শিক্ষকদের আলোকিত ভুবনে ফেরার এখনই সময়

৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ | ৪:৪৬ অপরাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতিতে রঙের অনুপ্রবেশ কবে শুরু হয়েছে, মনে করতে পারছি না। তবে সম্ভবত ১৯৯০-এর আগে এতটা দলীয় বলয়ে বন্দি হননি রাজনীতি করা শিক্ষকরা। কিশোর বয়স থেকে জেনে আসছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের যশস্বী শিক্ষকরা ছিলেন রাজনীতিকদের গাইড ও ফিলোসফার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের রাজনৈতিক মতাদর্শ তো থাকবেই। বিভিন্ন আদর্শের প্রতি শিক্ষকদের আকর্ষণ থাকতেই পারে। পাকিস্তান আমলের কথা জানি, কোনো কোনো শিক্ষক সরকারি দল মুসলিম লীগের অনুসারী ছিলেন। কেউ জামায়াতে ইসলামীর আদর্শ ধারণ করতেন। অওয়ামী লীগকে পছন্দ করতেন কোনো পক্ষ। আবার কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের শিক্ষকও ছিলেন। কিন্তু আদর্শ যাই থাকুক, শিক্ষকরা রাজনৈতিক দলের সিলমোহর গায়ে লাগিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের আজ্ঞাবহ হতেন না। বরং রাজনৈতিক নেতারা পরামর্শের প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটে যেতেন নিজ আদর্শের শিক্ষকদের কাছে। শিক্ষকদের কাছে শিক্ষার্থীর কোনো দল-পরিচয় ছিল না। শিক্ষক নিয়োগে সাধারণত দলমতের বাইরে থেকে মেধাবীদেরই অন্বেষণ করা হতো। এমন বাস্তবতায় ক্যাম্পাস কলুষিত হওয়ার সুযোগ তেমন ছিল না। কিন্তু এখন ধীরে ধীরে কঠোর দলীয়করণে আটকে গেছে শিক্ষক রাজনীতি। এ ধারার রাজনীতি এতটা তীব্র আকার ধারণ করেছে যে, দলীয় শিক্ষকরা নিজেদের চিহ্নিত করতে ‘ইউনিফরম’ পরে ফেলেছেন। কারও রং নীল, কেউ সাদা, কেউ হলুদ এমন! ১৯৭৩-এ চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ’ চালু হয়। এতে এক ধরনের গণতন্ত্রচর্চার সুযোগ তৈরি হয়েছিল। ক্রমে রাজনীতি করা শিক্ষকরা ক্যাম্পাসে ক্ষমতাচর্চার দিকে মনোযোগী হতে থাকেন। ক্ষমতাচর্চার শীর্ষ জায়গা হচ্ছে উপাচার্য পদ। যে রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করে তারাই জরুরি মনে করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণ করা। তাই দলীয় শিক্ষকদের মধ্য থেকে উপাচার্য নিয়োগ করা হয়। নির্বাহী আদেশে উপাচার্য নিয়োগ করা হলেও বিধি অনুযায়ী দ্রুত গণতান্ত্রিকভাবে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এক্ষেত্রে ভোটার হন সিনেট সদস্যরা। সিনেট সদস্য নির্বাচনটি এক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। দলীয় শিক্ষকদের দিয়ে যার যার মতো করে তিনজনের প্যানেল নির্বাচনের মনোনয়ন দেওয়া হয়। নির্বাচিত হয় সিনেটরদের ভোটে প্যানেল। সিনেট সদস্য নির্বাচনে গণতন্ত্রের অপপ্রয়োগ চলতে থাকে। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা শুরু হয়। বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সিনেটর নির্বাচনে ভোটারদের প্রভাবিত করে চেষ্টা করা হয় নিজ দলীয় মনোভাবের প্রার্থীকে নির্বাচিত করার। সিনেট সদস্যের একাংশ সদস্য হন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের মধ্য থেকে। ছাত্ররাজনীতিতে নিজ নিজ দলের ছাত্রদের বলয় তৈরি করেন। গ্র্যাজুয়েট নির্বাচনেও এর প্রভাব থাকে। এসব নির্বাচনের পরও কিছু শক্তি দলীয় সরকার হাতে রাখে। কয়েকজন আমলা, জনপ্রতিনিধি, বিশিষ্ট নাগরিক-এসব ক্যাটাগরি থেকে সিনেট প্রতিনিধি মনোনীত হয়। এসবের নিয়ন্ত্রণ থাকে সরকার ও সরকারদলীয়দের