প্লট ফ্ল্যাট গাড়ি ঘের খামার– কী নেই ওসি অপূর্বর

১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ | ৯:৪৩ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

‘মাইরা তো আমরা ফেলছি, এখন কী করবা?’– এক পুলিশ কর্মকর্তার এমন দম্ভভরা কথার ভিডিও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ছড়িয়ে পড়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। রাজধানীর মিরপুর এলাকায় ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণে হতাহতের বিষয়ে এ কথা বলেছিলেন পল্লবী থানার সাবেক ওসি অপূর্ব হাসান। গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের প্রশ্রয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বেপরোয়া। নানা অপকর্মের মধ্য দিয়ে তিনি হয়েছেন বিপুল সম্পদের মালিক। অনুসন্ধানে রাজধানী ঢাকায় অপূর্ব হাসানের অন্তত চারটি ফ্ল্যাট, প্রাইভেট গাড়ি ও প্লট, গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলায় আট একর জমি, গরুর খামার ও মাছের ঘেরের তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ভাটারায় যে ফ্ল্যাটে অপূর্ব পরিবার নিয়ে থাকেন, সেই ভবনে বেনামে তাঁর আরও ৯টি ফ্ল্যাট রয়েছে বলে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য মিলেছে। পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ ও নামে-বেনামে আরও সম্পদ রয়েছে বলে তাঁর ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন। অপূর্ব হাসানের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে। সেই সুবাদে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক প্রভাবশালী দুই মন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ কারণেই এক সময় তিনি ‘ক্ষমতাবান ওসি’ হয়ে ওঠেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্রতিহত করতে পল্লবী এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর অতি বলপ্রয়োগ করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। এরই মধ্যে এ ঘটনায় পল্লবী থানায় একটি মামলার আসামি হয়েছেন। এ ছাড়া যশোরে তাঁর বিরুদ্ধে অপহরণ ও গুমের মামলা হয়েছে। অপূর্ব হাসানের একাধিক ব্যাচমেট, অধীন পুলিশ সদস্য ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় অপূর্ব এতটায় প্রভাবশালী ছিলেন যে, বদলি পেতেন পছন্দমতো। যশোরের বেনাপোল পোর্ট থানা, যশোরের কোতোয়ালি, রাজধানীর তেজগাঁও এবং সর্বশেষ পল্লবী থানায় ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ১২ আগস্ট অপূর্বকে ঠাকুরগাঁও ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে বদলি করা হয়। কাশিয়ানী উপজেলার রামদিয়ার সাধুহাটি গ্রামে অপূর্বর পৈতৃক বাড়ি। তাঁর বাবা প্রয়াত হাসেম আলী মিয়া পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) ছিলেন। গ্রামে হাসেম দারোগা নামে পরিচিত ছিলেন। ভিটে ছাড়া ৫-৬ বিঘা কৃষিজমি রেখে গেছেন তিনি। অপূর্বরা ছয় ভাইবোন। এক ভাই মুফতি মাওলানা আহসান হাবিব এনজেল গ্রামে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেটি নিজেই পরিচালনা করেন। আরেক ভাই খাজা নেওয়াজ আওয়ামী লীগের টিকিটে কাশিয়ানী উপজেলা পরিষদের পর পর দু’বার ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। প্রকাশ্যে তাঁর কোনো পেশা নেই। রাজনীতিকেই তিনি পেশা হিসেবে নিয়েছেন। অপূর্ব হাসান ২০০২ সালে উপপরিদর্শক (এসআই) হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করেন। শুরুতে মূল বেতন ছিল ২ হাজার ৩৭৫ টাকা। সর্বসাকল্যে বেতন ছিল সাড়ে ৪ হাজার টাকার মতো। ২০১২ সালে পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পান তিনি। বর্তমান তাঁর বেতন সাকল্যে ৬৫ হাজার টাকা। সেই হিসাবে ২২ বছরের চাকরি জীবনে সর্বোচ্চ বেতন ধরলেও ১ কোটি টাকার বেশি