ডিপ্লোম্যাটের প্রতিবেদন যে স্বার্থে শ্রীলংকার নির্বাচনে প্রভাব ফেলছে ভারত
শ্রীলংকার রাজনীতিতে সবসময়ই স্বার্থ ছিল ভারতের। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কৌশলগত অবস্থানে থাকা দ্বীপরাষ্ট্রটিতে ফের নির্বাচন ২১ সেপ্টেম্বর। আবারও সেখানে তাদের সেই স্বার্থের বিষয়টি প্রামাণ্য হয়ে উঠেছে। সেখানকার নির্বাচনে ভারতের স্বার্থের মূল কারণগুলোর অন্যতম হলো- তারা ভারতের খুব কাছাকাছি দ্বীপ। শ্রীলংকায় যেমন তামিল জনগোষ্ঠী রয়েছে, ঠিক তেমনি ভারতেও রয়েছে বিপুল পরিমাণে। এসব জনগোষ্ঠীর শুধু ভাষাগত বা সাংস্কৃতিক দিক দিয়েই মিল আছে এমন নয়। একই সঙ্গে তাদের আছে আত্মীয়তার বন্ধন। তাই তো পক প্রণালীর যে কোনো এক পাশের রাজনীতি অন্যপাশের উন্নয়নের ওপর প্রভাব ফেলে। উপরন্তু দক্ষিণ ভারতের খুব কাছেই শ্রীলংকার অবস্থান। এ দক্ষিণেই আছে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিরাপত্তা ও বিজ্ঞান গবেষণা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে আছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র এবং নৌঘাঁটি। তাই ভারতের প্রথামিক উদ্বেগের বিষয় হলো- সেখানে যেন কোনো বিদেশি শক্তি শ্রীলংকার ওপর প্রভাব খাটাতে না পারে। আর এ কারণে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সাজিথ প্রেমাদাসাকে ভারত সমর্থন দিচ্ছে বলে বলা হয়েছে। প্রেমাদাসার দল যে শুধু অতিমাত্রায় ভারতপন্থি, এমন নয়। একই সঙ্গে তারা সংবিধানের ১৩তম সংশোধনী বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। মঙ্গলবার অনলাইন গণমাধ্যম দ্য ডিপ্লোম্যাটে এসব কথা জানিয়ে একটি প্রতিবেদন লিখেছেন সাংবাদিক রথিন্দ্র কুরুবিতা। ওই প্রতিবেদনে তিনি আরও লিখেছেন, গত দেড় দশক ধরে চীনকে বহিঃশক্তি হিসেবে দেখে আসছে ভারত। তাদেরকে নিয়ে ভারতের উদ্বেগ সবচেয়ে। এ কারণে শ্রীলংকার রাজনীতিবিদদের সমর্থনে উদ্বুদ্ধ হয়েছে ভারত। যে বা যারা চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তারের সমালোচনা করছেন বা বিরোধিতা করছেন, তাদেরকেই সমর্থন দিচ্ছে ভারত। কলম্বোর রাজনৈতিক বলয়ে এটা সর্বজনবিদিত যে, ২০১০ এবং ২০১৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে শ্রীলংকার সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) শরত ফনসেকা এবং শ্রীলংকা ফ্রিডম পার্টির (এসএলএফপি) মাইথ্রিপালা সিরিসেনাকে সমর্থন দিয়েছিল ভারত। ওই সময় ভারত এই দুজনকে সমর্থন দেওয়ার জন্য বেছে নেয়। কারণ, তারা এক দশক ধরে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা মাহিন্দা রাজাপাকসের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তাই এবারের নির্বাচনে ফ্রন্টরানারদের মধ্যে যেসব প্রার্থী বেশি মাত্রায় চীনবিরোধী, তাদেরকে ভারত সমর্থন দেবে- এটা নিরাপদভাবেই বলা যায়। ২১ সেপ্টেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রধান চারজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তারা হলেন- ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ারের (এনপিপি) অনুরা কুমারা দিশানায়েকে, স্বতন্ত্রপ্রার্থী প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে, সামাগি জন বালেওয়েগ্যা (এসজেবি) পার্টির বিরোধী দলীয় নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা এবং শ্রীলংকা পোদুজানা পেরামুনা (এসএলপিপি) দলের নামাল রাজাপাকসে। তাদের মধ্যে দিশানায়েকে এবং প্রেমাদাসা হলেন ফ্রন্টরানার। ২২ সেপ্টেম্বর যখন নির্বাচনের ফল ঘোষণা হতে পারে, তখন শ্রীলংকার নবম প্রেসিডেন্ট হতে পারেন তাদের একজন। এর মধ্যে দিশানায়েকেকে পছন্দ করে চীন। তার এনপিপি দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মধ্য-বাম রাজনৈতিক ধারায়। তাদের সঙ্গে আছে জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (জেভিপি)। তারাই মূলত এনপিপির মূল চালিকাশক্তি। ১৯৬০-এর দশকের শ্রীলঙ্কা কমিউনিস্ট পার্টির চীনপন্থি একটি অংশ হলো এর ভিত্তি। এ বছর শুরুর দিকে দিশানায়েকে ভারত সফর করেন। তা নিয়ে ব্যাপকভাবে প্রচার পান তনি। তবে ভারত বিরোধী অবস্থান তিনি বা তার দল পরিবর্তন করেনি। যদিও এনপিপি ভারতবিরোধী কোনো দল নয়, তবে জাতীয় সম্পদ বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি করে দেওয়ার কঠোর বিরোধিতা করে তারা। এ জন্য তাদের জনপ্রিয়তা বাড়ছেই। শ্রীলংকার বন্দর, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং বিমানবন্দরগুলোর মতো গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরগুলোতে ভারতের আদানি গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ায় তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে এনপিপি। ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে এই আদানির নিবিড় সম্পর্ক। আদানি গ্রুপের সঙ্গে জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে সরকার চুক্তি করেছে। এমন অভিযোগ তুলে কয়েকদিন আগে আদানির সঙ্গে বিতর্কিত বিদ্যুৎ বা জ্বালানি চুক্তি বাতিল করে দেয়ার হুমকি দেন দিশানায়েকে। এক টিভি টকশোতে উপস্থিত হয়ে তিনি বলেন, মান্নারে অবস্থিত উইন্ডফার্ম থেকে আদানিরা যেটুকু নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন করবে তার প্রতিটি ইউনিট কিনতে রাজি হয়েছে শ্রীলঙ্কা। তবে বাজারদরের চেয়ে দ্বিগুণ দামে তা কেনার চুক্তি হয়েছে। অনুরা দিশানায়েকে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় জ্বালানি সংযুক্তিকে তিনি সমর্থন করেন। কিন্তু তিনি ওইসব চুক্তির বিরোধিতা করেন- যা শ্রীলংকার অর্থনীতি এবং ব্যবসার প্রতিযোগিতাকে দুর্বল করে দেবে। তিনি একই সঙ্গে শ্রীলংকার জলসীমা থেকে ভারতীয় জেলেদের সরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অন্যদিকে প্রেমাদাসা ও তার সহযোগীরা ভারতের প্রতি খুব বেশি অনুগত। তার এসজেবি হলো ডানপন্থি ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি)-এর একটি অংশ। তারা চীনের ব্যাপারে অধিকমাত্রায় সন্দিহান। ১৯৫০-এর দশকের শুরুর দিকে চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে অবস্থান ছিল ইউএনপির। ১৯৬০-এর দশকে চীন-ভারত সীমান্ত যুদ্ধের সময়ে ভারতের বিরুদ্ধে চীনকে আগ্রাসী হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার জন্য শ্রীলংকার প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল তারা। চীনের প্রতি এখনও সন্দিহান এসজেপির বর্তমান প্রজন্মের নেতৃত্ব। চীন যে ঋণফাঁদ কূটনীতি অবলম্বন করছে তার সমালোচনাও করেছে এসজেপি। সংবিধানের ১৩তম সংশোধনী পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়নে একমাত্র প্রার্থী হিসেবে রাজি হয়েছেন প্রেমাদাসা। এ সংশোধনী বাস্তবায়নের জন্য শ্রীলংকার প্রতি অব্যাহতভাবে দাবি জানিয়ে আসছে ভারত। ইলানকাই তামিল আরাসু কাদচি (আইটিএকে) দলেরও সমর্থন আছে প্রেমাদাসার ওপর। আইটিএকে হলো এমন একটি রাজনৈতিক দল, যাদের ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। জল্পনা আছে যে, প্রেমাদাসাকে সমর্থন দিতে তামিল দলগুলোর ওপর প্রভাব আছে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের। তিনি কয়েক সপ্তাহ আগে শ্রীলঙ্কা সফর করেছেন। এ সময় কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভের (সিএসসি) এবং সিএসসি সচিবালয়েল প্রতিষ্ঠার একটি উদ্যোগের জন্য সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছেন সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে। বাংলাদেশে মিত্র হারানোর পর দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বন্ধুর সংখ্যা একেবারে কমে গেছে। এর জবাবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মালদ্বীপ এবং শ্রীলংকার সঙ্গে সম্পর্ককে মেরামত এবং শক্তিশালী করার জন্য কাজ করছে ভারত। শ্রীলংকায় একটি বন্ধুপ্রতীম প্রশাসন ভারতের জন্য নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। শ্রীলংকায় চীনের প্রভাবকে মোকাবিলার মানসিকতা চালিত হয়েছে সেখানে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভারতের জড়িত হওয়ার বিষয়। একদিকে প্রেমাদাসা ভারতপন্থি অবস্থান নিয়েছেন। অন্যদিকে অধিক পরিমাণ চীনপন্থি অবস্থান নিয়েছেন দিশানায়েকে। এই নির্বাচনের ওপর নির্ভর করছে শ্রীলংকার পররাষ্ট্রনীতির গতিবিধি। তাই ভূরাজনৈতিক কারণে প্রেমাদাসাকে সমর্থন করছে ভারত।