ভোল পালটে মোশারফ সাভারে চাঁদাবাজির ‘ডন’

১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ | ৬:৩৪ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

আওয়ামী লীগ সমর্থিত আন্তঃজেলা ট্রাকচালক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন। গত ১০ বছর আওয়ামী লীগের তকমা লাগিয়ে চাঁদাবাজিতে লিপ্ত ছিলেন। সরকার পতনের পর এই মোশারফ ভোল পালটে এখনও সাভারে চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রক। চাঁদা দিতে না চাওয়ায় ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজনকে গুরুতর আহত করে তিনি ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন সাভারে। ইউনিয়ন বিএনপি নেতা এক ভাইয়ের ছত্রছায়ায় তিনি নিজেকে ‘ডন’ ভাবতে শুরু করেছেন। পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পরও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফুটপাতের ফল বিক্রেতা জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায়, তখন স্থানীয় নেতাদের নামে চাঁদা তুলতেন মোশারফ। সেই সরকার পতনের পর ভাবছিলাম এখন থেকে আর চাঁদা দিতে হবে না। কিন্তু শেখ হাসিনা ৫ তারিখ দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ৭ তারিখই বিএনপি পরিচয়ে মোশারফ এসে আমাদের কাছে চাঁদার কথা বলে যান। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, আমাদের আর ভাগ্যের উন্নয়ন হলো না। নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ডিশ ব্যবসায়ী বলেন, আমার কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা নিয়েছেন মোশারফ। এমনকি ডিশ ব্যবসা দখলে নেওয়ার তৎপরতাও চালাচ্ছেন এখন। আরেক ব্যবসায়ী বলেন, প্রতিদিন ফুটপাত থেকে তার বাহিনী চাঁদা তুলছে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা। পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি একেএম আওলাদ হোসেন রোববার বলেন, চাঁদাবাজরা আসলে কোনো দলের হয় না। এরা ব্যক্তিস্বার্থে দলকে ব্যবহার করে। কে এই মোশারফ খোঁজ নিয়ে দেখছি। তার বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পরিষ্কার মেসেজ-কোনো ধরনের চাঁদাবাজি বরদাশত করা হবে না। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, সাভারের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নের হেমায়েতপুর এলাকাটি শিল্পঅধ্যুষিত হওয়ায় এখানে চাঁদাবাজির মাত্রাটা বেশি। এ সবের নেতৃত্বে রয়েছেন মোশারফ হোসেন। তার ভাই তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নের বিএনপির সহসভাপতি মেহেদী হাসান। কোথাও নিজেরা সশরীরে, কোথাও আবার তাদের অন্য তিন ভাই শরিফ, রাকিব ও রাসেলকে পাঠিয়ে চালানো হচ্ছে এসব কর্মকাণ্ড। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি ও লুটতরাজে বাধা দেওয়ায় গত এক মাসে বেশ কয়েকজনকে গুরুতর আহত করা হয়েছে। এসব চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণে আছে তাদের নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। এরা দখল ও চাঁদাবাজির ক্ষেত্র বাড়াতে মহড়া দেয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই বিভিন্ন স্থানে বিএনপির নেতাকর্মীদের নামে দখলের প্রতিযোগিতা চলছে। এতদিন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা যেসব জায়গায় চাঁদাবাজি করে আসছিল, সরকার পতনের পর ভোল পালটে এরাই আবার বিএনপি সেজে সেসব জায়গায় চাঁদাবাজি করছে। এ সবের মধ্যে রয়েছে গার্মেন্টসের ঝুট ব্যবসা দখল, ডিশলাইন-ইন্টারনেট ব্যবসা দখল, ফুটপাতে চাঁদাবাজি, স্কুল, মার্কেটের দখল নেওয়া থেকে শুরু করে বাদ যায়নি বাসাবাড়ির ময়লা ফেলার নিয়ন্ত্রণও। সরেজমিন হেমায়েতপুরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে চাঁদাবাজি সম্পর্কে ভয়াবহ তথ্য পাওয়া যায়। গাবতলী থেকে সাভার অভিমুখে হেমায়েতপুর এলাকায় এক্সিম ব্যাংক থেকে এনআরবি ব্যাংক পর্যন্ত সিংগাইর সড়কে রয়েছে কয়েকশ ভ্রাম্যমাণ দোকান। এসব দোকান থেকে প্রতিদিন ৩শ থেকে ৫শ টাকা করে চাঁদা তোলা হচ্ছে। হেমায়েতপুর বাসস্ট্যান্ডের উত্তর পাশে জয়নাবাড়ি সড়কে ও হেমায়েতপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের জমিতে নির্মিত মার্কেটে শতাধিক দোকান রয়েছে। এসব দোকান থেকে প্রতিদিন ২শ থেকে ১ হাজার টাকা তোলা হতো। স্কুলের নাম করে এসব চাঁদা তোলা হলেও পুরোটাই যেত আওয়ামী লীগ নেতাদের পকেটে। এতদিন এসব টাকা তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফখরুল আলম সমর এবং সাভার উপজেলা চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাজীব বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। বিগত দিনে একই ব্যক্তি টাকা উত্তোলন করলেও এখন যাচ্ছে ভিন্ন ব্যক্তির পকেটে। এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সব স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণার পর নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে হেমায়েতপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি গঠন করে সভাপতি বনে গেছেন মোশারফের ভাই শরিফ ইসলাম। জানতে চাইলে সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবু বকর সরকার বলেন, নতুন পরিপত্র অনুযায়ী পদাধিকার বলে ইউএনও পরিচালনা কমিটির সভাপতি। কোনো রাজনৈতিক পরিচয়ে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি হওয়ার সুযোগ নেই। এদিকে হেমায়েতপুর এলাকার ইন্টারনেট ও ডিশলাইনের বেশিরভাগ সংযোগ এখন মোশারফ ও মেহেদীসহ তার ভাইদের দখলে। শুধু ডিশ-ইন্টারনেটই নয়, পোশাক শিল্পের অস্থিরতার মধ্যেই সম্প্রতি মোশারফের ভাই শরিফের নেতৃত্বে দলবল নিয়ে আমিনবাজার এলাকার টিমটেক্স গার্মেন্টসের ঝুট দখল করে। এছাড়াও তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নের এজেআই গ্রুপ, ডেকো গ্রুপসহ আরও বেশকিছু কারখানার ঝুট দখলের পাঁয়তারা শুরু করেছে মোশারফ বাহিনীর লোকজন। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় বন্ধ থাকা হলমার্ক গ্রুপের দায়িত্বরত লোকজনকে হলমার্ক ছাড়তে নানাভাবে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে মোশারফ-মেহেদীর বিরুদ্ধে। এখানে শ্রমিক দলের একজন নেতার নাম ভাঙিয়ে চলেন মোশারফ আর তার ভাই মেহেদী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হলমার্কের এক কর্মকর্তা বলেন, দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় বন্ধ থাকা প্রতিষ্ঠানটির লোকজনকে এলাকা ছাড়তে নানাভাবে হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও তাদের অত্যাচারে এখানে থাকাই মুশকিল হয়ে পড়েছে। ভুক্তভোগীরা জানান, মোশারফ ও মেহেদীর লোকজনের চাঁদাবাজিতে বাধা দেওয়ায় বেধড়ক মারধরের শিকার হয়েছেন আরিফ, মেহেদী, আশরাফুল ইসলামসহ আরও কয়েকজন। মোশারফ বাহিনীর মারধরের শিকার সেন্টমার্টিন পরিবহণের কাউন্টার মাস্টার আরিফ বলেন, ৫ তারিখ দুপুরে আওয়ামী লীগের পতনের পর থেকেই রাতারাতি বেপরোয়া হয়ে উঠে মোশারফ বাহিনী। তিনি বলেন, মোশারফ বাহিনীর লোকজন এক অসহায় পরিবারের মালপত্র লুট করার সময় আমি বাধা দিলে হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে আমার বাঁ-হাতের তিন জায়গায় ভেঙে দিয়েছে। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই। স্থানীয় হেমায়েতপুরের ব্যবসায়ী ও বাসিন্দা মামলত হোসেন বলেন, প্রতিদিন ৩শ টাকা করে চাঁদা তোলা হচ্ছে কাঁচাবাজার থেকে। এলাকার ব্যবসায়ী তমিজ উদ্দিন বলেন, ভাবছিলাম সাধারণ মানুষ ভালো থাকবে। কিন্তু সেটা আর হলো না। বিএনপি এখনো ক্ষমতায় আসেনি, কিন্তু তাদের দলের লোকজন এরই মধ্যে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু করেছে। বিএনপি যদি তাদের বিরুদ্ধে এখনই কোনো কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে বিএনপিরও আওয়ামী লীগের মতো একই দশা হবে। অভিযোগের বিষয়ে আন্তঃজেলা ট্রাকচালক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন ভুক্তভোগীদের বিরুদ্ধেই উলটো অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, চাঁদা দাবির অভিযোগ মিথ্যা। মারধর করে হাত ভেঙে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, মোট সাতজনকে মারা হয়েছে। তারা মানুষের বাড়িতে লুটপাট করছিল। তাই আমার নির্দেশেই তাদের মারা হয়েছে। আমার এলাকায় কেউ চাঁদাবাজি করলে সব সময়ই তাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছি এবং ভবিষ্যতেও নেব। গার্মেন্টসে গিয়ে চাঁদা দাবির বিষয়ে বলেন, ‘গার্মেন্টসে কোনো চাঁদা দাবি করা হয়নি। একটা ফ্যাক্টরিতে আমার পরিচিত লোক ছিল, সেখানে গিয়ে চা খেয়ে এসেছি।’ জানা যায়, এই মোশারফ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাভার উপজেলা চেয়ারম্যান মনজুরুল আলম রাজীব ও তার ভাই উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফখর আলম সমরের ঘনিষ্ঠ ছিলেন।