ফজলে করিম আটক হলেও কোথায় তাঁর ‘খলিফারা’
রাউজানের স্বঘোষিত রাজা ছিলেন এবিএম ফজলে করিম চোধুরী। টানা পাঁচবার এমপি নির্বাচিত হওয়ায় অসীম ক্ষমতা তৈরি হয়েছিল তাঁর উত্তর চট্টগ্রামে। তাঁর মতের বাইরে কথা বলার সুযোগ ছিল না কারোরই। ৩০ থেকে ৪০ জনের একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে ‘রামরাজত্ব’ কায়েম করেন তিনি রাউজানে। ফজলে করিম আটক হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে তাঁর বলয়ে থাকা ‘খলিফারা’। অথচ এসব খলিফাকে দিয়েই তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন থানা। আদায় করতেন চাঁদা। দখল করতেন অন্যের জমি। শায়েস্তা করতেন বিরুদ্ধ মতের মানুষদেরও। গুম খুন মারধর ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী: ফজলে করিমের মতের বাইরে যাওয়ায় নির্মমভাবে হত্যার শিকার হয়েছিলেন বিএনপি নেতা নুরুল হক ও মোহাম্মদ মুছা। সম্প্রতি দায়ের করা এ-সংক্রান্ত একটি মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ‘২০১৭ সালের ২৯ মার্চ রাত পৌনে ১২টার সময় দুইজন পুলিশের পোশাক পরিহিতসহ অন্য আসামিরা নগরের বাসা থেকে সাদা রঙের মাইক্রোবাসে করে নুরুল আলম নুরুকে তুলে নেয়। ওইদিন রাতেই তাঁকে চোখ-মুখ বেঁধে, শারীরিক নির্যাতন ও মাথায় গুলি করে হত্যা করে বাগোয়ান ইউনিয়নের কর্ণফুলী নদীর তীরে ফেলে যায় সন্ত্রাসীরা। পরদিন ৩০ মার্চ পুলিশ নুরুলের লাশ উদ্ধার করে।’ পুলিশের পোশাক পরা লোকেরা মূলত ফজলে করিমের অনুসারী ছিল বলে মনে করছে বিএনপি। গহিরা ১ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি নেতা শহিদুল ইসলাম শহিদ বলেন, ‘গত ২২ জুন এমপির নির্দেশে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আবছার বাঁশির নেতৃত্বে ১০/১২ জন যুবলীগ ছাত্রলীগ কর্মী আমাকে বোর্ড অফিসে নিয়ে গিয়ে গণপিটুনি দিয়ে গুরুতর আহত করে। আমি এখন প্রায় পঙ্গু হয়ে আছি। ঠিকভাবে হাঁটতে পারি না। এমপির ভয়ে তখন মামলা করতে পারিনি। জড়িতদের বিরুদ্ধে শিগগির মামলা করব আমি।’ ফজলে করিম আটক থাকায় এসব অভিযোগের ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। অন্যের জায়গা দখল করে গড়ে তুলেছেন বাগানবাড়ি : রাউজানের সাবেক এমপি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর রয়েছে ২০ একর ভূমির ওপর বাগানবাড়ি। এই বাগানবাড়ির পাশে ২ একর জায়গায় নতুন করে গড়া পেট্রোল পাম্পের দ্বিতল ভবন দখলে নিয়েছিলেন তিনি। দখল পাকাপোক্ত করতে গড়তে চান মাদ্রাসা। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর স্থানীয় লোকজন এই পেট্রোল পাম্প এলাকায় রাউজান ওলামা কল্যাণ সমিতি নামে একটি সংগঠনের সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিয়েছে। ভুক্তভোগী বখতিয়ার উদ্দিন ফকির বলেন, ‘জায়গা-জমি দখল, অস্ত্রের মুখে জমি রেজিস্টারি, ঘর ভাঙচুর, লুটপাট ও মিথ্যা মামলা দিয়ে হাজতবাস করানোর হোতা ছিলেন সাবেক এই সাংসদ। তিনি আমার প্রায় তিন একর জায়গা জোরপূর্বক দখল করে বাগানবাড়ি সম্প্রসারণ করেছেন। বিনামূল্যে জায়গা রেজিস্টারি না দেওয়ায় আমার ওপর নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন। সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে আমার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করা হয়। আমি পার্শ্ববর্তী উপজেলায় পালিয়ে বাঁচতে পারলেও তার মিথ্যা মামলা থেকে বাঁচতে পারিনি। পরে পুলিশ দিয়ে হাটহাজারী উপজেলার নজুমিয়া হাট থেকে আটক করে আমাকে অস্ত্র দিয়ে আদালতে সোপর্দ করে সে। সরকার পতন হলে দীর্ঘ একযুগ পর বাড়িতে আসি আমি।’ চট্টগ্রাম-রাঙামাটি চার লেন সড়কে শতকোটি টাকার চাঁদাবাজি : সড়ক ও জনপথ বিভাগ ২০১৮ সালে ৬৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে চার লেনবিশিষ্ট এই মহাসড়ক উন্নয়ন কাজের টেন্ডার আহ্বান করে। দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সড়ক উন্নয়নে কাজ পায়। এনডিএ ও স্পেকট্রা ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড নামের দুই প্রতিষ্ঠান ২০১৮ সালে সড়কের উন্নয়নকাজ শুরু করে। এই কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২১ সালে। ২০২৪ সালে স্পেকট্রা ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড তাদের কাজ সম্পন্ন করলেও এনডিএ এখনও শেষ করতে পারেনি। কারণ, এমপিকে চাঁদা দিতে হয়েছে ঠিকাদারদের। সড়ক সম্প্রসারণ করতে গিয়ে জায়গা অধিগ্রহণের বিপুল পরিমাণ অর্থও লুটপাটের অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। হাটহাজারী অংশের সুবেদার পুকুরপাড় এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মরিয়ম বেগম ও মোহাম্মদ সাকিল বলেন, ১২ শতক জায়গা অধিকরণ করলেও এখনও তারা টাকা পাননি। তারা ক্ষতিপূরণ আদায়ে আদালতে মামলা করেছেন বলে জানান। রাউজান অংশের বান্যাপুরপাড় এলাকার অক্কু মল্লিক বলেন, ‘সড়ক সম্প্রসারণ হলে আমাদের বসতবাড়ি পর্যন্ত লাল পতাকা দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। আমি উচ্চ আদালত থেকে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ঘর ভাঙচুর করতে বাধা দিয়ে থাকি। পড়ে আদালত আমাদের ক্ষতিপূরণ দিতে সরকারকে নির্দেশ দেয়। এখনও ক্ষতিপূরণ পাইনি। সড়ক ও জনপথ বিভাগের রাউজান-ফটিকছড়ির দায়িত্বে থাকা উপপ্রকৌশলী শহিদুল আলম বলেন, ‘০.৮৭৫ হেক্টর জায়গা অধীকরণ করা হয় সড়কের জন্য। ক্ষতিপূরণ বাবদ এখন পর্যন্ত ৪৮ কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্তদের দেওয়া হয়েছে।’ এর বাইরে তিনি আর কিছু জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে স্থানীয়রা বলছে সাবেক এমপি সড়ক সম্প্রসারণে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে তাঁর মনোনীত মিজান উদ্দিন মুন্সি নামে এক ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেন। তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের কাছ থেকে দলিলে স্বাক্ষর করে বিশেষ বিশেষ নামে রেজিস্টারি করে নেন। পরে তাদের মালিক দেখিয়ে সমস্ত অধিগ্রহণের টাকা হাতিয়ে নেন। মতের অমিল হলেই ছাড়তে হতো এলাকা : সাবেক এমপি ফজলে করিম চৌধুরীর নির্যাতন নিপীড়নে গত ১৫ বছরে এলাকা ছাড়া হয়েছেন কয়েক হাজার বিএনপি নেতাকর্মী। তরীকতভিত্তিক সংগঠন মুনিরিয়া যুব তবলীগ কমিটিরও শতাধিক কর্মীকে এলাকাছাড়া করেছেন তিনি। বাদ যাননি নিজ দলীয় নেতাকর্মীরা। উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবুল কালাম আজাদ, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক দেবাশীষ পালিত, জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ডা. শেখ শফিউল আজম, নাজিম উদ্দীন তালুকদার, ইয়াছিন মাহমুদ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুসলিম উদ্দিন খান, সাধন মুহুরী, চন্দন দে, শান্তি পদ বৈদ্যসহ অসংখ্য নেতাকর্মী ছিলেন এলাকাছাড়া। এদের মধ্যে দেবাশীষ পালিত নির্বাচিত হওয়ার পরও পাঁচ বছর পৌর মেয়রের চেয়ারে বসতে পারেননি। সাবেক এই এমপির রোষানলের শিকার হয়ে হামলা মামলায় জেল হাজতে