হাতি-মানব দ্বন্দ্ব ও সমাধানের পথ

১৫ জানুয়ারি, ২০২৪ | ৮:৫৭ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

মানব-বন্যপ্রাণী দ্বন্দ্ব শুরু হয় তখনই, যখন মানুষ আর প্রাণী পরস্পরের সংস্পর্শে আসে। সাধারণত দেখা যায় মানুষ আত্মরক্ষার্থে প্রাণী হত্যা করে। এ হত্যা অনেক ক্ষেত্রে অনেক প্রাণীকে বিলুপ্তির দিকে নিয়ে যায়। আবার এসব বন্যপ্রাণীর দ্বারা ক্ষতির মুখে পড়ে অনেক কৃষক, আদিবাসী গরিব মানুষ। মানুষ ও বন্যপ্রাণীর দ্বন্দ্ব এখন শুধু উন্নয়ন ইস্যুই নয়, এটি একই সঙ্গে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও মানবিক ইস্যুও বটে। যদিও এসডিজি লক্ষ্যমাত্রায় একে নীতিনির্ধারকরা এড়িয়ে গেছেন। ডব্লিউডব্লিউএফ এবং ইউএন এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের প্রতিবেদন অনুযায়ী মানুষ-বন্যপ্রাণী দ্বন্দ্ব পৃথিবীর অনেক প্রজাতির টিকে থাকার জন্য এখন হুমকিস্বরূপ। একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী এর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে বন্য বিড়াল প্রজাতির ওপর। এদের ওপর প্রভাব ৭৫ শতাংশেরও বেশি। এছাড়া সামুদ্রিক মাংসাশী প্রাণী এবং হাতির ওপরও এ সবের ক্ষতিকর প্রভাব বেশি দেখা যাচ্ছে। বন্যপ্রাণী নানাভাবে হুমকির মুখে পড়ছে। আবহাওয়া পরিবর্তন, জঙ্গল কেটে ফেলা, অবৈধ বন্যপ্রাণী বিক্রয়; এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মানুষ-বন্যপ্রাণী দ্বন্দ্ব, যা খুব সহজেই বন্যপ্রাণীর সংখ্যাকে কমিয়ে ফেলছে। দাবানলের কারণে বাঘ-হাতি নতুন অঞ্চলে আশ্রয় নিচ্ছে। পশুপাখিরা দিনের অতি তাপমাত্রা থেকে রক্ষা পেতে নিশাচর হয়ে যাচ্ছে। রাতেরবেলা তারা ঘুমন্ত মানুষের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে। নীল তিমি আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে পরিব্রাজনের সময় পরিবর্তন করছে। ফলে জাহাজের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হতে দেখা যাচ্ছে। তানজানিয়ায় খাবারের অভাবে হাতি গ্রামে ঢুকে পড়ছে। শস্যের ক্ষতি করছে, মানুষের হাতে মারাও পড়ছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে শস্যক্ষেতে হাতি। যেখানে হাতি হয় শস্য বিনষ্ট করছে, নয়তো কোনো সম্পত্তি ধ্বংস করছে। মানুষও হাতির খুব কাছে চলে যাচ্ছে। এ কারণে মানুষ ও হাতির মৃত্যু ঘটছে। এছাড়া হাতির দেহের বিভিন্ন অংশের চোরাচালান এ সংঘর্ষ বাড়িয়ে তুলছে। সংঘর্ষের ফলে শুধু মানুষই বিপদের মুখে পড়ছে না, এটি একটি অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র ও স্বাভাবিক জীবনযাপনকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলছে। মানুষ ও হাতি হাজার বছর ধরে একসঙ্গে বসবাস করে আসছে; কিন্তু উন্নয়ন, বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণ ক্রমেই এসবের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। হাতি তৃণভোজী প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রাণী। একটি হাতি দিনে ১৫০ কেজি ঘাস এবং ১৯০ লিটার পানি পান করে। এ কারণে খাদ্য ও পানীয়ের জন্য বড় একটা এলাকা হাতিকে ঘুরে বেড়াতে হয়। অনেক