ডিআইজি পদমর্যাদার) বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন তিনি পদোন্নতি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। এসিআর পর্যালোচনার সময় ওই ডিআইজি দেখেন, সংশ্লিষ্ট এসআইয়ের ফাইলে তিনি নেতিবাচক যে মন্তব্য করেছিরেন সেটি ইতিবাচক হয়ে গেছে। পরে ২০০৫ সালের ৭ ডিসেম্বর শাস্তি হিসেবে নজরুলকে পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট (পিওএম) শাখায় বদলি করা হয়। পরবর্তীতে ডিএমপির হিসাব শাখা ও লালবাগ ক্রাইম শাখাসহ একাধিক শাখায় কাজ করেছেন। বিভিন্ন স্থান ঘুরে ২০০৭ সালে তিনি অফিস সহকারী হিসাবে ফের যোগদান করেন ডিএমপি সদর দপ্তরের প্রশাসন শাখায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আসার পর তিনি উচ্চমান সহকারী হন। এরপর হন প্রধান সহকারী। গত ১০ জুন তাকে ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। জ্যেষ্ঠতার তালিকায় তিনি ছিলেন ৩ নম্বরে। এক্ষেত্রে তালিকার এক নম্বরে থাকা মোনায়েম হোসেন ও দুই নম্বরে থাকা অমল চন্দ দাসকে বঞ্চিত করা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, পুলিশে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরা সরকারি মোবাইল সিম ব্যবহারের সুযোগ পান না। কিন্তু তিনি গোপনে পুলিশের সরকারি মোবাইল নম্বর ব্যবহার করেন। তার বিরুদ্ধে সরকারি মেবাইল ফোন ব্যবহারের অভিযোগ বেশ পুরোনো। অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার (প্রশাসন) মীর রেজাউল আলম তার মোবাইল নম্বর থেকে নজরুলের অবৈধভাবে ব্যবহার করা সরকারি নম্বরে (০১৩২০০৩৭৩৩৬) ফোন করেন। ফোন ধরেন নজরুল। অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় ২০২১ সালে তার মোবাইল ফোন থেকে সরকারি নম্বরটি খুলে নেন মীর রেজাউল আলম। অজ্ঞাত কারণে তখন তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সদর দপ্তর শাখার একজন কর্মকর্তা বলেন, নজরুল ইসলাম প্রধান সহকারী থাকা অবস্থায় অবৈধভাবে পুলিশের পিকআপ (পিকআপ নম্বর-১১-২৬২৮) ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করতেন। ওই পিকআপটি বরাদ্দ ছিল উত্তরায় বসবাসকারী ডিএমপি হেডকোয়ার্টার্সের কর্মরতদের জন্য। ডিএমপি সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ সদস্য ও সিভিল স্টাফদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের ৪-৫টি অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলেও কেউ তার কিছু করতে পারেনি। পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) থেকে তদূর্ধ্ব কর্মকর্তা এবং সব মিনিস্টারিয়াল স্টাফদের বদলির ফাইল উপস্থাপন করার দায়িত্ব নজরুলের ওপর। এ কারণে কেউ সাধারণত তার বিরাগভাজন হতে চান না। বদলি বাণিজ্যের মাধ্যমে তিনি বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন উল্লেখ করে ডিএমপির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, রাজধানীর উত্তরখান থানায় যৌথ মালিকানায় ২০১৮ ও ২০১৯ সালে দুটি দাগে (দাগ নম্বর-২৬৭৫ ও ২৬৮২) জমি কিনেছেন নজরুল। একটিতে ভবন নির্মাণের কাজ চলমান। সরকারি বিধি অনুযায়ী, কোনো কর্মচারী তিন লাখের বেশি টাকায় জমি কেনার আগে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। অথচ নজরুল ইসলাম কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই ২৫ লাখ টাকার (দলিলমূল্য, প্রকৃত দাম অনেক বেশি) জমি কিনেছেন। ডিএমপি একজন উচ্চমান সহকারী জানান, ডিএমপির আটটি ক্রাইম ডিভিশন ও আটটি ট্রাফিক ডিভিশনে কর্মরত মিনিস্টারিয়াল স্টাফদের কাছ থেকে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা চাঁদা তোলেন নজরুল। আর চাঁদা তোলার ক্ষেত্রে এ সময় তিনি একটি সরকারি নম্বর ব্যবহার করতেন। এ ধরনের অভিযোগ তদন্তের পর তিনি সরকারি নম্বরটি যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিয়েছেন। নজরুলের ক্ষমতার দাপট এতই যে, কেউ তার অপকর্মের প্রতিবাদ করলে তার গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করেন না। এ ধরনের এক ভুক্তভোগী ডিএমপির মিনিস্টারিয়াল স্টাফ কায়ছার আহমেদ। তিনি ডিএমপি সদর দপ্তরে প্রশাসন শাখায় থাকাকালীন নজরুল তাকে মারধর করার পর স্টিলের স্কেল দিয়ে আঘাত করে। উচ্চমাণ সহকারী মোস্তফার সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের পর পেপার ওয়েট দিয়ে তার মাথা ফাটিয়ে দেন। বিভিন্ন সময়ে নজরুলের দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছেন কম্পিউটার অপারেটর সুলতানা পারভীন এবং বেনজীর আহমেদসহ অনেকেই। ২০২১ সালের কৃপাসিন্দু দাস নামের এক অফিস সহকারীকে প্রাণনাশের হুমকি দেন নজরুল। কৃপাসিন্দু দাস তখন নজরুলের বিরুদ্ধে রমনা থানায় জিডি করার জন্য ২০২১ সালের ২২ আগস্ট তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার (প্রশাসন) মীর রেজাউলের কাছে অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন। কিন্তু তাকে জিডি করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। চাঁদপুরের কচুয়ার দুলাল প্রধান উত্তরখান এলাকার এসএম মোস্তফা কামাল বিটুর বিরুদ্ধে চাঁদপুরের আদালতে একটি মামলা করেছিলেন। ওই মামলায় আসামির ছয় মাসের সাজসহ ১১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। সাজার পরোয়ানাটি ২০২১ সালের মার্চে উত্তরখান থানায় পাঠানো হয়। কিন্তু ওই পরোয়ানা তামিল করা হয়নি। কারণ, বিটুর সঙ্গে রয়েছে নজরুলের বিশেষ সখ্য। এ কারণে বিটুকে যেন গ্রেফতার করা না হয়, সেজন্য তিনি ডিএমপির একজন তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনারকে দিয়ে উত্তরখান থানায় ফোন করান। জানতে চাইলে ডিএমপির ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, আমি ২০০৮ সাল থেকে টানা ডিএমপি সদর দপ্তরে কর্মরত আছি। এর আগে অন্যান্য জায়গায় দায়িত্ব পালন করেছি। তিনি বলেন, আমাকে সুপারিশ করে পদোন্নতি দেওয়ার কারণে অনেকেই আমার বিরাজভাজন হয়েছেন। তাদের সঙ্গে আমার শত্রুতা আছে। যারা প্রশাসনিক কর্মকর্তা হওয়ার জন্য তদবির করেছিলেন, তারা সফল হতে পারেননি। এ কারণে হিংসার বশবর্তী হয়ে তারা আমার বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছেন।