প্রশিক্ষণের নামে বেপরোয়া লুটপাট শেয়ারবাজারে
দুর্নীতি ও লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হয়েছে শেয়ারবাজারের প্রশিক্ষণ সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেট (বিআইসিএম)। জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ, প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত শিক্ষক বাদ দিয়ে নিজের লোককে ভাড়া করে ক্লাস নেওয়া, নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কেনাকাটা এবং অন্যান্য ব্যয়ে ভাগবাঁটোয়ারা করে লুটপাট হচ্ছে। এর সুবিধাভোগী বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সদ্য বিদায়ি চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম, কমিশনার ড. শেখ শামসুদ্দীন আহমেদ, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ও শেয়ারবাজার বিভাগের প্রধান ড. নাহিদ হোসেন, বিআইসিএমের বর্তমান নির্বাহী প্রেসিডেন্ট ড. মুহাম্মদ তারেক ও সাবেক নির্বাহী প্রেসিডেন্ট ড. মাহমুদা আক্তার। এছাড়াও এই প্রকল্পের মাধ্যমে সুবিধা দিয়ে এখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন শিবলী রুবাইয়াত। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের আওতায় সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত একটি শিক্ষা ও গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান বিআইসিএম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এ প্রতিষ্ঠানের তদারকির দায়িত্বে বিএসইসি। এখানে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মাস্টার্স কোর্স রয়েছে। কেউ এখান থেকে পাশ করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। পদাধিকার বলে বিএসইসির চেয়ারম্যান এই প্রতিষ্ঠানের পর্ষদের চেয়ারম্যান থাকেন। এ হিসাবে গত ৪ বছর এ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ছিলেন বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত। তবে নির্বাহী প্রধানের পদবি হলো ‘নির্বাহী প্রেসিডেন্ট’। আর এই নির্বাহী প্রেসিডেন্ট নিয়োগের মাধ্যমে অনিয়ম জালিয়াতি শুরু হয়। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী প্রেসিডেন্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ তারেক। এর আগে ছিল একই বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহমুদা আক্তার। আর বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস ফ্যাকাল্টির ডিন ছিলেন। ফলে এই দুজনই অধ্যাপক শিবলীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও সহযোগী। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ড. তারেকের ১১টি প্রকাশনা ও গবেষণার মধ্যে ৭টিই অধ্যাপক শিবলীর সঙ্গে যৌথভাবে। এদিকে বিএসইসিতে ২০২১ সালে জালিয়াতির মাধ্যমে ১২৭ জনের একটি নিয়োগ পরীক্ষা হয়। এই পরীক্ষার তদারকির দায়িত্বে ছিলেন ড. তারেক। আবার তারেক ও মাহমুদা দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী লীগ সমর্থিত শিক্ষকদের নীল দলের সদস্য। এ কারণে শর্তপূরণ না করলেও জালিয়াতির মাধ্যমে এদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব বিষয় কথা বলতে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি। জানুয়ারিতে বিআইসিএমের নির্বাহী প্রেসিডেন্ট হিসাবে তাড়াহুড়া করে অবৈধভাবে ড. তারেককে নিয়োগ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে পদাধিকার বলে নিয়োগ কমিটির সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক শিবলী। আবেদনপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ছিল ২০২৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর। মন্ত্রণালয়ের শর্ত ছিল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দুটি বহুল প্রচারিত বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকায় প্রকাশ করতে হবে। কিন্তু প্রকাশ করা হয় অখ্যাত পত্রিকায়। বিজ্ঞপ্তিতে অন্যতম শর্ত ছিল প্রার্থীর কমপক্ষে ২০ বছরের পেশাগত অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। জন্মসনদ অনুসারে ওই সময়ে ড. তারেকের বয়স ছিল ৪৪ বছর। এর ফলে ২০ বছরের পেশাগত অভিজ্ঞতার জন্য জালিয়াতির আশ্রয় নেন তিনি। ২০০০ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে ২০০২ সালের ৯ অক্টোবর পর্যন্ত সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে ফেলো হিসাবে কাজ করেছেন বলে অভিজ্ঞতা সনদ দেখানো হয়। কিন্তু অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই ব্যাংকে ফেলো কোনো পদ নেই। আর যে সনদ দেখানো হয়েছে, তা ব্যাংকের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি। বাস্তবে ওই সময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং বিভাগ থেকে বিবিএ এবং ২০০১ সালে এমবিএ সমাপ্ত করেন। এছাড়াও ২০০৪ সালের ২৫ জানুয়ারি থেকে ২০০৫ সালের ১০ এপ্রিল পর্যন্ত ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ’ ‘লেকচারার’ ছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এটি সত্য নয়। ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি সূত্র জানায়, ২০০৪ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ২০০৫ সালের ১০ এপ্রিল পর্যন্ত জুনিয়র লেকচারার ছিলেন। আর ২০০৪ সালের ২৫ জানুয়ারি থেকে ২০ মে এবং ওই বছরের ১৩ জুন ২৯ জুলাই পর্যন্ত খণ্ডকালীন ক্লাস নিতেন। এক্ষেত্রে জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে ২০ বছরের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছেন। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, বিআইসিএম কোনো কারণ দর্শানো ছাড়া এ নিয়োগ কিংবা কোনো আবেদন বাতিল করতে পারবে। বিষয়টি সংবিধান পরিপন্থি উল্লেখ করে চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি লিগ্যাল নোটিশ পাঠান সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী রফিকুল ইসলাম সোহেল। এছাড়াও শিবলী রুবাইয়াত বিএসইসির পাশাপাশি বিআইসিএম থেকেও একটি গাড়ি ব্যবহার করতেন। বেশিরভাগ সময়ই এই গাড়িটি তার বাসার বাজার করার জন্য ব্যবহার হয়েছে। ওই গাড়িতে কিছুটা সমস্যা হওয়ায় চলতি বছরের জুনে তার জন্য ৪৫ লাখ টাকায় আরেকটি গাড়ি কেনার জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়। তবে সেটি কেনার আগেই তাকে বিদায় নিতে হয়। এছাড়াও বেপরোয়া দুর্নীতি করেছেন সাবেক নির্বাহী প্রেসিডেন্ট ড. মাহমুদা আক্তার। প্রশাসনিক কাজে অদক্ষ হলেও শিবলী রুবাইয়াতের ঘনিষ্ঠতায় তিনি নিয়োগ পান। শুরুতেই নিয়মনীতি উপেক্ষা করে তার অনুসারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সুবর্ণ বড়ুয়াকে ৩ বছরের জন্য রিসার্চ কনসালট্যান্ট নিয়োগ দেন মাহমুদা আক্তার। এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নেওয়া হয়নি। বাস্তবে ড. বড়ুয়া কোনো গবেষণার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। কিন্তু বিআইসিএম থেকে সম্মানিসহ অন্যান্য ভাতা বাবদ প্রায় অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এছাড়াও তাকে ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন কমিটির সদস্য ও খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েও আর্থিক সুবিধা দেওয়া হয়েছে। সরকারি বাণিজ্যিক নিরীক্ষা অধিদপ্তর এই নিয়োগকে গুরুতর অনিয়ম হিসাবে চিহ্নিত করেছে। তবে এই নিয়োগ নিয়ে আপত্তি তোলায় তৎকালীন পরিচালককে (স্টাডিজ) ইস্তফা দিতে হয়। ইনস্টিটিউটের খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগেও ব্যাপক স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বজনপ্রীতি করেছেন ড. মাহমুদা। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যোগ্য শিক্ষক রয়েছে। কিন্তু এরপরও অযোগ্য ও নিজের কাছের লোককে খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে আর্থিক সুবিধা দিয়েছেন। সরকারি বাণিজ্যিক নিরীক্ষা অধিদপ্তর এ ব্যাপারে আর্থিক অনিয়ম চিহ্নিত করেছে। নিয়মানুসারে কোনো কোর্সে ২০ শতাংশ পর্যন্ত খণ্ডকালীন শিক্ষক নিতে পারেন। কিন্তু ২০২২ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর সেমিস্টারে ১২ জনের মধ্যে ৮ জন ছিলেন খণ্ডকালীন শিক্ষক। শতকরা হিসাবে যা ৬৭ শতাংশ। এছাড়াও ২০২১ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বরে ৪৩ শতাংশ, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে জুনে ৪৫ শতাংশ খণ্ডকালীন শিক্ষক নেওয়া হয়। খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে ক্লাস নিয়েছেন-শিবলী রুবাইয়াতের স্ত্রী শেনিন জিয়াউদ্দিন, কমিশনার ড. শামসুদ্দীনের স্ত্রী ড. ফেরদৌসি নাহার, শামসুদ্দীনের শ্যালিকা মেহজাবীন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. নাহিদ হোসেন। প্রতিটি ক্লাসে তারা ৯ হাজার টাকা করে সম্মানি নিয়েছেন। এছাড়াও ড. নাহিদ শিবলী রুবাইয়াতের সরাসরি ছাত্র। সম্প্রতি তাকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে বিএসইসির উদ্যোগে জার্নাল প্রকাশের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মাহমুদা আক্তারের স্বামী ড. মাহফুজুল হককে। প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী নিয়োগেও কোনো আইন মানেননি ড. মাহমুদা। পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র দিয়ে নিজ বাসার কাজের মেয়ে নুরি সুলতানাকে অফিস সহকারী পদে নিয়োগ দিয়েছেন। কিন্তু নুরি সুলতানাকে অফিসের পরিবর্তে মাহমুদা তার বাসার কাজ করাতেন। নির্বাহী প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ উদয় শুভ রহমানকে ডেপুটি হার্ডওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার পদে নিয়োগ দিয়েছেন। নিয়মানুসারে চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী কোনো আনুতোষিক পান না। কিন্তু তা পরিশোধে প্রশাসনকে চাপ দেন। এক্ষেত্রে রাজি না হওয়ায় পরিচালককে হেনস্তা করা হয়। প্রতিষ্ঠানের যানবাহন ব্যবহারেও দুর্নীতি করেছেন মাহমুদা। তার জন্য একটি গাড়ি বরাদ্দ। কিন্তু অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠানের একাধিক গাড়ি স্বামী ও আত্মীয়-স্বজনের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতেন। নিয়মানুসারে প্রতি মাসে ১৮০ লিটার জ্বালানি তেল বরাদ্দ। কিন্তু লক্ষাধিক টাকার জ্বালানি ব্যবহার করেছেন। ইনস্টিটিউটের ড্রাইভার বাদ দিয়ে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া বাসার ড্রাইভার দিয়ে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে গাড়ি চালাতেন। আপ্যায়নে প্রতি মাসে বরাদ্দ ছিল ৭ হাজার টাকা। কিন্তু অবৈধভাবে আরও ১০ হাজার টাকা বাড়িয়ে নিতেন। প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ক্রয়ে দুর্নীতি করেছেন। অফিসের অধিকাংশ কেনাকাটা করেছেন বোনের ছেলের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক দর অনুসরণ না করে বাজারের চেয়ে উচ্চমূল্যে বিল পরিশোধ করেছেন। এসব আচরণে ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের অন্তত দশজন কর্মকর্তা চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। দ্বিতীয় দফায়ও তাকে নিয়োগের জন্য চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি মেলেনি। তবে বিদায়ের আগেই নিজেকে ইনস্টিটিউটের খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেন। নিজের নামে গবেষণা অনুদান ও দুটি বই প্রকাশনার অনুমোদন করে গেছেন। জানতে চাইলে ড. মাহমুদা আক্তার সোমবার বলেন, নুরি সুলতানা আমার বাসার কাজের মেয়ে ছিল না। বাসা পালটানোর সময় একটু সহযোগিতা করেছে। তিনি বলেন, খণ্ডকালীন শিক্ষক যেভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাতে কোনো অনিয়ম হয়নি। যখন আমরা নতুন মাস্টার্স কোর্স চালু করি, তখন শিক্ষক স্বল্পতা ছিল। ওই সময়ে একাডেমিক কমিটির অনুমতি নিয়েই এটা করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন চাকরিকালীন সময়ে আমি সততার সঙ্গে কাজ করেছি। অন্যদিকে ড. শিবলী রুবাইয়াত এবং ড. মোহাম্মদ তারেকের মোবাইল বন্ধ থাকায় তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।