দেশেই মানুষ হাতির বিচরণ ক্ষেত্রে বসবাস করে। হাতি ছাড়াও তাদের বন্যপ্রাণীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয় জমি, খাদ্য, পানি ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে। এসব অঞ্চলের মানুষ হাতির বিচরণ এলাকা কতটুকু বা অন্যান্য বন্যপ্রাণী কোথায় বিচরণ করে এসব নিয়ে অসচেতন। ক্রমশ হাতির বসবাসের এলাকায় নতুন গ্রাম, খামার, শহর, বড় রাস্তা, শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে। হাতির যাতায়াতের পথে বেড়া দেওয়া হচ্ছে। বনভূমি ক্রমশ কৃষিভূমিতে পরিণত হচ্ছে। আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের ধরন পালটে যাচ্ছে। হাতিরা নতুন নতুন এলাকায় ঢুকে পড়ছে এ কারণে। পানি ও জ্বালানি সংগ্রহ করতে গিয়ে মানুষ বড় ধরনের বিপদের মুখে পড়ছে। গবেষণা বলছে, প্রতি বছর শ্রীলংকায় ২০০ হাতি হত্যার কবলে পড়ে। ভারতে মানুষ-হাতি সংঘর্ষে মারা পড়ে বছরে ১০০ হাতি। কেনিয়াতেও এ সংখ্যা বছরে ১২০-এর বেশি। একটি বড় পুরুষ হাতি ওজনে ৬ হাজার ৮০০ কেজি হয়। যা অনেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের থেকে একশ গুণ বেশি ভারী। যখন হাতি নিজেকে হুমকির মুখে পড়েছে মনে করে তখন সে মানুষকে আঘাত বা হত্যা করে। মানুষের ঘরবাড়ি ও সম্পদ বিনষ্ট করে। ভারতেই প্রতিবছর হাতির কারণে অন্তত ৫ লাখ পরিবারের শস্যের ক্ষতি হয়। ফলে এসব পরিবার প্রচণ্ড আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে এবং স্বাস্থ্য ও পুষ্টির অভাবে পড়ে। আফ্রিকায় বৈজ্ঞানিকভাবে হাতিদের বিচরণ ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে। সেখানে হাতিরা স্বাভাবিকভাবে বিচরণ করে আর মানুষের আবাসস্থল সেই জায়গা থেকে দূরে রাখা হয়েছে। এতে অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া গেছে। হাতির সংখ্যা সেখানে বাড়ছে। চীনের একটি জায়গায় হাতি রক্ষা প্রকল্পের আওতায় ২১০টি বাড়িতে ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করা হয়। এর ফলে তাদের আয় ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। সেখানে স্থানীয়ভাবে সচেতনতা গড়ে তোলা হয়েছে এবং পূর্ব সতর্কতার কেন্দ্র করা হয়েছে স্থানীয়ভাবে। এটিও হাতি বৃদ্ধিতে ভালো কাজ করছে। ভারতে জ্বালানি হিসাবে এলপিজি ও সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য স্থানীয়দের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। এতে গাছ কাটা কমেছে। এ ব্যবস্থাপনাও মানুষ ও হাতির সংঘর্ষ কমিয়ে এনেছে। হাতির কারণে কৃষিজমির ব্যাপক ক্ষতি হয়। মূলত হাতির আবাস ভূমির আশপাশের কৃষি জমি এ কারণে ক্ষতির মুখে পড়ে। এই কৃষি জমি তৈরি করার সময় হাতি যেন না আসে সেভাবেই চারপাশটা তৈরি করা হয়। এসব সত্ত্বেও হাতি কৃষিভূমিতে আক্রমণ করে। ক্ষুদ্র চাষিরা এতে অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এক রাতেই এসব কৃষি জমি ধ্বংস করে ফেলে হাতি। প্রকৃত পরিস্থিতি যেটা তৈরি হয় তা হলো, কৃষকরা যেসব জায়গায় আখ, ভুট্টা, শাকসবজি চাষ করে যা হাতিদেরও বেশ পছন্দের। বনের চেয়ে এসব জায়গায় খুব সহজেই হাতিরা কৃষি জমি থেকে পুষ্টিকর