ডিএমপির ৫০ থানা ওসি পদায়নে পুরোনো পথেই হাঁটছে পুলিশ
আওয়ামী লীগের আমলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) বিভিন্ন থানায় ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) হিসাবে পদায়ন পাওয়া কর্মকর্তারা ছিলেন প্রভাবশালী পরিদর্শক। এসব কর্মকর্তাদের বেশিরভাগই বিদায়ি সরকারের বিভিন্ন সময়ে নিয়োগ পাওয়া অথবা আওয়ামী পরিবারের সন্তান। তারাই ঘুরেফিরে ৫ থেকে ১১ বছর ডিএমপিতে থেকেছেন। এসব কর্মকর্তাদের যোগ্যতার মূল মাপকাঠি ছিল আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থক। প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিলেন তারা। প্রভাবশালী অনেক ওসিই তাদের সুপারভিশন অফিসারদের (এসি, এডিসি ও ডিসি) পাত্তা দিতেন না। এসব ওসির বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ থাকলেও ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। সেবাপ্রত্যাশী সাধারণ মানুষও তাদের কাছে জিম্মি ছিলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঢেলে সাজানো হচ্ছে পুলিশ বাহিনীকে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও পুলিশের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, পুরোনো ধারা বদলে নতুন করে ঢেলে সাজানো হবে পুলিশ বাহিনীকে। এরই অংশ হিসাবে ডিএমপির ৫০ থানার সব ওসি বদলি করা হয়েছে। সবকটি থানায় নতুন করে ওসি পদায়ন করা হয়েছে। তবে এবারও অভিযোগ উঠেছে, ডিএমপিতে ওসি পদায়নে রাজনৈতিক মতাদর্শকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নতুন করে পদায়ন পাওয়া বেশিরভাগ ওসিই বিগত বিএনপি সরকারের আমলে চাকরি পান। অবশিষ্টদের অধিকাংশ চাকরিতে নিয়োগের প্রাথমিক প্রক্রিয়া বিএনপি আমলে শুরু হয়, যোগদান করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। তবে নিয়োগ পাওয়া এসব ওসিরা আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বঞ্চিত ছিলেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশ বাহিনীতে মৌলিক পরিবর্তন আনা জরুরি। তারা আগের মতোই দলীয় চিন্তা থেকে না সরলে সাধারণ মানুষের পুলিশি সেবা পাওয়া চ্যালেঞ্জিং হবে। ক্ষোভ প্রকাশ করে পুলিশের এক পরিদর্শক বলেন, ডিএমপিতে ওসি পদায়নে কখনোই কর্মদক্ষতা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। পুলিশের সাবেক কর্মকর্তারাও বলছেন, কে কোন আমলে চাকরি পেয়েছেন তা না দেখে কর্মদক্ষতা, পেশাদারিত্ব, দায়িত্ববোধ, নেতৃত্বের গুণাবলি ও সার্ভিস রেকর্ড দেখে ওসি পদায়ন করা উচিত। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (প্রশাসন) ফারুক আহমেদ বলেন, ‘চাকরি পাওয়া লোকের মধ্য থেকেই তো আমাদের খুঁজতে হবে, আমরা তো এখন চাকরি কাউকে দিচ্ছি না। আমরা একটা ক্রাইটেরিয়া (মানদণ্ড) সেট করেছি যে-পুরাতন লোকজনের মধ্য থেকে যারা ফিট হবে তাদের নিয়োগ দেওয়া হবে। এখানে দলীয় বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা একটা ব্যাচ ধরেছি, যে এই ব্যাচ পর্যন্ত ওসি হিসাবে নিয়োগ পাবে। ওই সিস্টেমের মধ্যে থেকে খোঁজার চেষ্টা করেছি।’ আটটি বিভাগের অধীনে ৫০টি থানা নিয়ে গঠিত ডিএমপি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ১২ আগস্ট ও ১৮ আগস্ট পৃথক দুটি প্রজ্ঞাপনে ডিএমপির সব থানার ওসিকে ডিএমপির বাইরে বদলি করা হয়। পরে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত কয়েক ধাপে সব থানায় নতুন ওসি পদায়ন করা হয়। এর মধ্যে ৩৭ থানার ওসি বিএনপি সরকারের আমলে পুলিশে চাকরি পান। যাদের মধ্যে ১৮ জন ২০০৩ সালে বিএনপি আমলে চাকরি পান, ওই আমলেই ২০০৫ সালে চাকরি পান ১৫ জন। এছাড়া অন্য তিনজন বিএনপির আগের আমলগুলোতে চাকরি পান। বাকি ১১ ওসি চাকরিতে যোগদান করেন গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। অপর দুজনের একজন জাতীয় পার্টি ও আরেক জন আওয়ামী লীগের আমলে চাকরিতে যোগদান করেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত সময়ে পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ সব থানায় ওসি পদায়ন করা হয় আওয়ামীপন্থি পুলিশ সদস্যদের। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার-নির্যাতনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন ওই পুলিশ সদস্যরা। ফলে সাধারণ মানুষও চরম ক্ষুব্ধ হন পুলিশের ওপর। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশকে দিয়ে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে আওয়ামী লীগ সরকার, যার ফলে ভয়ংকর পরিণতির শিকার হয়েছে পুলিশ। ছাত্র-জনতার ক্ষোভের আগুনে লন্ডভন্ড হয়েছে পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনা। ৫ আগস্ট সরকার প্রধানের পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছেড়ে পালানোর পর ডিএমপির বেশিরভাগ থানায় হামলা করা হয়। অন্তত ২২টি থানা পুড়িয়ে দেন বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। এ সময় ডিএমপির ৫০ থানায় ওসি হিসাবে দায়িত্বরত পুলিশ পরিদর্শকরা আওয়ামী লীগের নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এদের বেশিরভাগই ছিলেন আওয়ামী লীগের আমলে চাকরি পাওয়া। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেছে পুলিশ। পরিবর্তন আনা হয়েছে পুলিশের বেশিরভাগ শীর্ষ পদে। সাধারণ মানুষের পুলিশি সেবা দানের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ স্থান থানা। ফলে ঢাকা মহানগর পুলিশের ৫০ থানার নেতৃত্বে বদল আনা হয়েছে। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘পুলিশের এত খারাপ অবস্থা হওয়ার পেছনের কারণ ছিল দলবাজ কর্মকর্তাদের গত সরকার প্রমোট করা। তারা এমনভাবে কাজ করেছেন যে প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কারও ওপর তাদের আস্থা ছিল না। মনে হয়েছে তারা সব কিছু প্রধানমন্ত্রীর একক নির্দেশে করেছেন-এরকম একটা অবস্থার মধ্যে চলে গিয়েছিল। পুলিশ একটা ডিসিপ্লিন সার্ভিস। এখানে একজন অপরকে মেনে চলবেন এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু গত সরকারের আমলে দেখা গেছে, ওসি শোনে না ডিসির কথা, ডিসি শোনে না কমিশনারের কথা, কমিশনার শোনে না আইজিপির কথা-সবাই স্বাধীন। এটা আর হতে দেওয়া যাবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘কোন আমলে কে নিয়োগ পেলেন এটা না দেখে একজন কর্মকর্তা ভালো কিনা, পেশাদারিত্ব আছে কিনা, তার মধ্যে দায়িত্ববোধ আছে কিনা, নেতৃত্বের গুণাবলি আছে কিনা, সার্ভিস রেকর্ড ভালো কিনা এগুলো দেখে পদায়ন করা উচিত। একই সঙ্গে দেখতে হবে, তাদের চালাই যারা অর্থাৎ সুপারভিশনে যারা থাকেন (এসি, এডিসি, ডিসি) তাদের নিবিড় তদারকির ব্যবস্থা থাকতে হবে। তদারকি যদি সঠিক হয় তাহলে ওরা (ওসি) আকাম-কুকাম করতে সাহস পাবে না।’