গুলিবর্ষণকারী হাসান মোল্লা গণপূর্তের মাফিয়া ঠিকাদার
ছাত্র-জনতার আন্দোলন তুঙ্গে ছিল গত ১৬ জুলাই। চারদিকে শুধু গুলি-গ্রেনেডের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। সেই বর্বরতা চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হেলমেট পরা অবস্থায় পিস্তল হাতে গুলি চালাতে দেখা যায় এক যুবককে। এমন একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে। অবশেষে পরিচয় মিলেছে তাঁর। তিনি গণপূর্তের ঠিকাদার হাসান মোল্লা। ঢাকা কলেজের সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাউছারের ভাগনে। জানা গেছে, মামা আবু কাউছারের বদান্যতা আর অর্থ পাচার মামলায় কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক যুবলীগ নেতা জি কে শামীমের ছত্রছায়ায় ঠিকাদারি শুরু করেন হাসান। এক পর্যায়ে তিনিই হয়ে ওঠেন গণপূর্তের কর্তা। এ কারবারে তাঁকে সহযোগিতা করেন গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী সাইফুজ্জামান চুন্নু। সাবেক গণপূর্ত ও গৃহায়ন প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ ও প্রধান প্রকৌশলী শামীম আকতারের ঘনিষ্ঠ চুন্নু ছাত্রলীগের হাসানের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে নিয়ন্ত্রণ করতেন টেন্ডার ও ঠিকাদারি। গণপূর্ত অধিদপ্তরের একাধিক প্রকৌশলী জানিয়েছেন, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আবু কাউছার একসময় জি কে শামীমের মাধ্যমে গণপূর্তের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করতেন। বড় অঙ্কের কাজ করত জি কে বিল্ডার্স লিমিটেড ও দ্য বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার্স। আর ১০ কোটি টাকার নিচের কাজগুলো নিয়ন্ত্রণ করত হাসানের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মা-বাবার দোয়া কনস্ট্রাকশন। মামা ও বড় ভাইদের সহায়তায় গণপূর্ত ঢাকা বিভাগ-৪-এর ঠিকাদার সমিতির সাধারণ সম্পাদকের পদও বাগিয়েছেন হাসান। ২০১৯ সালে রাজধানীতে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে জি কে শামীম আটক হলে তাঁর সাম্রাজ্যের পতন হয়। তবে গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ ও অসাধু প্রকৌশলীদের সিন্ডিকেটে ভর করে টিকে যান হাসান। জানা যায়, সাবেক প্রতিমন্ত্রী শরীফ ও প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতারের কাছের লোক হিসেবে পরিচিত নির্বাহী প্রকৌশলী চুন্নুর সঙ্গে হাসানের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে গণপূর্তের ঢাকা বিভাগ-৪-এ কর্মরত থাকা অবস্থায়। হাসানকে গণপূর্তের ঢাকা বিভাগ-৪ ছাড়াও বিভিন্ন কাজ দিতেন চুন্নু। তাঁর প্রতিষ্ঠান ঠিকমতো কাজ না করলেও বিল তোলার ব্যবস্থাও করে দিতেন তিনি। সেই টাকা দু’জন ভাগ করে নিতেন। আর এ কাজ বাস্তবায়নে গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলীর প্রজ্ঞাপন ও এপিপির নির্দেশনা অমান্য করে এলটিএমের পরিবর্তে ওটিএম পদ্ধতিতে ৯৫ শতাংশ দরপত্র করেছেন চুন্নু। হাসানের সিন্ডিকেটের ঠিকাদারকে কাজ দিয়ে নিয়েছেন মোটা কমিশন। এই ছাত্রলীগ নেতার মাধ্যমে জোন ও বিভাগের প্রকৌশলীর বদলির দেন-দরবার ও তদবিরও করতেন। গত ১৪ জুলাই গণপূর্ত বিভাগ-৪ থেকে ১-এ চুন্নুর বদলির পরও সিন্ডিকেট চলমান। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে মিরপুরের পাইকপাড়ার পিডব্লিউডি ট্রেনিং সেন্টারের (পুরোনো) দ্বিতীয় তলার সিঁড়ির পূর্বপাশের ৭ ও ৮ নম্বরের দুটি কক্ষকে আইবি বাংলোতে রূপান্তরের লক্ষ্যে সংস্কার ও আধুনিকায়নের কাজ না করে ঠিকাদারকে বিল দেওয়ার একটি অভিযোগ মন্ত্রণালয়ে জমা পড়ে। তখন তড়িঘড়ি করে রাতের আঁধারে সংস্কারকাজ করার সময় তদন্ত কমিটি সেটি হাতেনাতে ধরে। পরে প্রতিমন্ত্রী শরীফের দাপটে সেটি আলোর মুখ দেখেনি। প্রকৌশলীদের সূত্রে জানা যায়, চুন্নু ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-৪-এ থাকাকালে মুগদা হাসপাতালের নতুন ভবন নির্মাণের কাজ দেন হাসানকে। এ কাজের এখনও পাইলিং চললেও তাঁর প্রতিষ্ঠানকে বিল পরিশোধ করা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন ভবনের সংস্কারের কাজও দেওয়া হয় হাসানকে। কিন্তু সেই কাজও যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। তবে বিল তোলা নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি তাঁর। হাইকোর্ট ডিভিশনের নতুন ভবন নির্মাণের কাজেও একই অভিযোগ তাঁর মা-বাবার দোয়া এন্টারপ্রাইজের বিরুদ্ধে। জানা গেছে, বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে স্বল্প সময়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তুলেছেন প্রকৌশলী চুন্নু। কর্মকর্তাদের অভিযোগ, গণপূর্ত অধিদপ্তরে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন তিনি। এ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে গণপূর্ত অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রণ করেন চুন্নু। দুর্নীতি-অনিয়মের টাকায় গড়ে তুলেছেন একাধিক বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চুন্নুর নিজ এলাকা পটুয়াখালীতে গড়ে তুলেছেন নাহিয়ান ব্রিকস ফিল্ড, পটুয়াখালী কলেজ রোডে দোতলা বাড়ি, পটুয়াখালী সদর উপজেলার কমলাপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ ধারান্দি গ্রামে পাঁচ একর জমি, পটুয়াখালীতে নেক্সাস নামে একটি গার্মেন্ট শোরুম, সাভারে ১০ কাঠার একটি প্লট, ঢাকার ধানমন্ডির সেন্ট্রাল রোড ও বেইলি রোডে দুটি ফ্ল্যাট। এ ছাড়া রয়েছে নামে-বেনামে বহু সম্পদ। এ বিষয়ে ঠিকাদার হাসান মোল্লার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। আর নির্বাহী প্রকৌশলী সাইফুজ্জামান চুন্নুকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো জবাব দেননি।