পেশাগত হতাশা থেকে বাড়ছে আত্মহত্যা

১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ | ৯:৩৯ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

‘কাজের জন্য গুলশান, বনানী, এখানে-সেখানে কত ঘুরেছি। কিন্তু কাজ পাইনি। অনেক সময় কাজের জন্য রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্তও বসে থেকেছি, কিন্তু অকাজের কথা বেশি হয়েছে। খুশি করতে হবে, এই-সেই এমন অনেক কথা শুনতে হয়েছে।’ এক সাক্ষাৎকারে এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছিলেন মডেল ও অভিনেত্রী তাসনিয়া রহমান। গত ৫ জানুয়ারি রাজধানীর ধানমন্ডির ফ্ল্যাটে তাঁকে গলায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় পাওয়া যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পর মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, হতাশা থেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন এই অভিনেত্রী। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তাসনিয়া ছাড়াও একাধিক অভিনয়শিল্পী, প্রযোজক, সংগীতশিল্পী, গীতিকারের আত্মহত্যার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। জানা গেছে, আলো ঝলমলে রুপালি জগতের ভেতরে রয়েছে অনিশ্চয়তা, হতাশা, অর্থকষ্টের অন্ধকার এক অধ্যায়। শেষ পর্যন্ত যা স্বেচ্ছামৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অবশ্য শুধু শোবিজেই নয়, সাংবাদিকতার মতো চ্যালেঞ্জিং ক্ষেত্রসহ অন্যান্য পেশাজীবীর মধ্যেও হতাশা থেকে আত্মহত্যার ঘটনা বাড়ছে। সর্বশেষ গত ২৭ আগস্ট রাজধানীর হাতিরঝিলে পাওয়া যায় গাজী টিভির নিউজরুম এডিটর রাহনুমা সারাহর লাশ। মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত না হলেও সংশ্লিষ্টদের ধারণা, পেশা ও ব্যক্তিজীবনের হতাশা থেকেই এই অকালমৃত্যু। তাঁর শেষ ফেসবুক পোস্ট থেকে তেমন আভাসই পাওয়া যায়। এ রকম পরিস্থিতিতেই আজ মঙ্গলবার পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। দিবসটি উপলক্ষে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে রয়েছে নানা আয়োজন। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, পেশাগত জীবনে সবারই কমবেশি চাপ থাকে। প্রতিনিয়ত নিজেকে অতিক্রম করার স্পৃহা থাকে। বিশেষত ‘পারফর্মিং আর্ট’-এর ক্ষেত্রে এটা অনেক বেশি সত্য। এই চাপ, এই প্রতিযোগিতা থেকে কখনও কখনও হতাশা আসতে পারে। আর হতাশা থেকে দেখা দিতে পারে বিষণ্নতা। সময়মতো এই বিষণ্নতার চিকিৎসা না হলে তা মানুষকে আত্মহত্যার দিকে নিয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, কারও মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। যথাযথ চিকিৎসাসেবার মাধ্যমে আত্মহত্যার ঘটনার বড় অংশই প্রতিরোধ করা সম্ভব। রুপালি জগতের হতাশা সিনেমা, নাটক, বিজ্ঞাপনচিত্রের রুপালি জগৎ অনেককেই আকৃষ্ট করে। অভিনয়-মডেলিং করে নিজের প্রতিভার ঝলক দেখাতে অনেকেই মরিয়া। তবে আলোর দুনিয়ার চোরাগলিতে ঢুকে পথ হারানোর সংখ্যাও কম নয়। নানা জটিলতায় নিজের জায়গা করে নিতে না পারাদের দুঃখগাথা তো থাকেই। এমনকি সাফল্যের মুখ দেখা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের টিকে থাকার লড়াইও খুব কঠিন। অনিয়মিত-অপর্যাপ্ত আয়ের বিপরীতে নিজের সুখী প্রতিবিম্ব ধরে রাখতে গিয়ে হিমশিম হয়ে তারাও অন্ধকারে খেই হারিয়ে ফেলেন। গত বছরের ২ নভেম্বর রাজধানীর উত্তরায় নিজ ফ্ল্যাটে গলায় ফাঁস দেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী হোমায়রা হিমু। র‍্যাব জানায়, তাঁর আত্মহত্যার পেছনে খালাতো বোনের সাবেক স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানো থেকে অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হওয়ার বিষয় উঠে