নয়। তাহলে সরকারি এই কর্মকর্তা কীভাবে কোটি কোটি টাকার সম্পদ বানালেন– সেই প্রশ্ন উঠেছে। ঢাকায় আলিশান ফ্ল্যাট রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় একটি প্লট রয়েছে অপূর্ব হাসানের। বনশ্রীর ‌‘সি’ ব্লকের আলিশান পুলিশ পার্ক ভবনে অপূর্বর চারটি ফ্ল্যাট ছিল। এর মধ্যে একটি বিক্রি করে দিয়েছেন বলে জানা গেছে। বর্তমানে আছে তিনটি। প্রতিটি ফ্ল্যাটের আয়তন ২ হাজার ৪০০ বর্গফুট। দুটি ফ্ল্যাটের নম্বর পাওয়া গেছে, এ-২ এবং ই-৪। তৃতীয় ফ্ল্যাটটি কয়েক মাস আগে ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা দিয়ে ক্রয় করেছেন বলে সূত্র জানিয়েছে। সেটির কাগজপত্র এখনও নিজের নামে করেননি। সম্প্রতি ওই ভবনে গিয়ে কথা হয় ফ্ল্যাট মালিক ও ভবন নির্মাণের দায়িত্বে থাকা কয়েকজনের সঙ্গে। তারা জানান, ভবনের ভেতরের অংশে কিছু কাজ বাকি আছে। সেগুলো চলমান। অপূর্ব হাসান মাঝেমধ্যে ফ্ল্যাট দেখতে আসেন। তবে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর মাত্র এক দিন এসেছেন। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, ভাটারার নয়ানগরের ২ নম্বর রোডের (মিষ্টি গলি) ১৭ নম্বর ভবনের ৬ তলায় নিজের কেনা ফ্ল্যাটে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করেন অপূর্ব হাসান। ‌আট তলা ভবনটির প্রতি তলায় দুটি করে ইউনিট। একেকটির আয়তন ১ হাজার ৪০০ বর্গফুট। অপূর্ব হাসান ছয় তলার দুটি ইউনিট একটিতে (২৮০০ বর্গফুট) রূপান্তরিত করে বসবাস করতেন। তবে ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর দুটি ইউনিটের মাঝখানে দেয়াল তুলে আলাদা করা হয়েছে। এখন ১ হাজার ৪০০ বর্গফুটের একটিতে বাস করেন। দুটি ইউনিট আলাদা করে ফেলার কারণ হিসেবে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল, অপূর্ব বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্রতিহত করতে পল্লবী থানার সে সময়ের ওসি হিসেবে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেছেন। তাঁর মানুষ মারার বক্তব্য ভাইরাল হয়েছে। তাই বিভিন্ন সংস্থার লোকজন তদন্তের প্রয়োজনে বাসা পর্যন্ত পৌঁছলে তাঁর ২ হাজার ৮০০ বর্গফুটের বড় ফ্ল্যাটে বসবাসের বিষয়টি নেতিবাচক হতে পারে। এ কারণেই তিনি এমন করেছেন। অপূর্বর ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন, ওই ভবনে অপূর্ব হাসানের আরও ৯টি ফ্ল্যাট রয়েছে। আইনি জটিলতায় পড়ার আশঙ্কায় সেগুলো মালিক পক্ষের কাছ থেকে রেজিস্ট্রি করে নেননি। এ ব্যাপারে ভবনের মালিক হাফিজ কামালের সঙ্গে কথা হয়। তিনি দাবি করেন, ৯টি ফ্ল্যাট তিনি এখনও বিক্রি করেননি। তবে ওই ভবনে অপূর্ব হাসানের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। ঘের, খামারসহ বিপুল সম্পদ গ্রামে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর রাতইল ইউনিয়নে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পাশে ২ একর জমিতে মাছের ঘের করেছেন অপূর্ব হাসান। তাঁর মামাতো ভাই রুহুল আমিন সেটি দেখাশোনা করেন। সাধুহাটি এলাকায় ফয়সাল এগ্রো নামে একটি গরুর খামার গড়ে তুলেছেন অপূর্ব। এটি দেখভাল করেন তাঁর আত্মীয় সাবেক ইউপি সদস্য আরোজ আলী। এলাকাবাসী জানায়, আরোজ আলীর এত বড় গরুর খামার করার আর্থিক সামর্থ্য নেই। খামারটির মালিক অপূর্ব। খামারে গরু মোটাতাজা করে বিক্রি করা হয়। কয়েক মাস আগে ৫০টি বিক্রি করা হয়। সর্বশেষ ১৪টি ছিল। সম্প্রতি সেগুলোও বিক্রি শুরু করে। আরোজ আলীর মন্তব্য নেওয়ার জন্য তাঁর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। কাশিয়ানীর রামদিয়ায় আরও সম্পদ রয়েছে অপূর্ব ও তাঁর পরিবারের। এর মধ্যে আট একর জমির তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। ১৫০ নম্বর বহালবাড়িয়া, ১০৬ নম্বর রামদিয়া ও ১৪৯ নম্বর বড়নড়াইল মৌজার ১২টি স্থানে অপূর্ব ও তাঁর স্ত্রী ফাতিমা রহমানের নামে জমি রয়েছে। বহালবাড়িয়া মৌজায় ৭৮২ নম্বর খতিয়ানে অপূর্ব হাসানের নামে এক একর ৫১ শতক, ৭৮৫ খতিয়ানে ৩০ শতক ৩২ অযুতাংশ, একই মৌজার ৭৮৩ খতিয়ানে ফাতিমা রহমানের নামে ৮০.