উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে
দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বহু আগে থেকে। সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনে ও জাতির বিবেকের প্রশ্নে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নৈতিক ভিত্তি নিয়ে দাঁড়ানোর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল আওয়ামী সরকারের আমলেও। প্রায় সব সরকারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসনের ওপর আঘাত আনা হয়েছে বারবার। তবে এর মাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে। দেশের মহাসংকটে, ভোট ডাকাতি ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না। গণতন্ত্র রক্ষা, মানবাধিকার, ছাত্র নির্যাতন, ছাত্রদের যৌক্তিক আন্দোলন ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নির্যাতনসহ নানা ইস্যুতেও তারা মোটা দাগে চুপ ছিলেন। তবে তারা ২০১৫ সালের পে-স্কেলে গ্রেড-১ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্র, ২০২৪ সালে প্রত্যয় স্কিম, সুপার গ্রেডে অন্তর্ভুক্তকরণ ও তাদের জন্য আলাদা স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে ছিলেন। ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে শিক্ষকদের ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে অনেক মিশ্র প্রতিক্রিয়াও রয়েছে। অনেক দলীয় শিক্ষক ফ্যাসিবাদীদের অকুণ্ঠ সমর্থকের পরিচয় দিয়েছিলেন। যাই হোক, ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানে শিক্ষক ও সিভিল সোসাইটির ভূমিকাকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাকে কম গুরুত্বপূর্ণ চাকরি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার একটি গভীর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়। শিক্ষার মান নষ্ট করা, শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা নষ্ট করা এবং তাদের তৃতীয় শ্রেণির নাগরিকে রূপান্তর করার মহাকৌশলও নিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। শুধু তাই নয়, এ দেশের প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত মান কমাতে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে গত কয়েক বছরে। একটি দেশের সরকার যদি সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বিপরীতে দাঁড়ায়, সে ক্ষেত্রে আর তো কিছু বলার থাকে না। তবে, শিক্ষকদের মর্যাদা কমানোর জন্য দলীয় শিক্ষক নেতারা বিগত আওয়ামী লীগ সরকারকে সরাসরি দোষারোপ না করে একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীকে দায়ী করেছেন। ধরে নিলাম কোনো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী স্বার্থ আদায়ের জন্য বা তাদের সামাজিক মর্যাদাকে শক্তিশালী করার জন্য তারা বিগত আওয়ামী লীগ সরকারকে মদদ দিয়েছিলেন। তবে শিক্ষক নেতাদের অভিযোগের তীর কাদের দিকে ছিল সেটি তারা স্পষ্ট না করলেও আমাদের বুঝতে বাকি ছিল না। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারকে দোষারোপ না করে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার জন্য তারা এ কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকার শিক্ষকদের কম গুরুত্বপূর্ণ বানানোর জন্য ও মেধাবীরা যেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতায় না আসেন, তা বাস্তবায়ন করার জন্য এ কৌশল নিয়েছিল তা এখন স্পষ্ট। সত্যিকার অর্থে তারা রাষ্ট্রকে পুনর্গঠন করতে চায়নি, দেশকে উন্নত করতে চায়নি, স্মার্ট বাংলাদেশের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চায়নি। যদি মন থেকে তারা এগুলো চাইত, তাহলে শিক্ষার মান উন্নত করা ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে তা করা সম্ভব কিনা, সেই মডেল আমাদের জানা নেই। পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ পাওয়া যাবে না, যেখানে শিক্ষার মান কমিয়ে উন্নতি লাভ করা সম্ভব হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ে একটি নতুন পরিকল্পনা তৈরি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান কীভাবে বৃদ্ধি করা যায়, সে বিষয়ে অতীতের কোনো সরকার সঠিক ভূমিকা পালন করেনি। তাই, গত কয়েক দশক ধরে আমরা কী দেখলাম? বিশ্ববিদ্যালয় তার স্বকীয়তা হারিয়েছে এবং সেখানে রাজনৈতিক দলের প্রভাব বেড়েছে। তবে আমার একটু ভিন্ন বক্তব্যও আছে। শুধু সরকারকে দোষারোপ না করে আমাদের নিজেদের আত্মপর্যালোচনাই-বা কেন করি না। এক্ষেত্রে দুটি আঙুল যদি অন্যের দিকে যায়, বাকি তিনটি আঙুল শিক্ষকদের দিকে আসবে নিঃসন্দেহে! বিশ্ববিদ্যালয়ের দলীয় শিক্ষক নেতারা শুধু বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই নয়, অন্য সরকারগুলোর আমলেও ছিলেন একই রকম। শিক্ষার মানোন্নয়নে সরকারের সঙ্গে দরকষাকষি না করে নিজেদের সুযোগ-সুবিধার কথা চিন্তা করেছেন তারা। সাধারণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের দাবি-দাওয়ার প্রশ্নে তারা করতেন গোপন আঁতাত। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা এক সময়ে যেরকম সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের নৈতিক সমর্থন পেতেন, সেরকম কোনো নৈতিক সমর্থন পাননি দলীয় শিক্ষক নেতারা তাদের কোনো আন্দোলনে। এর পেছনে মূল কারণ কী তা অনুসন্ধান করার প্রয়োজন রয়েছে। সমাজের মানুষকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, তারা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সম্মান করতে চান, এখনো সম্মান করেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা যদি তাদের মূল দায়িত্ব পালন না করেন, তাহলে সম্মানের আশা করেন কীভাবে। মানুষ এখন অনেক সচেতন, কোনটি সঠিক তাদের বোঝার বোধশক্তি আছে। গত আওয়ামী লীগ সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় প্রভাব বিস্তারের যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল, সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দলীয় উপাচার্যরা এবং তাদের অনুসারী শিক্ষকরা। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ভালো করেই জানত, বিশ্ববিদ্যালয়কে যদি নিয়ন্ত্রণ করা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, শিক্ষার্থীদের যদি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করা যায়, তাহলে তাদের ক্ষমতা শক্তিশালীকরণ সহজতর হবে; তাদের তেমন কোনো সমালোচনা হবে না, আন্দোলন হবে না; সর্বোপরি ফ্যাসিবাদীরা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবে। বিগত আওয়ামী সরকারের সবচেয়ে বড় ভয়ের জায়গা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। আওয়ামী লীগ সরকারের ফ্যাসিবাদী আচরণ দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন কীভাবে দমন করা হয়েছিল তা আমরা দেখেছি। ওই সময় গুম, নির্যাতন, জেলে আটকে রাখা, গায়েবি মামলা দায়ের এবং পুলিশকে ন্যক্কারজনকভাবে ব্যবহার করেছিল রাজনৈতিক আন্দোলন ও কর্মসূচি দমন করতে। ঠিক একই কৌশল তারা ব্যবহার করেছিল ছাত্র-জনতার বিপ্লব ঠেকাতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর সম্ভব হয়নি। শেষ রক্ষা হয়নি সেই সরকারের। অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গত কয়েক দশক ধরে তাদের নৈতিক অবস্থান প্রায় দুর্বল করে ফেলেছেন নিজেরাই। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অধিকারের পরিবর্তে তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য বেশি ব্যস্ত ছিলেন। দেশ, জাতি ও গণতন্ত্র নিয়ে ভাবার সময় তাদের ছিল না। সেজন্য তারা যে জাতির বিবেক, সেই বিষয়টি দৃঢ়ভাবে বলার মুখও ছিল না। তাই বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্টের জন্য রাজনৈতিক দলের অনুগত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষদের দায়ও কম নয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রভাবিত করা যায় খুব সহজে। একটি পদের লোভ দেখালে তাদের অনেকে চুপ হয়ে যান। তাদের কাছে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অধিকারের চেয়ে পদের গুরুত্ব অনেক বেশি। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা যতদিন তাদের সঠিক দায়িত্ব পালন না করবেন, দলীয় চিন্তা করবেন, সত্য বলতে পিছপা হবেন, ততদিন তাদের মেরুদণ্ড শক্ত হবে না এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনামও নষ্ট হবে। তবে আমি বিশ্বাস করি, এখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। এটাই সুযোগ তাদের কালিমা দূর করার। আমি এটিও মনে করি, শুধু তারা নিজেরা তাদের কালিমা দূর করার জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসবেন না। সেজন্য বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ও ছাত্রদের ভূমিকা পালন করতে হবে। আর এজন্য কী করতে হবে, তা অন্তর্বর্তী সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ও শিক্ষা উপদেষ্টাকে মনে করিয়ে দিতে হবে না। তারা দুজনই ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান শিক্ষক ও গবেষক। শিক্ষাব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করা ও রাষ্ট্র সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়কে সংস্কার করার কৌশল অবশ্যই তাদের জানা আছে। এজন্য দরকার আন্তরিকতার ও কর্মপরিকল্পনার। বিশ্ববিদ্যালয়ের মান ফেরানোর জন্য তারা হয়তো তাদের পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন। তবে এ ক্ষেত্রে আমাদেরও সামান্য চাওয়া রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় আমার মনে হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় পচন ধরেছে মাথায়। কম যোগ্যতাসম্পন্ন, দুর্নীতিপরায়ণ ও পরিপূর্ণ দলীয় বিবেচনায় উপাচার্যসহ সব প্রশাসনিক পদে নিয়োগ বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম নষ্ট হওয়ার অন্যতম কারণ। উপাচার্য নিয়োগে কোটি টাকা ঘুস প্রদান এবং মাসিক মাসোহারা প্রদানের খবর ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। এরকম প্রশাসক আর চায় না শিক্ষার্থীরা। এ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ এখনই। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশা, বিশ্ববিদ্যালয়ে সুশাসন, পঠন-পাঠন, গবেষণা ও জ্ঞান সৃজনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে ঢেলে-সাজানোর উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। তবে এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের দলীয় লেজুড়বৃত্তি একেবারেই বন্ধ করতে হবে। মেধা ও গবেষণার ওপর ভিত্তি করে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাহলেই মেধাবীরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতাকে বেছ নেবেন। সর্বোপরি, একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠনের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা পরিচালনা করতে হবে। প্রাথমিকভাবে এ কাজগুলোর মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা সংস্কার শুরু হতে পারে। ড. মো. কামাল উদ্দিন : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়