হাতে। উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে দলীয় সরকার সিনেটরদের অধিকাংশের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন। ফলে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণত সদম্ভে সরকারদলীয় শিক্ষকদের প্যানেলই বিজয়ী হয়। এরপর সরকার পক্ষ বিজয়ী প্যানেলের অপেক্ষাকৃত বেশি নির্ভরযোগ্য একজন শিক্ষককে ভিসি হিসাবে মনোনয়ন দেন। গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণেই সবকিছু হয়। পরবর্তী পর্যায়ে গণতন্ত্রের পোশাকে দলীয় ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটে অভ্যন্তরীণ নানা নির্বাচনে। আর ইচ্ছা সফল করার জন্য বেশিরভাগ নিয়োগ হতে থাকে দলীয় দৃষ্টিতে। শিক্ষক নিয়োগে মেধার প্রশ্নটি সবসময় সামনে আসে না। এজন্য ক্যাম্পাসে একটি কথার প্রচলন রয়েছে যে, এখন শিক্ষক নিয়োগ হয় না, নিয়োগ হয় ভোটার। উপাচার্য ও তার সমর্থিত দল চায় শিক্ষক সমিতি, ডিন-এসব দায়িত্বশীল পদে নিজ দল সমর্থিত শিক্ষকরা নির্বাচিত হন। তাহলে বড় কোনো বিরোধিতার মুখে পড়বেন না। এসব নির্বাচনে ভোটার হন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তাই দল-পরিচয়ে শিক্ষক নিয়োগে এত মনোযোগ থাকে। এতদিন ধরে এ নিয়মই চলে এসেছে। এর কুফল হিসাবে দলীয় শিক্ষকদের অনেকের মধ্যে নিবেদিত শিক্ষক হওয়ার চেষ্টা দেখা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয় যে জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টির জায়গা তা অনেক ক্ষেত্রে অচেনা থেকে যাচ্ছে। এভাবে আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এর কাম্য ঔজ্জ্বল্য হারাচ্ছে। এ কথাও মানতে হবে যে, দলীয় রাজনীতির রঙে রাঙা হলেও রাজনীতি করা সব শিক্ষকই শিক্ষা, গবেষণা ও জ্ঞানচর্চায় অগ্রসর নন, তা নয়। কিন্তু বদ্ধ জলাশয়ে আটকে থেকে দলীয় দায়বদ্ধতায় অনেকের পক্ষে মুক্তবুদ্ধির সঙ্গে বিবেকের দায়ে চলা মুশকিল। এ বাস্তবতায় নিজ নিজ অঞ্চলে জ্ঞানচর্চা স্বাচ্ছন্দ্যে এগোয় না। জ্ঞান সৃষ্টির শক্তিও কমে যায়। সাম্প্রতিক গণআন্দোলনের সাফল্য নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। দেশের এ পরিবর্তিত বাস্তবতায় সুযোগ এসেছে আমাদের শিক্ষকদের ঘুরে দাঁড়ানোর। আমরা যদি চাই দলীয় বৃত্তের অচলায়তন ভেঙে বেরিয়ে আসার এখনই সময়। গা থেকে সব রং মুছে ফেলে আত্মশুদ্ধ হয়ে দলের নয়, বিবেকের দায়ে ও শক্তিতে শিক্ষকতায় নিজেদের নিবেদিত করা এখন সময়ের দাবি। একজন শিক্ষকের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা অবশ্যই থাকবে। রাজনীতির মাঠে নিজের আদর্শিক অবস্থানও থাকতে পারে। কিন্তু দলীয় রাজনীতির আনুগত্যে নিজের বিবেক ও স্বাধীন চিন্তা বিকিয়ে দেওয়াকে আমি কখনো শিক্ষকের অবস্থানের সঙ্গে মেলাতে পারি না। এই একটি কারণেই আমি শিক্ষকজীবনের শুরু থেকে কোনো দলীয় রাজনীতির পোশাক পরে রঙিন হতে পারিনি। এজন্য হয়তো তথাকথিত লাভজনক জায়গায় কারও আনুকূল্য নিয়ে যাওয়া হয়নি। অবশ্য এতে আফসোসও করিনি কখনো। তেমন আকাঙ্ক্ষাও নিজের মধ্যে তৈরি হয়নি। বরং চল্লিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে স্বস্তি পেয়েছি বারবার। কারণ অনেক সময়ই ভেবেছি যদি উলটোটি হতো, তাহলে বিবেকের কাছে বারবার দোষী হতে হতো। আমি সবসময় ভাবি এবং বলি এদেশের বাস্তবতায় আমি অচল। কারণ আমি কোনো বিষয়ে কারও কাছে তদবির করতে যেমন পছন্দ করি না, কেউ কোনো বিষয়ে আমার কাছে তদবির করতে এলেও অস্বস্তি বোধ করি। এজন্য বন্ধুদের অনেকে বলেন, আপনি সত্যিই অচল। সব যোগ্যতা থাকার পরও আপনার মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে পারল না আপনার এ বদগুণের কারণে। আপনি একবারও উপাচার্য বা তার দলের শিক্ষক নেতাদের কাছে তদবির করলেন না। আমি বলি, এতে আমার খেদ নেই। আমার মেয়েরও নেই। ও ওর যোগ্যতা দিয়ে অনেক দূর যেতে পারবে-আমি বিশ্বাস করি। আনন্দ এখানেই যে, নিজেকে ছোট করতে হলো না। ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ এখানে টেনে আনার উদ্দেশ্য দলীয় রাজনীতির বৃত্তে বন্দি থাকিনি বলে আমি অনেক বেশি মুক্তির আনন্দ লাভ করি তা সবার সঙ্গে শেয়ার করতে। আমি জানি, আমার যে সহকর্মীরা আমার মতোই মুক্ত, দিনশেষে তাদের আনন্দ আমার মতোই। শিক্ষকদের অনেকে দলীয় বৃত্তে বন্দি থাকেন বলেই ছাত্ররাজনীতিতে এর প্রভাব পড়ে। ক্ষমতার রাজনীতির বলয়ের ছাত্ররা অনেক সময় প্রশ্রয় পায় দলীয় শিক্ষকদের কাছ থেকে। দলীয় শক্তিতে অধিষ্ঠিত উপাচার্যরা দলীয় ছাত্রদের অন্যায় কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দেন বা প্রশ্রয় দিতে বাধ্য হন। এসবের কারণে সার্বিকভাবে সাধারণ শিক্ষকরা নির্বিচারে হেয়প্রতিপন্ন হন। বিপ্লবোত্তর সময়ে শিক্ষকদের পদত্যাগ নিয়ে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। সব যুক্তির পরও এ অবস্থা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। তবে শিক্ষকদেরও সতর্ক থাকা উচিত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোনো কোনো শিক্ষকের অশিক্ষকসুলভ আচরণও এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম দিতে পারে। অসুস্থ রাজনীতি আমাদের কম ক্ষতি করেনি। ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব সমাজে সব যুগেই ছিল। স্কুল-কলেজের শিক্ষক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সবার মধ্যেই ছিল। এসবই ছিল প্রধানত ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব। গোষ্ঠীগত লাভালাভের প্রশ্ন। এসব দ্বান্দ্বিক অবস্থা খুব কমই শিক্ষার্থীদের প্রভাবিত করত। কিন্তু যখন থেকে সব প্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনীতি বিভাজনের সুস্পষ্ট রেখা তৈরি করল, তখন থেকে এর কালো ছায়া শিক্ষার্থীর ওপরও প্রতিফলিত হতে থাকে। তাই যে তারুণ্য এত বড় একটি সফল গণঅভ্যুত্থান ঘটাতে পারল, তাদের অনেকে যারা রাজনৈতিক মতাদর্শে আটকে আছেন, তারা মুক্তচিন্তার শিক্ষকদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারছেন কি? দীর্ঘদিন ধরে যে অপরাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞানচর্চা আর জ্ঞান সৃষ্টির তপোবন বানাতে দেয়নি, সেই অচলায়তন এবার ভাঙবে বলেই আশা করে আছি। কারণ বড় রকমের ভাঙচুরের মধ্য দিয়েই নতুন সৃষ্টির সম্ভাবনা জাগে। এ সম্ভাবনাকে যদি বাস্তবের উঠোনে না আনতে পারি, তাহলে নিষ্ফল হয়ে যাবে শিক্ষার্থী-জনতার আত্মাহুতি। এত রক্তদান কি বৃথা হয়ে যাবে? বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা কি অধরাই থেকে যাবে? আমরা বিশ্বাস করি, প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিতে পারলে এমন শানিত তারুণ্য আলোকিত পথ ঠিকই খুঁজে পাবে। কিন্তু বড় সংকট আমাদের তথা শিক্ষকদের নিয়েই। আমরা যদি ক্যাম্পাসে নীল-হলুদ-সাদা ইত্যাদি বর্ণ থেকে বেরিয়ে এসে মুক্ত মানুষ হতে পারি এবং শিক্ষার্থী তার শিক্ষককে পথপ্রদর্শক ও আদর্শ ভাবতে পারে তবেই আমরা শিক্ষাঙ্গনে আলোকিত নতুন ভোর দেখতে পাব। ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় shahnawaz7b@gmail.com