শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সৎ ব্যক্তিদের আনতে হবে

২৪ এপ্রিল, ২০২৪ | ৫:০১ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

মাঝেমধ্যে এমন সব ঘটনা সংঘটিত হয়, মনে হয় লজ্জা-শরমের বুঝি আর অবশিষ্ট বলে কিছু রইল না, সমাজে মূল্যবোধ একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় স্তর যা-ই হোক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংবেদনশীল মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করে-এমন ঘটনা দৃষ্টিতে পড়লে আমি প্রথমেই সংক্ষেপে হলেও প্রতিষ্ঠানটির আদিঅন্ত জানার চেষ্টা করি। ইতিহাসে উইলিয়াম বড় ও ছোট পিট, প্রথম ও দ্বিতীয় এলিজাবেথ; ঠিক এমনই জর্জ, হেনরি, এডওয়ার্ড; চন্দ্রগুপ্ত, মহীপাল, আবদুর রহমান-এমন সব নামের একাধিক বিখ্যাত ব্যক্তির নাম লেখা রয়েছে। একই বংশের কিংবা শত বছরের ব্যবধানে কেবল ‘নম্বর’ বসিয়ে কেন এমন নামকরণ তারও আলাদা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ রয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ নেতা এবং প্রভাবশালী দুই সহোদর কীভাবে ছোট মনির ও বড় মনির নামে পরিচিতি লাভ করেছেন, তা আমার মতো অনেকেরই বোধকরি অজানা। কনিষ্ঠজন টাঙ্গাইল-২ (ভূঞাপুর-গোপালপুর) আসনের সরকারদলীয় সংসদ-সদস্য তানভীর হাসান ওরফে ছোট মনির আর জ্যেষ্ঠজন টাঙ্গাইল শহর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও জেলা বাস কোচ-মিনিবাস মালিক সমিতির মহাসচিব গোলাম কিবরিয়া ওরফে বড় মনির। দুই ভাইয়ের নামের সঙ্গেই আমার পরিচয় সংবাদমাধ্যমের সুবাদে। তাদের মধ্যে বড় মনির সম্প্রতি ভূঞাপুর উপজেলার লোকমান ফকির মহিলা ডিগ্রি কলেজের সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ১ এপ্রিল গোলাম কিবরিয়া ওরফে বড় মনিরকে কলেজের সভাপতির পদ থেকে বহিষ্কার করেছে। এর আগে টাঙ্গাইলেও এক কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের মামলা রয়েছে বড় মনিরের বিরুদ্ধে। সেই মামলায় উচ্চ আদালত থেকে তিনি জামিনে আছেন। কলেজ সভাপতি হিসাবে নিয়োগের দুই সপ্তাহ যেতে না যেতেই সভাপতির বিরুদ্ধে ধর্ষণ-মামলা! খুবই অবাঞ্ছিত, অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক। খবরে প্রকাশ, গত ২৯ মার্চ ঢাকার তুরাগ থানার প্রিয়াঙ্কা সিটি আবাসিক এলাকায় বড় মনিরের ফ্ল্যাট থেকে এক কলেজছাত্রীকে উদ্ধার করা হয়। তাকে অস্ত্রের মুখে আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয় বলে মামলায় বড় মনিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে ওই কলেজছাত্রী। ওইদিন রাতে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বর থেকে আসা একটি ফোন কলের সূত্র ধরে বড় মনিরের ফ্ল্যাট থেকে কলেজছাত্রীকে উদ্ধার করে পুলিশ। তবে রাতেই ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান বড় মনির। পরে তার বিরুদ্ধে থানায় ধর্ষণ মামলা হয়। বড় মনির তার ভাই সংসদ-সদস্য ছোট মনিরের ডিও লেটারের মাধ্যমে সভাপতি হিসাবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। টাঙ্গাইল জেলার করটিয়ায় সা’দত কলেজ প্রতিষ্ঠা পায় ১৯২৬ সালে। প্রতিষ্ঠাকাল বিবেচনায় উচ্চশিক্ষা দান ও গ্রহণে বৃহত্তর ময়মনসিংহে (ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুর ও শেরপুর) আনন্দ মোহন কলেজের পর দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠান হলো সা’দত কলেজ। এ কলেজের ১৭ বছর ও ২০ বছর পর প্রতিষ্ঠিত হয় যথাক্রমে কুমুদিনী মহিলা কলেজ (১৯৪৩) ও প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ কলেজ (টাঙ্গাইল) (১৯৪৮)। টাঙ্গাইলের কাগমারীতে মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজটি (১৯৫৭) বৃহত্তর ময়মনসিংহে অষ্টম। টাঙ্গাইলের মধুপুর একটি ঐতিহ্যবাহী জনপদ। ১৮৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত থানাটি ১৯৮৩ সালে উপজেলায় উন্নীত হয়। মধুপুর পৌরসভা স্থাপিত হয় ১৯৯৫ সালে। একটি পৌরসভা ও ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত মধুপুর উপজেলার আয়তন ৩৭০.