৪ শতক, ৭৮৭ খতিয়ানে দুই একর ১০ শতক, ৭৮৮ খতিয়ানে ৩৩ শতক, রামদিয়া মৌজায় ৯২০ খতিয়ানে অপূর্ব হাসানের নামে ১৯.২৫ শতক জমি রয়েছে। এ ছাড়া অপূর্ব হাসান, তাঁর দুই ভাই আহসান হাবিব ও খাজা নেওয়াজের নামে ৯২১ খতিয়ানে ১৫ শতক, ১৪৯ নম্বর বড়নড়াইল মৌজায় ১০২৩ খতিয়ানে ফাতিমা রহমানের ৯৫ শতক, ৮২৫ খতিয়ানে অপূর্ব হাসানের নামে ৪১ শতক জমির তথ্য পাওয়া গেছে। অপূর্বর ভাই আহসান হাবিবের নামে বড়নড়াইল মৌজায় ৮২৬ খতিয়ানে ৫৭ শতক এবং ৮২৮ খতিয়ানে ২৪.৭৫ শতক জমির খোঁজ পাওয়া গেছে। এলাকাবাসী জানিয়েছেন, আহসান হাবিবের নামে এই জমি কেনা হয়েছে অপূর্বর টাকায়। এসব জমি ২০২০ ও ২০২১ সালে তাদের নামে নামজারি করা হয়েছে। এ ছাড়া রামদিয়া বাজারের পাশে বছরখানেক আগে তিন কোটি টাকা দিয়ে আড়াই বিঘা জমি কিনেছেন। বেনাপোলে স্বর্ণ চোরাকারবারির সঙ্গে সখ্য অপূর্ব হাসান ২০১৪ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৮ সালের জুলাই পর্যন্ত যশোর বেনাপোল পোর্ট থানার ওসি ছিলেন। এ সময় কুটখালী চোরাচালানি ঘাটের সিন্ডিকেট প্রধান নাসির উদ্দিনের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় তাঁর। নাসির ভারত থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে অস্ত্র, ফেনসিডিল ও গরু আনতেন আর বাংলাদেশ থেকে স্বর্ণ ও বিভিন্ন বিরল প্রজাতির পাখি পাচার করতেন। এসব কাজে নাসিরকে ওসি অপূর্ব সহায়তা করতেন বলে বেনাপোলের একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন। দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বেনাপোল পোর্ট থানায় ওসির দায়িত্বে থাকাকালীন অপূর্ব স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এসব ঘটনাসহ তাঁর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও দুর্নীতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান শুরু করেছিল। কিন্তু রহস্যজনকভাবে অপূর্ব সব অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়ে যান। ৮ বছর পর মামলা ২০১৬ সালের আগস্টে বেনাপোলে কলেজছাত্র রেজোয়ান অপহরণ ও গুমের শিকার হন। আজও তাঁর সন্ধান মেলেনি। রেজোয়ানের পরিবারের অভিযোগ, অপহরণ ও গুমের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বেনাপোল পোর্ট থানার তৎকালীন ওসি অপূর্ব হাসান। আট বছর পর গত ২৯ আগস্ট রেজোয়ানের ভাই রিপন হোসেন তাঁর ভাইকে গুম করার অভিযোগে যশোর আদালতে মামলা করেন। এতে অপূর্ব হাসান, থানাটির তৎকালীন পরিদর্শক (তদন্ত) খন্দকার শামীম আহমেদ ও এসআই নূর আলমকে আসামি করা হয়। রিপন হোসেন বলেন, আমার ভাইকে বেনাপোল ভূমি কার্যালয়ের পাশ থেকে এসআই নূর আলম ও অপর একজন মোটরসাইকেলে করে তুলে নিয়ে যান। আমরা থানায় গেলে ওসি অপূর্ব হাসান বাড়াবাড়ি না করার জন্য বলেন। ওসিসহ আসামিরাই আমার ভাইকে গুম করেছেন। মিরপুরে মামলা গত ১৮ জুলাই মিরপুর ডিওএইচএস এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার অভিযোগে পল্লবী থানার সাবেক ওসি অপূর্ব হাসানের নামে মামলা হয়েছে। গত ২২ আগস্ট পল্লবী থানায় মামলাটি করেন ডিওএইচএসের সিকিউরিটি ইনচার্জ সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার (অব.) দিলীপ চন্দ্র দেবনাথ। মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা পল্লবী থানার এসআই নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, মামলার তদন্ত শুরু হয়েছে। এসব বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে অপূর্ব হাসান দাবি করেন, ‘আমার চাকরির টাকা, বাবার সম্পদ, এসব দিয়ে ফ্ল্যাট করেছি। আমার গরুর খামার নেই। সেটা আরোজ আলীদের।’