যেতে হয়েছে বিএনপির সাবের সুলতান কাজল, রেজাউল রহিম আজম, রাসেল খান, মোহাম্মদ রিপন, জানে আলম, নুরুল ইসলাম মেম্বার সহ অনেক নেতাকর্মীকে। উন্নয়ন কাজে এমপির চাঁদাবাজি : গত ১৫ বছরে রাউজানে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। এসব উন্নয়ন কাজের জন্য ফজলে করিম চৌধুরীকে ২০ শতাংশ হারে কমিশন দিতে হয়েছে ঠিকাদারদের। এসব উন্নয়ন কাজ বন্টন করতেন এমপির মনোনীত উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি সাবেক বিএনপি নেতা শাহাজান ইকবাল। নিয়ম অনুসারে পত্রিকায় উন্নয়ন কাজের দরপত্রের বিজ্ঞপ্তি আহবান করলেও কোন ঠিকাদার উম্মুক্ত টেন্ডারে অংশ নিতে পারতো না। নিজ দলীয় নেতাকর্মীরা ঠিকাদারি ব্যবসা করতে চাইলেও নিদিষ্ট ব্যক্তিকে ছাড়া কাজ করতে দেওয়া হতোনা। সেই কারণে সাধারণ নেতাকর্মীরা সাথে নেতার দুরুত্ব বাড়তে থাকে। সড়ক ও জনপদ বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় সরকার বিভাগ, ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন দপ্তর হতে প্রাপ্ত বরাদ্দ থেকে কমিশন বাণিজ্য হয়ছিল প্রায় ৫ শত কোটি টাকা। কমিশন বাণিজ্য চলা এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে- চট্টগ্রাম- রাঙামাটি সড়কের হাটহাজারী হতে রাবার বাগান পর্যন্ত চার লেন সড়ক, হালদা নদীর বেড়িবাঁধ, হাফেজ বজলুল রহমান সড়ক, শহিদ জাফর সড়ক, অদুদিয়া সড়ক, ইছাপুর সড়ক, হলদিয়া ভিলেজ রোড়, হালদা ব্রিজ, উপজেলা পরিষদ ভবণ, শেখ কামাল কমপ্লেক্সে, ১৪ ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্সে, চারটি চারতলা বিশিষ্ট কলেজ ভবন, শিল্প নগর, ট্রমা সেন্টার, দুইটি পিংক সিটি, ২৬ মেগা ওয়ার্ড বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পলিটেকনিকেল স্কুল, দুইটি থানা ভবণ অন্যতম । ভোট হতো না রাউজানে : নয় বছর ধরে রাউজানে হয়নি উপজেলা, পৌরসভা কিংবা ইউপি নির্বাচনের কোন ভোট। স্থানীয় সরকারের কোন নির্বাচনেই ভোট দিতে পারে না রাউজানের তিন লাখ ভোটার। এমপি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী যাকে পছন্দ করতেন তিনিই নির্বাচিত হতেন বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাউজান থেকে বিনা প্রতিদ্বন্িদ্বতায় এমপি নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী। তখন থেকেই রাউজান উপজেলা হয়ে উঠে বিনা ভোটের ‘দারুণ মডেল’। ২০২১ সালে এই উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে নির্বাচন হয়েছে। এজন্য চেয়ারম্যান পদে ১৪ জন, মেম্বার পদে ১২৬ জন এবং সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ডে ৪২ জন মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছেন। সেবার ১৮২টি পদে নির্বাচন হলেও কোনটিতে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাননি রাউজানের ভোটাররা। ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনেও ১৪ টি ইউনিয়নের মধ্যে ১১ টিতেই ভোট দেয়ার সুযোগ পাননি ভোটাররা। সেবারও বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় নির্বাচিত হন বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধি। ২০২১ সালে এখানে হয়েছে পৌর মেয়র নির্বাচন। সেই নির্বাচনেও বিনা প্রতিদ্বন্িদ্বতায় নির্বাচিত হয়েছেন পৌর মেয়র। ২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও সংরক্ষিত নারী চেয়ারম্যান পদে সবাই বিনা প্রতিদ্বন্িদ্বতায় নির্বাচিত হন। ২০২৩ সারেলও বিনাপ্রতিদ্বন্িদ্বতায় নির্বাচিত হয়েছেন তিনটি পদের তিন জন।