এসেছে। সেই সঙ্গে পেশাজীবনে কাজের সুযোগ কমে আসায় আয় সংকীর্ণ হওয়ার বিষয়টিও প্রকাশ পায় তদন্তে। অভিনেত্রী হিমুর মৃত্যুর পর গত বছরের ৭ নভেম্বর রাজধানীর শেখেরটেকের ২ নম্বর সড়কের একটি ফ্ল্যাট থেকে মডেল সুমাইয়া আমরিনের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশের ধারণা, দু-তিন দিন আগে তাঁর মৃত্যু হয়। হতাশা ও পারিবারিক কলহের জের ধরে তিনি আত্মহত্যা করেন বলেও জানায় পুলিশ। ওই মাসেই টিভি পর্দার এক জনপ্রিয় অভিনেত্রীকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসায় তিনি সেরে ওঠেন। তিনিও হতাশা থেকে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান বলে শোনা গিয়েছিল। এর আগে অভিনেত্রী মিতা নূর, নায়ার সুলতানা লোপা, সুমাইয়া আজগার রাহার মতো আরও অনেকে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। গত ১৩ মার্চ মোহাম্মদপুরের বাসায় জনপ্রিয় রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সাদি মহম্মদের ঝুলন্ত মৃতদেহ পাওয়া যায়। শিল্পীজীবনের অপ্রাপ্তি-অভিমান থেকে তিনি আত্মহত্যা করেন বলে ধারণা ঘনিষ্ঠজনদের। সাংবাদিক, পুলিশ, চিকিৎসকের আত্মহত্যা পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাও অনেকের পছন্দের। যদিও বিগত বছরগুলোয় গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। সেই সঙ্গে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় ও আর্থিক সক্ষমতার ক্ষেত্রটিও আগের মতো নেই। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ ও ধরাবাঁধা কর্মঘণ্টার বাইরে ছুটে চলা এই পেশাজীবীর বড় অংশই আয়-ব্যয়ের সমন্বয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগে। হাতেগোনা কিছু প্রতিষ্ঠান ঠিকঠাক বেতন দিলেও বহু প্রতিষ্ঠানের চিত্র হতাশাব্যঞ্জক। পেশাগত চাপের পাশাপাশি আর্থিক সংকট অনেক সময় বিষণ্নতার জন্ম দেয়। গাজী টিভির নিউজরুম এডিটর রাহনুমা সারাহর মৃত্যুর ক্ষেত্রেও এমন বিষয় ছিল বলে সহকর্মীরা জানিয়েছেন। এর আগে ২০২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর রাতে মগবাজারের বাসায় সাংবাদিক শবনম শারমিনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে জানায় পুলিশ। গত বছরের জানুয়ারিতে রাজধানীর পল্লবীর বাসায় সাংবাদিক বিপ্লব জামানের মৃতদেহ পাওয়া যায়। একই বছরের অক্টোবরে মগবাজারের একটি হোটেল থেকে সাংবাদিক জাকির হোসেন আজাদীর মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সাংবাদিক ও গীতিকার রাসেল ও’নীল গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের লিচুবাগান এলাকার বাসায় এ ঘটনা ঘটে। নেত্রকোনা মডেল থানায় কর্মরত পুলিশ কনস্টেবল রুবেল মিয়া বিপুল পরিমাণ ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে আত্মহত্যা করেন গত ৯ জুন। ময়মনসিংহে একটি বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক অর্পণা বসাক গত ২৫ জুন নিজের শরীরে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি ফেসবুকে লেখেন, ‘ভালো থাকো। আমি আর পারছি না। হয়তো সবার মতে হেরে গেলাম। মুক্তি দিয়ে গেলাম।‌’ ২০ জুন মারা যান বগুড়ার সরকারি মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. রোমানা শারমিন রুমা। তিনি ১৯ জুন রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তাঁর। চলতি বছরে ৩১২ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের সভাপতি তানসেন রোজ জানান, এ পর্যন্ত ৩১২ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তবে বেশির ভাগ ঘটনাই অভিমান বা আবেগজনিত। সংস্থাটির ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ওই বছর ৫১৩ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।