ও স্বাদের খাবার সংগ্রহ করতে পারছে। ফলে তারা অনেকটা বনের চেয়ে কৃষি জমিতে খাওয়াটাই বেশি পছন্দ করে। দিন দিন হাতি আবাসস্থলের কাছে মানুষের বসতি বেড়েই চলেছে। বিশ্বের ২০ ভাগ মানুষ এখন হাতির আবাসস্থলে বসবাস করে। হাতির আবাসস্থলের কাছে মানুষের বসতি হওয়ায় ভূমি ও জল নিয়ে মানুষ ও হাতির মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। অনেক সময় মানুষ এমন জায়গায় বসতি করছে যেটা মূলত হাতির পরিব্রাজনের পথ। অনেক ক্ষেত্রে হাতিরা যে রাস্তা দিয়ে জল পান করতে যাবে সে রাস্তায়ই বাধা তৈরি করছে। এমনকি বাঁধ, পাকা রাস্তা, রেললাইন তৈরি করছে। ফলে মানুষ আহত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে মারাও পড়ছে। ডব্লিউডব্লিউএফ-এর মতে ভারতে প্রতি বছর ১০০ এ বেশি মানুষ হাতির আক্রমণে মারা যায় আর আহত হয় শতশত মানুষ। এছাড়া মানুষ নানা কারণে হাতি হত্যা করছে। প্রতি বছর শত শত হাতি হত্যা করা হয় গুলি করে, অথবা বিষ দিয়ে অথবা বিদ্যুতায়িত করে। গত ৫ বছরে ১০০-এর বেশি হাতি ভারতে বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা পড়েছে। বন বিভাগের তথ্যমতে, মানব-হাতি দ্বন্দ্বে বাংলাদেশে গত ১৪ বছরে ৬৬টি হাতি হত্যা হয়েছে এবং ২৩৬ জন মানুষ মারা গেছে। আইইউসিএন-এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে তিন ধরনের হাতি দেখা যায়। কিছু হাতি তাদের আবাসস্থলে বাস করে, কিছু হাতি পরিব্রাজন করে ও কিছু হাতি পোষ মানা। বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ৫০০-এর মতো হাতি ছিল। সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী এ হাতির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২৮ থেকে ৩২৭-এ। বাংলাদেশে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার ছাড়াও মানব-হাতি সংষর্ষের ঘটনা ঘটে শেরপুর, জামালপুর ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন জায়গায়। বিজ্ঞানীদের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ১২টি হাতি চলাচলের জায়গা রয়েছে; কিন্তু তা হাতির জন্য উপযুক্ত নয়। হাতি বেঁচে থাকার স্বার্থে এ পরিব্রাজনের রাস্তাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দিন দিন এসব জায়গা সংকুচিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে এ সমস্যা দূরীকরণে প্রাথমিকভাবে দরকার পূর্ব সতর্কতার ব্যবস্থা করা, যাতে হাতি এলেই সবাই আগে জেনে যায়। দ্বিতীয়ত, হাতি যে রাস্তা দিয়ে চলাচল করে সেসব পথে হাতির পছন্দের গাছ লাগানো, যেন এসব গাছপালাতেই হাতির খাবার হয়ে যায়, বাসাবাড়ি কিংবা খেতে আসার প্রয়োজন না হয়। তৃতীয়ত, স্থানীয়দের মাধ্যমে একটি দল গঠন করা। যার কাজ হবে হাতি দেখামাত্র ত্বরিৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। মোট কথা, হাতির সংখ্যা মানুষের কারণেই কমে যাচ্ছে। মানুষের প্রয়োজনেই হাতিকে এখন বাঁচিয়ে রাখা দরকার। সেজন্য হতদরিদ্র মানুষের আয় রোজগার বাড়ানো ও আবাসস্থান যেমন দরকার, তেমনি দরকার হাতির প্রয়োজনীয় খাবার ও আবাসস্থল। ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র : শিক্ষক ও গবেষক