৪৭ বর্গকিলোমিটার ও জনসংখ্যা ২ লাখ ৯৬ হাজার ৭২৯ জন। এমন একটি উপজেলায় স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মধুপুর কলেজ। মধুপুর কলেজটি ডিগ্রি স্তরে পাঠদানোপযোগী উপজেলার একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এছাড়া কলেজটির অন্য একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। বিগত ৯৮ বছরে (১৯২৬-২০২৪) ১২ উপজেলা নিয়ে গঠিত বর্তমান টাঙ্গাইল জেলায় ডিগ্রি স্তরে যে ৪৬টি কলেজ গড়ে উঠেছে (তার মানে প্রতিটি উপজেলায় গড়ে ৪টি কলেজ) সেগুলোর মধ্যে মধুপুরই একমাত্র উপজেলা, যেখানে সবেধন নীলমণি একটি মাত্র কলেজ। ৫২ বছরেও (১৯৭২-২০২৪) এখানে দ্বিতীয় কোনো কলেজ গড়ে ওঠেনি। অবিশ্বাস্য বলে মনে হলেও একথা সত্য, মধুপুর ছাড়া বাকি ১১ উপজেলাতেই রয়েছে একাধিক কলেজ, এমনকি উপজেলাভেদে চার-পাঁচটি করেও (সদরে সাতটি, তিনটি উপজেলায় পাঁচটি করে, চারটি উপজেলায় চারটি করে, একটিতে তিনটি ও দুটি উপজেলায় দুটি করে)। টাঙ্গাইল জেলায় তুলনামূলকভাবে নবীন উপজেলা হলো ভূঞাপুর। স্বাধীনতা লাভের (১৯৭১) পরও এটি ছিল টাঙ্গাইল সদরের একটি ইউনিয়ন। ভূঞাপুর ১৯৭৪ সালে থানা এবং ১৯৮৩ সালে উপজেলায় উন্নীত হয়। ভূঞাপুর পৌরসভা স্থাপিত হয় ১৯৯৪ সালে। একটি পৌরসভা ও ছয়টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ভূঞাপুর উপজেলার আয়তন ১৩৪.৪৬ বর্গকিলোমিটার আর লোকসংখ্যা ১ লাখ ৯০ হাজার ৯১০ জন। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য, ভূঞাপুরের মতো একটি উপজেলায় ডিগ্রি স্তরে কলেজ রয়েছে পাঁচটি। লোকমান ফকির মহিলা কলেজ (স্থাপিত : ১৯৯৫) ওই পাঁচটি কলেজেরই একটি। সমাজে এমন কিছু পেশাজীবী রয়েছেন, যারা মলমূত্র ও নোংরা আবর্জনা সরানো থেকে আরম্ভ করে পরিষ্কার-পচ্ছিন্নতার কাজে নিয়োজিত। অনেকে দুর্গন্ধময় পরিবেশে ইতর শ্রেণির প্রাণী লালন-পালন করেন। তাদের বসতি এবং আবাসগৃহও থাকে অনেকটা অপরিচ্ছন্ন। সংশ্লিষ্ট বাসিন্দারা সেখানে অভ্যাসবশত দিব্যি আছেন। পরিবেশ যাই হোক, তাদের কিছু যায়-আসে না, খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। কিন্তু সাধারণ লোকজন সেদিক দিয়ে কদাচিৎ আনাগোনা করলে নাকে দুর্গন্ধ এসে ধাক্কা খায়। শিক্ষাক্ষেত্রেও হয়েছে আজ এমনই দশা। বাইরে থেকে কেউ এসে শিক্ষাপ্রশাসন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলেই আমাদের সম্পর্কে একটি ধারণা পেয়ে যাবেন। আমরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কাদেরকে বসাই, বেছে বেছে কেমন লোকদের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, ট্রেজারার-রেজিস্ট্রার কিংবা অধ্যক্ষ-প্রধানশিক্ষক বানাই। আর বানাই গভর্নিং বডি বা ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি। ব্যাঙের ছাতার মতো অপরিকল্পিতভাবে যেখানে-সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের চেয়ে ব্যবস্থাপনা ও সঠিক দেখভালের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া যে জরুরি তা অনেকবারই প্রমাণিত হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কেবল শিক্ষিত ও প্রভাবশালী নয়, সচ্চরিত্রবান ব্যক্তিদেরও আসা নিশ্চিত করা চাই। টাঙ্গাইলে ভূঞাপুর উপজেলার একটি কলেজের সভাপতির বিরুদ্ধে ধর্ষণের মতো জঘন্য একটি মামলা হয়েছে। ঘটনার সত্যাসত্য আমরা জানি না, অভিযুক্ত পলাতক রয়েছেন। তবে এটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। ধর্ষণ, নারী লাঞ্ছনা কিংবা অর্থ আত্মসাৎ-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, একের পর এক ঘটেই চলেছে। নেই কোনো প্রতিকার, নেই কোনো প্রতিবিধান! আহারে, কী দুর্ভাগ্য আমাদের! বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক ও কলাম লেখক