পোশাক কারখানা চালু থাকলে দেশ বাঁচবে
আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে চলমান নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা থেকে পোশাকশিল্পকে রক্ষায় আয়োজিত শ্রমিক-জনতার সমাবেশে বক্তারা বলেছেন, পোশাকশিল্প রক্ষার দায়িত্ব এখন শ্রমিকদের। তারাই সিদ্ধান্ত নেবেন এ শিল্প বাঁচাবেন, না মেরে ফেলবেন। বাঁচাতে চাইলে তারা কাজে ফিরবেন। কারখানা চালু থাকলে আপনি বাঁচবেন, আমরা বাঁচব, দেশ বাঁচবে। শুক্রবার বিকেলে আশুলিয়ার জামগড়া এলাকার ফ্যান্টাসি কিংডম মাঠে সমাবেশে বক্তারা এসব কথা বলেন। সমাবেশে শনিবার সকালে নিজ নিজ কারখানায় কাজে যোগদানের জন্য শ্রমিকদের প্রতি আহ্বান জানান বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম। সাভারের সাবেক সংসদ সদস্য ডা. দেওয়ান মো. সালাউদ্দিন বাবুর সভাপতিত্বে সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, গত এক বছরে নানা সমস্যার কারণে প্রায় ২৭০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এরপরও বাংলাদেশের অর্থনীতি টিকে আছে অন্যান্য কারখানায় উৎপাদন বহাল ছিল বলে। তাই শ্রমিকের কারখানা চালু রাখেন। শ্রমিকদের দায়িত্ব তাদের শিল্প রক্ষা করা। দেশের এই ক্রান্তিকালে আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সময়ে যারা গার্মেন্ট শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করে দেশকে বাধাগ্রস্ত করতে চাচ্ছে, ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। তিনি বলেন, আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে না দাঁড়ালে পোশাকশিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। আমাদের দেশ থেকে ১০-১৫ পার্সেন্ট অর্ডার অন্যান্য দেশে চলে গেছে। ঐক্যবদ্ধভাবে সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে। আমরা অতীতেও অনেক সমস্যা অতিক্রম করে বাংলাদেশকে আজকে এখানে এনেছি। এখন নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর সময়। সমাবেশে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদ বলেন, ইতোমধ্যে আমরা শ্রমিকদের বেশির ভাগ দাবি মেনে নিয়েছি। শ্রমিকদের দাবি অনুযায়ী হাজিরা বোনাস ২২৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে, টিফিন বিল ১০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। কোনো শ্রমিককে যেন ব্লাকলিস্ট করা না হয় এজন্য কালো আইন বাতিল করা হয়েছে। যোগ্যতার ভিত্তিতে নারী ও পুরুষ শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হবে। এ ছাড়া কারখানায় কোনো কর্মকর্তা শ্রমিকদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করলে অভিযোগ তদন্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি আরও বলেন, শ্রমিকরা কখনও কারখানায় ভাঙচুর করে না। কারণ এখান থেকেই তাদের রুটি-রুজির ব্যবস্থা হয়ে থাকে। কিন্তু যারা বাইরে থেকে এসে কারখানায় ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে, র্যা বের গাড়ি ভাঙচুর করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া কোনো উপায় নেই। শনিবার থেকে শিল্পাঞ্চলে ভাঙচুর ও নৈরাজ্য ঠেকাতে এবং দুষ্টের দমন করার জন্য সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। শুক্রবার থেকেই অভিযান শুরু হয়েছে। এদিকে সাভারের আশুলিয়ায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকা কারখানাগুলো শনিবার থেকে খুলতে শুরু করবে। আশুলিয়ায় হা-মীম গ্রুপের কারখানায় শুক্রবার সন্ধ্যায় কারখানার মালিক, বিজিএমইএ ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদ, বিজিএমইএর সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম, বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আবদুল্লাহ হিল রাকিব প্রমুখ। পরে আবদুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, শনিবার থেকে আশুলিয়ার বন্ধ কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গাজীপুরের কারখানাগুলোও খুলবে। যেসব মালিক কারখানা খোলার বিষয়ে ইতিবাচক মনে করবেন, তারা খুলবেন। তিনি জানান, হা-মীম, শারমিনসহ বড় গ্রুপের কারখানা খুলবে। রাকিব বলেন, ‘সেনাবাহিনীর তরফ থেকে আরও নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়ে আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে। তা ছাড়া যৌথ বাহিনীর অভিযানে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকবে। বিশৃঙ্খলাকারীদের তাৎক্ষণিকভাবে শাস্তি দেওয়ার জন্য সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ তিনি জানান, ইতোমধ্যে সরকার একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে ১৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি করে দিয়েছেন। এখানে শ্রমিক নেতা আছেন, ব্যারিস্টার আছেন, মালিকের প্রতিনিধি, বিজিএমইএর প্রতিনিধি আছেন। শনিবার সবাই মিলে শ্রমিক নেতা এবং মালিকদের সঙ্গে বসবেন। সেখানে শ্রমিকদের দাবির বিষয়ে সরকারকে অবহিত করা হবে। সমাবেশে সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির সহপরিবার পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক ডা. দেওয়ান সালাউদ্দিন বাবু বলেন, শেখ হাসিনা দেশ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর তাঁর নেতাকর্মীরা আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপনে থেকে শ্রমিক আন্দোলনের কলকাঠি নাড়ছে। তাই বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীকে বলছি, আপনার এলাকায় কেউ অপরিচিত থাকলে, তাদের তথ্য যাচাইবাছাই করুন। কারণ আপনার এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে। শ্রমিকদের কাজে যোগদানের অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, শ্রমিক আন্দোলনের কারণে মালিকরা শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারায় কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর অর্থ হলো কাজ নাই, বেতন নাই। তাই অন্যের প্ররোচনায় পড়ে নিজেদের সর্বনাশ করবেন না। আপনারা কাজ করেন, প্রয়োজনে আমরা আপনাদের দাবি নিয়ে মালিক পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে তা সমাধানের ব্যবস্থা করব। সাভার উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান দেওয়ান মঈন উদ্দিন বিপ্লব বলেন, শ্রমিক ভাইবোনদের কাছে হাতজোড় করে অনুরোধ করছি আপনারা গার্মেন্টস শিল্পকে বাঁচান। এই শিল্প বাঁচলে আপনারা বাঁচবেন, আমাদের পরিবার বাঁচবে, আমরা বাঁচব। আমাদের এলাকাবাসী বাঁচবে, ভাড়াটিয়া বাঁচবে, দোকানদার বাঁচবে। সমাবেশে আরও উপস্থিত ছিলেন হা-মীম গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক লে. কর্নেল (অব) আক্তার হোসেন, জিএম মাসুদুর রহমান, সাভার পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বদিউজ্জামান প্রমুখ। গাজীপুরে ছুটির দিনেও খোলা ছিল অনেক কারখানা বিভিন্ন দাবিতে দুই সপ্তাহ ধরে শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায় শ্রমিক অসন্তোষ চলছে। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে বৃহস্পতিবার সেখানকার ৮৬ পোশাক কারখানা শ্রম আইন অনুযায়ী অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়া ১৩৩টি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। তবে শ্রমিক অসন্তোষ নেই এমন অনেক কারখানায় উৎপাদন চলমান। কাজের চাপ থাকায় অনেক কারখানা ছুটির দিনেও উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে। শুক্রবার আশুলিয়ায় ১৩০টি কারখানা খোলা ছিল। শ্রমিকরা সেখানে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এদিকে গাজীপুরে বিভিন্ন পোশাক কারখানায় ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শুক্রবার ছুটির দিনেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করেছেন শ্রমিকরা। কয়েক দিনের আন্দোলনের পর তারা নিয়মিত কাজে ফিরলেন। শ্রমিকদের সঙ্গে সমন্বয় করে মালিকরা কারখানা খোলা রাখেন। শিল্প পুলিশ, জেলা পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট সকাল থেকেই কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত রাখার লক্ষ্যে তৎপর ছিল। পোশাকশিল্পে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে বলে জানান গাজীপুর শিল্প পুলিশ ২-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খলিলুর রহমান। তিনি বলেন, শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ২ হাজার ২১৫টি শিল্পকারখানার কোথাও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। আন্দোলন, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও মহাসড়ক অবরোধের কারণে পোশাকশিল্প বড় ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ছুটির দিনে কারখানাগুলো খোলা রাখা হয়। পুলিশ সূত্র জানায়, জেলা ও মহানগরের অন্তত ৩০ ভাগ কারখানা চালু রাখা হয় শুক্রবার। তবে বুধবার অনির্দিষ্টকালের জন্য যে আটটি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়, সেগুলো খোলেনি। বিভিন্ন কারখানার সামনে গিয়ে দেখা যায়, শ্রমিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কারখানায় আসছেন। ছুটির পর তারা সুশৃঙ্খলভাবে বেরিয়ে যান। কোনো কোনো কারখানার সামনে সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা ছিলেন। যেসব কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলনে নামতে পারেন বলে আশঙ্কা ছিল, মূলত সেসব কারখানার সামনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে ছিলেন।